বাংলাদেশের ওষুধশিল্প একটি দ্রুত বিকাশমান শিল্প খাত। এক সময় ছিল, যখন চাহিদার প্রায় আশি ভাগ ওষুধ আমদানি করা হতো। বর্তমানে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বাংলাদেশে উৎপাদিত ওষুধ বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। দেশের শিল্প খাতের উন্নয়ন, বিশেষত ওষুধ খাতের অবস্থা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে সাম্প্রতিক দেশকালের সহকারী সম্পাদক মুহাম্মদ ওয়াশিকুর রহমানের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান রেডিয়েন্ট ফার্মাসিউটিক্যালসের চেয়ারম্যান মো. নাসের শাহরিয়ার জাহেদী।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে ব্যবসার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নয়নে ইতিবাচক পরিবর্তন কী কী?
ব্যবসার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নয়ন বা অগ্রগতি যথেষ্ট হয়েছে, এ বিষয়ে সবাই একমত। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশিদের মধ্যে বলার মতো উদ্যোক্তা ছিল না; কিন্তু গত ৫০ বছরে বাংলাদেশিদের মধ্যে অনেক সফল উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। উদ্যোক্তা হওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে। সেজন্য ইতিমধ্যে ছোট-বড় বিভিন্ন মাপের করপোরেট প্রতিষ্ঠান দাঁড়িয়েছে। এটা একটি গুণগত পরিবর্তন বা অগ্রগতি। আরেকটি বিষয়, বাংলাদেশের প্রায় সবকিছুই আমদানিনির্ভর ছিল। আমরা সেখান থেকে অনেকটাই উত্তরণ ঘটাতে পেরেছি। আমাদের দেশের প্রয়োজনের অনেক কিছু আমরা এখন দেশেই উৎপাদন করছি। বিভিন্ন কনজিউমার প্রোডাক্ট, টেক্সটাইল, ওষুধ- এসব ক্ষেত্রে আমদানিনির্ভরতা অনেক কমেছে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি।
তৃতীয়ত, কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা রপ্তানিও করতেও সক্ষম হয়েছি। আগে পাট বা পাটজাত ছাড়া কোনো কিছুই রপ্তানি পণ্য ছিল না; কিন্তু এখন গার্মেন্ট ছাড়াও ওষুধ, চামড়াশিল্প, সিরামিক, তথ্যপ্রযুক্তিসহ অনেক কিছুই আমরা রপ্তানি করছি। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেও তা রপ্তানি হচ্ছে। সার্বিকভাবে এটি একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রপ্তানি বাজার ও সম্ভাবনা সম্পর্কে জানতে চাই?
আমাদের রপ্তানি বাজার এবং সম্ভাবনার জায়গাটি অপার সম্ভাবনাময়। এই জায়গাটি কাজে লাগাতে হবে। এ জন্য ব্যবসায়ীরা যেটা করার, সেটা তো করবেনই; কিন্তু বড় বাধার জায়গাটা হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি। আমাদের দেশের ভাবমূর্তিকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে হবে। এই দিকটিতে সবাই মিলে নজর দিতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ী ও সরকারকে যৌথভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের উৎপাদিত পণ্যগুলোর মানোন্নয়নের পাশাপাশি ভালো ব্র্যান্ডিং করতে পারলে আন্তর্জাতিক বাজারে আস্থার জায়গা তৈরি হবে। আর সেটা যদি আমরা সবাই মিলে করতে পারি, তাহলে অপার সম্ভাবনা কাজে লাগানো সম্ভব হবে।
বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের ভবিষ্যৎ এবং করণীয় প্রসঙ্গে জানতে চাই
বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল। তবে ওষুধ শিল্পকে এগিয়ে নিতে হলে আরও অর্গানাইজড হতে হবে, পাশাপাশি পেশাদারিত্ব আনতে হবে। মনে রাখতে হবে ওষুধ শিল্প কিন্তু সাধারণ শিল্প খাতের মতো নয়। এটা একটু রেগুলেটেড ব্যবসা। তবে ভালো দিকটি হচ্ছে এ খাতে আমরা সবচেয়ে সফল। ওষুধ উৎপাদনে অত্যন্ত সফলতার পরিচয় দিতে পেরেছি। খুব ভালোমানের ওষুধ উৎপাদন করছি। আমরা ইতিমধ্যে দেশের ৯৮ ভাগ চাহিদা নিজেদের উৎপাদিত ওষুধে মেটাতে সক্ষম হয়েছি। তাই এখন নজর দিতে হবে কাঁচামাল ও মোড়ক সামগ্রী উৎপাদনের দিকে। সেখানে স্বয়ংসম্পূর্ণতা আনতে পারলে আমাদের জন্য এটি হবে একটি বড় মাইলফলক। আর ওষুধ উৎপাদনের মান, পেশাদারিত্ব, বাজারজাতকরণে নীতিনৈতিকতা, মানের পেশাদারিত্বের দিকে নজর দিতে হবে। এক্ষেত্রে ঔষুধ প্রশাসন ও রেগুলেটরি যে অথরিটি তাদের আরও এমপাওয়ার করতে হবে। একই সঙ্গে ঔষধ প্রশাসনের পেশাদারিত্ব, কার্যকারিতা বাড়ানো এবং ক্ষমতায়নের দিকেও নজর দিতে হবে। প্রয়োজনে আরও দক্ষ জনবল নিয়োগ করতে হবে। এসব করা গেলে সবার জন্যই ভালো হবে।
স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ওষুধ উৎপাদনের জন্য বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা থেকে ২০৩৩ সাল পর্যন্ত বিশেষ ছাড় পেয়েছে। এই সময় পার হওয়ার পর কি ওষুধ শিল্পের বিস্তার বিঘ্নিত হবে? করণীয় কী?
আমরা প্রায়ই আলোচনা করে থাকি যে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ওষুধ উৎপাদনের জন্য বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা থেকে বিশেষ ছাড় পেয়ে আসছে ২০৩০ বা ৩৩ সাল পর্যন্ত। এ সময় পার হলে অনেকে মনে করেন সাংঘাতিক কিছু একটা হয়ে যাবে। আমি আগাগোড়াই বলে এসেছি কিছুই হবে না। তার কারণটা হলো ২০০৫ সালের ওষুধনীতি এবং ২০১৬ সালেও যা রাখা হয়েছে; সেটাই বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে। ওখানে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, আমদানির ক্ষেত্রে আমরা বিশেষায়িত ওষুধ এবং ইনোভেটিভ ড্রাগের ক্ষেত্রে নজর দেবো। কোনো প্রকার জিনেরিক ওষুধ আমদানি করার সুযোগ এখনোও নেই, তখনো থাকবে না এবং ওখানে আমরা কোনো ট্যারিফ এমবার্গ দেইনি। ওখানে আমরা কিছু রেগুলেটরি রিকোয়ারমেন্টসের কথা বলেছি, ওষুধ নীতিতে যেটা ওষুধের কোয়ালিটির সঙ্গে জড়িত এবং যুক্তিসম্মত টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন, যেটা ডব্লিউটিওতে কোনোভাবেই প্রভাব ফেলবে না। সুতরাং আমার যেটা মনে হয় ২০০৫ এবং ২০১৬ সালের ওষুধ নীতিতে স্থানীয় ওষুধ শিল্পকে উৎসাহিত এবং তাদের উন্নয়নকে আরও ত্বরান্বিত করার জন্য যে উপাদানগুলোকে রাখা হয়েছে; তা এই ডব্লিউটিওর সুবিধা বন্ধের পরও আমাদের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে। সুতরাং এটা নিয়ে আমি তেমন চিন্তার কারণ দেখি না। উন্নত দেশে উন্নীত হওয়ার কারণে ওইসব রপ্তানি শিল্প অ্যাফেক্টেড হবে, বাংলাদেশের এলডিসি হওয়ার কারণে যারা বিশেষ সুবিধা ভোগ করে। ওষুধ শিল্প ওই ক্যাটাগরিতে পড়ে না। ওষুধ শিল্পে আমরা আট দশটা দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই ব্যবসা করছি। সুতরাং ওইটার ইম্প্যাক্ট ওষুধ শিল্পের ওপর পড়বে না। হয়তো গার্মেন্টস অ্যাফেক্টেড হতে পারে বা অন্যান্য ক্ষেত্র যারা এলডিসি হওয়ার কারণে, আমাদের থেকে উন্নত দেশে যে ট্যারিফ বেনিফিট বা প্রেফারেন্সিয়াল ট্রিটমেন্ট পেতাম- সেখানে হয়তো কিছুটা অ্যাফেক্টেড হতে পারে; কিন্তু ওষুধ শিল্পে ওই ধরনের কোনো সুযোগ-সুবিধা প্রযোজ্য নয়। এখানে কপিরাইট নিয়ে আমাদের অত্যন্ত ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। আমি প্রায়ই সভা-সমাবেশে শুনি, এত সালের পর যখন আমাদের পেটেন্ট রাইট চলে আসবে, তখন আমাদের কী হবে। একটা জিনিস আমি ক্লিয়ার করি। সেটা হলো যে বাংলাদেশে ডব্লিউটিওতে স্বাক্ষর করেছে। সে অনুযায়ী একটা ছাড় পেয়েছে; কিন্তু বাংলাদেশের আইন সে অনুযায়ী সংশোধন করা হয়নি। ফলে ডব্লিউটিও যে ছাড় দিচ্ছে সেটি এক্সিকিউটিভ অর্ডার; কিন্তু আইন এখন পর্যন্ত সে ছাড় দেয় না। এখনো আমাদের ১৯১১ সালের প্যাটেন্ট আইন পূর্ণাঙ্গভাবে বলবৎ। সুতরাং ওইটাকে স্থগিত না করা পর্যন্ত আইনত ডব্লিউটি এর কোনো সুবিধা আমাদের দেশের কেউ ভোগ করতে পারে না পেটেন্ট এর দিক থেকে। হচ্ছে না কেন? পেটেন্ট হচ্ছে কিন্তু কেউ এটাকে চ্যালেঞ্জ করছে না। কেউ যদি চ্যালেঞ্জ করে, তখন কিন্তু ডব্লিউটিওর বিষয়টি তাকে বেনিফিট দেবে না। কারণ আমার দেশের আইন সবকিছুর ঊর্ধ্বে। আমরা এখনো পেটেন্ট ল’টি রেখে দিয়ে এখন যে অবস্থায় আছি, ডব্লিউটির যখন এই টার্মটা শেষ হবে আইনের দিক থেকে আমরা একই অবস্থায় থাকব। প্রশ্ন হচ্ছে আপনি আইন প্রয়োগ করছেন কি-না। আজকে পেটেন্ট ল’ কিন্তু আমার দেশে শক্তভাবেই বিদ্যমান; কিন্তু এটা আমাদের গায়ে লাগছে না, কারণ কেউ পেটেন্ট ইনফ্রিজমেন্টকে চ্যালেঞ্জ করেনি। যদি কেউ চ্যালেঞ্জ করে তখন কোর্ট আইন খুললেই দেখবে যে এটা ইনফ্রিজমেন্টের বিপক্ষেই যাবে। সুতরাং ডব্লিউটিও যে বেনিফিট বাংলাদেশকে দিচ্ছে, ’৩৩ সালের পর যে পেটেন্ট ল’ এনফোর্স হবে। পেটেন্ট ল এখনো বিদ্যমান আছে, পেটেন্ট লোন নিয়ে একটি ধোঁয়াশা কাজ করে। এটা হয়তো সবাই খেয়াল করে দেখেন না; কিন্তু সেমিনার-সিম্পোজিয়াম এ যারা এসব বলেন, আমি তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের বাস্তবতার মিল খুঁজে পাই না।
বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের কাঁচামালের ৯৭ ভাগই আমদানিনির্ভর। এপিআই শিল্প পার্ক চালু হলে স্থানীয়ভাবে কাঁচামালের জোগান কতটা পূরণ হবে?
যেটা বলছেন বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের ৯৭ ভাগই আমদানিনির্ভর। এটা সত্য আমাদের কাঁচামাল এবং প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়াল বেশির ভাগই আমদানিনির্ভর। এখন যেটা বলছেন এপিআই শিল্প পার্ক চালু হলে স্থানীয় কাঁচামালের জোগান বাড়বে। হ্যাঁ কিছুটা তো বাড়বেই; কিন্তু সাবজেক্ট হলো ১৯৯৭/৯৮ সাল থেকে এপিআই পার্ক চালুর কথা হলেও এখন পর্যন্ত কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। আর একটা কথা এপিআই তৈরি করতে হলে আমার এপিআই পার্কই লাগবে এমন কোনো কথা নেই। এপিআই পার্ক চালু করলে কিছু সুবিধা তো হবেই। কেন্দ্রীয় একটা ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো, সরকারি সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদি ক্ষেত্রে; কিন্তু এখনো যারা বাংলাদেশের বাজারে এপিআই তৈরি করছেন, তারা কিন্তু এপিআই পার্ক ছাড়াই তৈরি করছেন। হয়তো পার্ক তৈরি হলে কাজগুলো আরও ত্বরান্বিত, উন্নত এবং আরও দ্রুত হবে। অন্যদিকে বলব যে বাংলাদেশে এপিআই তৈরি করার ক্ষেত্রে ভলিউম একটা ফ্যাক্টর। কারণ একটি এপিআই ইউনিটের প্রোডাকশন ক্যাপাসিটি অনেক থাকে। সেটা শুধু বাংলাদেশের মার্কেটকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলে সেটাকে ফিজিব্যল করা অত্যন্ত কঠিন। বাংলাদেশে তৈরি করে আমরা যদি বাইরে এক্সপোর্ট করতে না পারি, তাহলে প্রতিষ্ঠানগুলো প্র্যাক্টিক্যাল ফিজিব্যল করা কঠিন হবে। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে ওষুধ এমন একটি জীবন রক্ষাকারী উপাদান সেখানে কাঁচামালের ক্ষেত্রে কোনোরকম জোর করা কিংবা অযৌক্তিক বিধিনিষেধ আরোপ করা ঠিক হবে না। বরং বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থে আমদানির প্রক্রিয়াটাও খোলা রাখতে হবে। আমি মনে করি যারা এপিআই বানাবেন তারা সরকারের কাছে থেকে বিশেষ উৎসাহ এবং প্রণোদনা পাবেন। সেটাকে কাজে লাগিয়ে আরা আরও উন্নতমানের এপিআই তৈরি করতে পারবে। তবে এই বিষয়ে অযৌক্তিক বিধিনিষেধ আরোপ করাটা ঠিক হবে না।
দেশের জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ তরুণ। তাদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী?
তরুণদের প্রতি আমার কোনো পরামর্শ নেই; কিন্তু আমরা যারা তরুণ সমাজকে পরিচালনার দায়িত্বে আছি, তাদের কাছে বলতে চাই, তরুণ প্রজন্মের দুটি জিনিস ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এক. পড়াশোনা, দুই. মূল্যবোধ। তাদের পড়াশোনার কাজটা সঠিকভাবে করার জন্য কঠোর হতে হবে। শিক্ষার গুণগত মানের উন্নয়নের পাশাপাশি কঠোর হস্তে বাস্তবায়ন করতে হবে। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ডিসিপ্লিন আনতে হবে। সবখানে নজর দিতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে পড়ালেখায় ফেরাতে হবে। এক্ষেত্রে আপামর জনগণ সমর্থন করবে।
আরেকটা বিষয় মূল্যবোধ। আমরা দেখছি বর্তমানে কেউ নৈতিক মূল্যবোধের দিকে নজর দিচ্ছি না। এটাকে পারিবারিক বা সামাজিক দায়িত্ববোধের জায়গায় কেউ মূল্যায়ন করছি না। এটা ভয়াবহতার দিকে চলে যাচ্ছে। এই জায়গায় আমি শঙ্কিত। এ জন্য সমাজবিজ্ঞানী, রাজনীতিক তথা আমরা যারা তরুণ সমাজকে গড়ে তোলার দায়িত্বে আছি, তাদের দ্রুত সমাধানের দিকে যাওয়া উচিত। মূল্যবোধের ক্ষেত্রে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সমাজ সবার ক্ষেত্রেই যৌথ উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে আমরা কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে দায়বদ্ধ থাকব।
সময়মতো ব্যাংক ঋণের অভাবে শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিস্তারে প্রতিবন্ধকতা তৈরির অভিযোগ করেন অনেক উদ্যোক্তা। এ প্রসঙ্গে আপনার অভিমত কী?
আমি এই অভিযোগটিকে ঠিক বলে মনে করি না। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো এবং যৌক্তিক বিনিয়োগ প্রস্তাবে বেশ সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ করে। একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কিছু নিয়মকানুন থাকে। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোরও কিছু নিয়মনীতি রয়েছে। তাদেরও কিছু বিচার বিবেচনা করতে হয় কোথায় বিনিয়োগ করবেন, কোথায় করবেন না। সেই বিবেচনার পেছনে কোনো যৌক্তিক প্রস্তাব থাকলে তারা ঋণ দিতে অনীহা প্রকাশ করে বলে আমি দেখি না। তাদের আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়গুলোও বিবেচনা করতে হয়। বরং ব্যাংক সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব নিয়েই ব্যবসায়ী এবং শিল্প উদ্যোক্তাদের সঙ্গে তাদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক রক্ষা করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের পুঁজিবাজার দিন দিন বড় হচ্ছে। ভবিষ্যতে আপনার প্রতিষ্ঠানের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কি?
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার ইচ্ছা এবং বিবেচনা আমাদের রয়েছে। তবে সে উদ্যোগটি আমরা সময় এবং প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে নিব। একটা সার্টেন পর্যায়ে গেলে আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে পুঁজিবাজারে অংশ নেওয়ার।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ দেদার বিক্রির অভিযোগ পাওয়া যায়। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যত্রতত্র নিম্নমানের ওষুধ বিক্রি হচ্ছে এমন ঢালাও অভিযোগ করাটা সঠিক না বলে আমি মনে করি। যারা অভিযোগটি করেন তারা বিষয়টি না বুঝে ঢালাওভাবে বলেন। ওষুধের নিম্নমান নিয়ে যতটা প্রচারণা, আমার মনে হয় বাস্তবে অতটা নয়। নিম্নমানের চেয়েও বড় সমস্যা অনিবন্ধিত ও চোরায় পথে আসা ওষুধ। নিম্নমানটা হলো আমাদের রেজিস্টার্ড ওষুধ যখন যে মানের দেওয়া উচিত তখন তার চেয়ে কম মানের দেওয়া। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সমস্যাটা হলো, অনেক আনরেজিস্টার্ড ওষুধ বিক্রি হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে কনজিউমার প্রোডাক্ট হিসেবে ওষুধ বিক্রি হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতিকর উপাদানসহ তথাকথিত কিছু ওষুধ চোরাই পথে আনা হচ্ছে। এই দুটি জিনিসকে আলাদা করতে হবে। নিম্নমান ওষুধ হয়তো আছে, অবশ্যই এটা বন্ধ করতে হবে; কিন্তু সেটা অত প্রকট নয়। যতটা এই চোরা কারবারে আসা ওষুধ, বিভিন্ন ক্ষতিকর উপাদান মিশ্রিত জিনিস- যেগুলোকে ওষুধ বলে চালানো হয়, এগুলো আরও বেশি ক্ষতিকর। যেগুলো সুতরাং আমাদের এই বেআইনি বিষয়গুলোতে নজর দিতে হবে।
বিশেষায়িত ওষুধের মূল্য সাধারণের নাগালের বাইরে- এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?
দুঃখজনকভাবে হলেও সত্য বিশেষায়িত ওষুধ সাধারণের নাগালের বাইরে রয়েছে। আসলে এটা বাইরেই থাকে, এটাই বাস্তবতা। যদিও বিষয়টি দুঃখজনক। বিশেষায়িত ওষুধ আমদানি কিংবা তৈরি সবক্ষেত্রেই দামের দিক থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে কম দামে বাংলাদেশে পাওয়া যায়; কিন্তু তারপরও সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে থাকছে। বাংলাদেশের সমস্যা আসলে অন্য জায়গায়। বিশ্বের উন্নত বা অন্যান্য দেশে ওষুধ বা চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যয় সাধারণ জনগণের পকেট থেকে করতে হয় না। সরকার বা ইন্স্যুরেন্স থেকে যায়। এই সমস্যার সমাধান হলো সরকারি বরাদ্দ বাড়ানো ও বেসরকারি খাতে স্বাস্থ্য খাতের ইন্স্যুরেন্স ব্যবস্থা চালু করা। যে সমস্ত দেশে এসব দামি ওষুধ বেশি দামে কিনতে হয়, তা কিন্তু জনগণের পকেট থেকে কিনতে হয় না; কিন্তু আমাদের দেশের মানুষের আয় কম; কিন্তু তারপরও শুধু বিশেষায়িত ওষুধ নয়, বরং যে কোনো ওষুধ নিজেদেরই কিনতে হচ্ছে। এই বিষয়টির একটা সুরাহা হওয়া দরকার। এই বিষয়ে আশা করি সরকার পদক্ষেপ নেবে।
শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার চেয়ে সেবা খাতে বিনিয়োগ করার প্রবণতা ব্যবসায়ীদের কেন?
এই বিষয়টি সত্য। দেখুন একজন বিনিয়োগকারী কিন্তু সেখানেই বিনিয়োগ করবে, যেখানে তার লাভ যত বেশি। দেখা যাচ্ছে, গত ১৫-২০ বছরে আমাদের সেবা খাতে তুলনামূলক বিনিয়োগ কম লাগে কিন্তু লাভটা অনেক বেশি। অপরদিকে শিল্প-কারখানা তৈরির ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করতে হয়; কিন্তু ফিডব্যাক বা লাভ আসতে দেরি হয়, বেশি ধৈর্য্য ধরতে হয়। একইসঙ্গে শিল্প উদ্যোগে নানা সমস্যা বা জটিলতাও কিন্তু রয়েছে। তাই উদ্যোক্তাদের মধ্যে সেবা খাতে বিনিয়োগ করার প্রবণতা হয়তো বাড়ছে। তবে উৎপাদন খাতে যে বিনিয়োগ একেবারেই হচ্ছে না, তা কিন্তু নয়। এখনো রেশিওটা দেখা যাবে উৎপাদন খাতেই বেশি বিনিয়োগ। দিন শেষে শিল্প খাতের বিনিয়োগটাই আমাদের জিডিপি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কাজে লাগে। তাই আমার মনে হয় সেবা খাতের তুলনায় শিল্প কারখানায় বিনিয়োগের দিকে আমাদের নজর দিতে হবে।
শিল্প খাতে উদ্যোগ বাড়ানোর জন্য আমাদের কী করতে হবে?
শিল্প খাতে উদ্যোগ বাড়ানোর জন্য কয়েকটা কাজ করতে হবে। একজন উদ্যোক্তা দেখেন তার লাভ কেমন হচ্ছে। সেটা দেখতে গেলে দেশের, প্রতিবেশীদের ও আন্তর্জাতিক বাজার এই তিন ধাপের কথা আমাদের চিন্তা করতে হবে। এই তিন ধাপে দেশের বাজারের দিকটি হয়তো একজন উদ্যোক্তা নিজেই তৈরি করতে পারেন; কিন্তু রফতানিতে যেতে হলে, সেটা আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক যে ক্ষেত্রেই হোক- সরকারকে অবশ্যই একটি সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করতে হবে। আমার মনে হয় এখানে আরও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ আসা দরকার। দ্বিতীয়ত, শিল্প উৎপাদনের ক্ষেত্রে একজন উদ্যোক্তাকে প্রতিনিয়ত অহেতুক কিছু ঝামেলা পোহাতে হয়। যেগুলোর প্রতিকার চেয়েও সহসা সমাধান পাওয়া যায় না। একজন উদ্যোক্তা যতদূর সম্ভব একজন সুনাগরিকের মতোই নিয়মমাফিক চলতে চান; কিন্তু তাঁকে যখন অহেতুক নানা বিড়ম্বনার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তখন তাঁর মধ্যে তো এক ধরনের হতাশা কাজ করতেই পারে। সাফল্যের গল্পের মতো ব্যর্থতার গল্পও কিন্তু সংক্রামক। তাই একজন উদ্যোক্তার বিড়ম্বনার গল্প যেমন অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে যায়, তেমনি একজন উদ্যোক্তা কোথাও প্রেরণা বা প্রণোদনা পেলে সেই গল্পও কিন্তু পাঁচজনের মধ্যে অনুপ্রেরণার জন্ম দেয়। এই বিষয়ে আমাদের ব্যবসায়ী এবং সরকার উভয় মহলেরই আরেকটু সচেতন হওয়া দরকার।
(সাক্ষাৎকারটি প্রথম সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল এর ৯ম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যায় প্রকাশিত)