সব ধরনের অবৈধ পদায়ন ও পদোন্নতি বাতিল, অ্যাডহকদের অবৈধ এনক্যাডারমেন্ট বাতিল, অ্যাডহকদের অ্যাডহক চাকরিতে অবৈধ স্হায়ীকরণ বাতিল করতে এবং এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তদন্তসাপেক্ষে বিধিমোতাবেক কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা। আজ বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) দুপুরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক অবস্থান কর্মসূচিতে তাঁরা এই দাবি তুলেছেন। বিসিএস হেলথ ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যসচিব উম্মে তানিয়া নাসরিন এ লিখিত বক্তব্য সংবাদ বিজ্ঞপ্তি আকারে সংবাদমাধ্যমে পাঠান।
লিখিত বক্তব্যে কর্মকর্তারা বলেন, আমরা স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা বাংলাদেশের বিদ্যমান আইন-বিধির প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। দেশের প্রত্যন্ত ইউনিয়ন থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র পর্যন্ত পদায়ন হওয়া এই ক্যাডারের প্রায় ৩৫ হাজার কর্মকর্তা দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার মূল মেরুদণ্ড। ক্যাডার সার্ভিস গঠিত হওয়ার পর থেকে প্রায় ৪০ বছর ধরে আমরা দেশের মানুষকে নিরবচ্ছিন্নভাবে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে আসছি এবং শত সীমাবদ্ধতা, বৈষম্য ও অপ্রাপ্তি সত্ত্বেও আমরা দেশের জনগণকে সেবা দিতে কখনো পিছপা হইনি। কিছু বছর ধরে আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে সরকারি চাকরিবিধির গুরুতর লঙ্ঘন ঘটিয়ে ক্যাডার পদগুলো ভিন্ন নিয়োগবিধির আওতায় নিয়োগপ্রাপ্ত অ্যাডহক ও প্রকল্প কর্মকর্তাদের পদায়ন ও পদোন্নতি দেওয়া শুরু করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কিছু দুষ্কৃতকারী কর্মকর্তা। চাকরিবিধির গুরুতর লঙ্ঘন হওয়ায় আমরা লিখিতভাবে আমাদের আপত্তি জানিয়ে প্রক্রিয়াগতভাবে এগোতে থাকি; কিন্তু ওই শাখাগুলোর কর্মকর্তাদের অনিয়ম করা থেকে থামানো যায়নি; বরঞ্চ এই অন্যায়ের মাত্রা ক্রমে বাড়তে থাকে। অদ্যাবধি সহস্রাধিক অবৈধ পদোন্নতি, জনপ্রশাসনের নির্দেশনা অমান্য করে পাঁচ শতাধিক অবৈধ পদায়ন, ক্যাডার কর্মকর্তাকে অ্যাডহকদের অধীন করা ইত্যাদি চরম আকার ধারণ করে। এর ফলে আমরা মহামান্য সুপ্রিম কোর্টে ২০২২ সালে মামলা দাখিল করতেও বাধ্য হই। মামলায় রুল জারি করা থাকলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের ওই চিহ্নিত অনিয়মকারী শাখার কর্মকর্তারা অ্যাডহক ও প্রকল্প কর্মকর্তাদের পক্ষে অবৈধ ও বিধিবহির্ভূত পদোন্নতি আদেশ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পদায়ন শাখায় পুনরায় অবৈধ পদায়ন আদেশ জারি করে।
কর্মকর্তারা বলেন, ‘এসব অনিয়মের মধ্যোই বিগত ২০২৩ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পরপর পাঠানো মোট তিনটি পত্র আমাদের দৃষ্টিগোচর হওয়ায় আমরা হতবাক ও বাক্রুদ্ধ হয়ে যাই। অসংখ্য মিথ্যা তথ্য, তথ্য গোপন ও ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পার-২ শাখার তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অ্যাডহক ও প্রকল্প তথা ২০২২ সালে এনক্যাডার হওয়া কর্মকর্তাদের পক্ষে চাকরিতে পদোন্নতির জন্য সব ধরনের পরীক্ষা ও প্রশিক্ষণ মওকুফ করে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে পত্র পাঠায় এবং ওই পত্রগুলোতেই তাঁদের এর আগে দেওয়া বিতর্কিত পদোন্নতিগুলোকে অবৈধ বলে স্বীকার করে নেয়। মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব পত্রে তাদেরই করা অনিয়মগুলো স্বীকার করে নেওয়া নজিরবিহীন। সেখানে বলা হয়, যদি অ্যাডহক এনক্যাডার কর্মকর্তাদের চাকরিতে স্থায়ীকরণের জন্য ক্যাডারের বনিয়াদি প্রশিক্ষণ, বিভাগীয় পরীক্ষা ইত্যাদি প্রমার্জনা না দেওয়া হয়, ওই প্রমার্জনার পরে আবার তাঁদের পদোন্নতিতে পদোন্নতি পরীক্ষা থেকে প্রমার্জনা না দেওয়া হয়, তাহলে ইতোপূর্বে প্রদেয় সব পদোন্নতি প্রশ্নের সম্মুখীন হবে।’
কর্মকর্তারা বলেন, ‘২০২৩ সালে প্রথম দুইবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় অসম্মতি জানিয়ে প্রত্যুত্তর দিলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তৃতীয়বারের অনুরোধে তারা বিসিএস নিয়োগবিধি সংশোধনের প্রস্তাবটি সচিব কমিটিতে প্রেরণ করে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে প্রস্তুতকৃত উক্ত সংশোধনী প্রস্তাবে এনক্যাডার হওয়া কর্মকর্তাদের পক্ষে ১. বাধ্যতামূলক বিভাগীয় পরীক্ষা; ২. বনিয়াদি প্রশিক্ষণ; ৩. ক্যাডারে বাধ্যতামূলক দুই বছর শিক্ষানবিশকাল থেকে প্রমার্জনা; ৪. ক্যাডারের দুই বছরের সন্তোষজনক চাকরিকাল, এসব প্রমার্জনার পরে পুনরায় তাঁদের পদোন্নতিতে সিনিয়র স্কেল থেকে প্রমার্জনার অনুরোধ জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বরাবর পত্র পাঠানো হয়। আমরা বাক্রুদ্ধ। আমরা জানতাম, চাকরিতে অনিয়মকারীকে শাস্তি দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা নিজেই দোষ স্বীকার করে উল্টো অতীতের অনিয়মের প্রমার্জনা চাচ্ছেন! এটা কেমন আবদার? যেকোনো ধরনের সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য এভাবে এতগুলো প্রমার্জনার ফাইল সৃষ্টি হওয়া নজীরবিহীন এবং এ ধরনের ন্যক্কারজনক অনিয়মের ঘটনা বাংলাদেশের প্রশাসন জগতের ইতিহাসে এই প্রথম। উল্লেখ থাকে যে ওই কর্মকর্তাদের সবাই বিসিএসে ফেল করেছিলেন, যার প্রমাণ আমাদের হাতে বিদ্যমান।
একদল চাকরীজীবী যাঁরা তাঁদেরই নিয়োগবিধির শর্ত পরীক্ষা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ না করেই স্থায়ী হয়েছিলেন, যাঁরা তাঁদের সমগ্র চাকরিজীবনে কখনো কোনো পরীক্ষা বা প্রশিক্ষণ নেননি, যাঁরা বিসিএসে অকৃতকার্য হয়েও এনক্যাডার হয়েছেন, এনক্যাডারের পরে পুনরায় বিসিএস ক্যাডারের পাঁচটি শর্ত থেকে কেন মওকুফ পাবেন এবং বিসিএস পাসকৃতদের চেয়ে ওপরে স্থান পাবেন, তা আমাদের বোধগম্য হচ্ছে না। আপনাদের কাছে আমরা প্রশ্ন রাখলাম। আপনারা নিশচয়ই অবগত আছেন, এর আগেও আমরা সংবাদ সম্মেলনের করে গত ৯ জুলাই ও ৭ সেপ্টেম্বর আপনাদের মাধ্যমে দেশবাসীকে আমাদের সঙ্গে হওয়া সব ধরনের অন্যায় কথা জানিয়েছিলাম।’
কর্মকর্তারা বলেন, ‘কিন্তু আজ আপনাদের মাধ্যমে দেশবাসীকে পুনরায় বিশেষভাবে জানাতে চাই যে ৯ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত PSC কর্তৃক খসড়া প্রজ্ঞাপনে পরিলক্ষিত যে, BCS recruitment rule 1981 এর rule 8 এর sub rule 1 এ তারা clause k এবং clause l সংযোজন করার সিদ্ধান্ত দিয়েছে। কী কারণে তারা এত নতুন করে clause সংযুক্ত করে সরকারি চাকরির বিধি নতুন করে তৈরি করে তাঁদেরকে আরও অবৈধ সুবিধা দিতে চাচ্ছে, তা আমাদের বোধগম্য নয়।
এসব কারণে ৩৫ হাজার ক্যাডার কর্মকর্তা ক্ষুব্ধ। আমরা বিগত সরকারের মাননীয় মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও সরকারি কর্মকমিশনসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সব অনিয়ম লিপিবদ্ধ করে জমা দিয়েছি, যার প্রাপ্তিস্বীকার পত্র আমাদের কাছে রয়েছে। সব প্রমাণ থাকার পরও প্রশাসনিক উন্নয়ন–সংক্রান্ত সচিব কমিটি ওই প্রমার্জনার ফাইলে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছেন। ফাইলটি জনপ্রশাসন হয়ে কর্মকমিশনে গিয়ে পুনরায় ৩ সেপ্টেম্বর কর্মকমিশনের সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে গেজেটের অপেক্ষারত সরকারি চাকরিবিধি লঙ্ঘনের আরও একটি ইতিহাস সৃষ্টির পথে। এগুলো আমাদের স্বাস্থ্য ক্যাডারের সঙ্গে চরমতম অন্যায়। আমরা সব ক্যাডারকে আমাদের সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি। ক্যাডারকে অ্যাডহক (নব এনক্যাডার) কর্মকর্তাদের অধীন করার রেওয়াজ কোনো আইন ও বিধিতেই সমর্থন করে না, শতভাগ অবৈধ।’
ছয়টি দাবি হলো—
১. গত ৩.৯.২৪ তারিখে পিএসসির সুপারিশকৃত প্রজ্ঞাপন বাতিল করতে হবে;
২. সকল প্রকার অবৈধ পদায়ন বাতিল করতে হবে;
৩. সকল প্রকার অবৈধ পদোন্নতি বাতিল করতে হবে;
৪. অ্যাডহকদের অবৈধ এনক্যাডারমেন্ট বাতিল করতে হবে;
৫. অ্যাডহকদের অ্যাডহক চাকরিতে অবৈধ স্হায়ীকরণ বাতিল করতে হবে;
৬. এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তদন্তসাপেক্ষে বিধিমোতাবেক কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।