Connect with us

স্বাস্থ্য সংবাদ

বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতির খোঁজে

আবু আহমেদআমাদের বাড়ীর দক্ষিণ দিকে এক গ্রাম পর ছিল জিতেন্দ্র বাবুদের বাড়ী। তখন আমাদের কোন অসুখ-বিসুখ হলে আমরা প্রথমে তার কাছে দৌড়াতাম। তিনি ছিলেন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। তার ওষুধে কাজ না হলে আমরা পূর্বদিকের পালবাড়ির কবিরাজদের কাছে দৌড়াতাম। তবে মানুষের কাছে হোমিও চিকিৎসা ও কবিরাজী চিকিৎসার গুণগত মানের বিষয়টি তেমন গুরুত্বপূর্ণ তখনও ছিল না। যারা ধনী […]

Published

on

আবু আহমেদ
আমাদের বাড়ীর দক্ষিণ দিকে এক গ্রাম পর ছিল জিতেন্দ্র বাবুদের বাড়ী। তখন আমাদের কোন অসুখ-বিসুখ হলে আমরা প্রথমে তার কাছে দৌড়াতাম। তিনি ছিলেন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। তার ওষুধে কাজ না হলে আমরা পূর্বদিকের পালবাড়ির কবিরাজদের কাছে দৌড়াতাম। তবে মানুষের কাছে হোমিও চিকিৎসা ও কবিরাজী চিকিৎসার গুণগত মানের বিষয়টি তেমন গুরুত্বপূর্ণ তখনও ছিল না। যারা ধনী লোক ছিলেন, তখনও তারা শহরের এমবি ডাক্তারের কাছে দৌড়াতেন। কিন্তু ঘরের কাছে চিকিৎসা বলতে জিতেন্দ্র বাবুর মতো হোমিওপ্যাথিক এবং পালবাড়ির কবিরাজদেরই বোঝাত। জিতেন্দ্র বাবু অবশ্য ষাটের দশকের প্রথমদিকে ভারত চলে যান। কিন্তু তার সেবার আন্তরিকতাকে আমরা কোনদিন ভুলিনি। হোমিওপ্যাথ ডাক্তার হন আর কবিরাজ হন, আগে কখনও পয়সা চাইতেন না। জিতেন্দ্র বাবু ওষুধ দিতেন ছোট্ট একটা কাচের শিশিতে, যার গায়ে কাগজ দ্বারা খাওয়ার ইউনিটগুলো নির্দেশিত থাকত। আর পালদের ওষুধ বলতে বড় বোতলে নানা ধরনের সালসা বোঝাত। কিছু বড়িও তারা দিতেন।

আমাদের বাড়ীর কাছে অপর আয়ুর্বেদ চিকিৎসক শশী কুমার পাল বড়ির সঙ্গে তুলসী পাতার রস মিশিয়ে খেতে বলতেন। পরে বুঝলাম, বড়ির গুণাগুণ থাক বা না থাক, তুলসী পাতার রসের গুণাগুণ অবশ্য ছিল। সেকালে অসুখের মধ্যে সাধারণ অসুখ ছিল গায়ে জ্বর আসা। অবশ্য জ্বর এখনও কমন অসুখ। এখন লোকে কমপক্ষে এমবিবিএস ডাক্তারের কাছ থেকে অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রাইব করে এনে ক্যাপসুল-ট্যাবলেট খেয়ে জ্বর ভালো করার চেষ্টা করেন। এখন অবশ্য কোন্ অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করবে, সেটা ডাক্তার সাহেব কিছু পরীক্ষা দিয়ে বুঝতে পারেন। তখন রক্তের ইএসআর বা কালচার পরীক্ষা করানোর উপায় ছিল না। হোমিও বা আয়ুর্বেদ ওষুধ জ্বর সহজে ভালো করতে পারত না। তাই অনেকেই সপ্তাহ বা আরও বেশী সময় জ্বরে ভুগে শেষ পর্যন্ত দূরের দাতব্য চিকিৎসালয়ের এলএমএফ ডাক্তারের কাছে দৌড়াতেন। দাতব্য চিকিৎসালয়গুলো ষাটের দশকের আগে অথবা একটু পরে গ্রামাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয় সরকারী উদ্যোগে। ওষুধ ছিল সামান্য, ডাক্তার ছিলেন এলএমএফ পাস, যা বর্তমানের এমবিবিএস কোর্সের অতি সংক্ষেপিত একটা পাঠ্যক্রম। এলএমএফ ডাক্তারের চিকিৎসা পেলে অনেকে ধন্য হতেন। দাতব্য চিকিৎসালয়গুলোতে একজন প্রশিক্ষিত কম্পাউন্ডারও থাকতেন। তার কাজ ছিল ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী রোগীর জন্য ওষুধ তৈরি করে দেয়া। কম্পাউন্ডার কর্তৃক প্রস্তুতকৃত সেই ওষুধের অনেক গুণ ছিল। আজ কেউ কম্পাউন্ডারের কথা শুনলে বলবে, ওটা আবার কী জিনিস! যা হোক, অভিজ্ঞতা থেকে কম্পাউন্ডার ওষুধ সম্পর্কে অনেক কিছু জানতেন।

এখন সেই দাতব্য চিকিৎসালয়গুলোর কোন কোনটি হাসপাতাল হয়ে গেছে এবং ডজনখানেক এমবিবিএস বা পুরনো কালের এমবি ডাক্তার সেসব স্থানে পোস্টিং আছেন। আমাদের শিশুকালে জ্বরের ক্ষেত্রে একটা হারবাল উপাদান আমরা সবাই ব্যবহার করতাম। সেই হারবাল উপাদানটি ছিল চিরতার লতা। চিরতার লতা ভিজিয়ে আমিও অনেক রস খেয়েছি। এর স্বাদ ছিল অতি তেঁতো। লোকে বলত, তেঁতোর মধ্যে অনেক উপকার আছে। আমারও পরে বিশ্বাস জন্মেছে, তেঁতো রসের মধ্যে অনেক উপকার আছে। তবে জ্বরকে চটজলদি ভালো করার জন্য আমরা দূরের এলএমএফ ডাক্তারের কাছ থেকে ‘কুইনাইন’ এনে খেতাম। কুনাইন তখন ম্যাজিক ওষুধ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল।

আজকাল কথিত মডার্ন ওষুধের অনেক উন্নতি হয়েছে। রোগব্যাধি যেমন বেড়েছে, তেমন বেড়েছে ওষুধও। এখন একজন চিকিৎসক সব রোগের চিকিৎসা করেন না, তাকে হতে হয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। ডাক্তার বেড়েছে, হাসপাতাল বেড়েছে। তবে ওষুধের অপপ্রয়োগও বেড়েছে। অনেকে শুধু কথিত মডার্ন অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ খেয়ে রোগ আরও বাড়িয়েছেন। ফলে রোগীরা এখন হন্যে হয়ে বিকল্প ওষুধের খোঁজ করছেন। বিকল্প ওষুধের পাশাপাশি বিকল্প ডাক্তারও খুঁজতে গিয়ে তারা আবার সেই পুরনো দিনের হোমিওপ্যাথিক ও কবিরাজী তথা হারবাল ওষুধের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। মানুষের বদ্ধমূল ধারণা, হোমিওপ্যাথিক ও হারবাল ওষুধ অন্তত শরীরের ক্ষতি করে না। রোগীরা চিন্তিত থাকেন যে, তারা অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ খেয়ে চিরদিনের জন্য নিজেদের শরীরের ক্ষতি করছেন। আজ যখন দেখি, অনেক হোমিওপ্যাথ ডাক্তারের চেম্বার রোগী দ্বারা ভর্তি, তখন ভাবি তারা উপকার না পেলে কি এসব ডাক্তারের কাছে আসতেন? এসব রোগীর ইতিহাস নিলে জানা যাবে তাদের অনেকেই অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের অপপ্রয়োগ বা অতি প্রয়োগের শিকার হয়েছেন। অনেকে হারবাল ওষুধ খেতে বেশী পছন্দ করেন। কারণ একটাই, সেই বিশ্বাস হার্ব উপাদান অন্তত শরীরের ক্ষতি করবে না।

ইউরোপের লোকেরাও বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতির দিকে ঝুঁকছে। তাদেরও বিরক্তি এসে গেছে আধুনিক অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের ওপর। তবে অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, অ্যালোপ্যাথিক পদ্ধতি ‘নাম্বার ওয়ান’ পদ্ধতি হিসেবে সারা বিশ্বেই রয়ে যাবে। পাশাপাশি চলবে হারবাল ও হোমিও। সব রোগ সব পদ্ধতি ভালো করতে পারবে বলে মনে হয় না। লোকে অর্থ ব্যয় করতে রাজি আছে বটে, তবে তারা নিরাপদ ওষুধ চায় এবং সেই সঙ্গে চায় নিরাপদ ডাক্তারও। আমাদের দেশে অনেক হাসপাতাল হয়েছে। কিন্তু হাসপাতালগুলোর ম্যানেজমেন্ট অতটা মডার্ন নয়। যৎসামান্য এমআরসিপি বা সমমানের ডিগ্রির অধিকারী ডাক্তারদের নিয়ে রীতিমতো টানাটানি হচ্ছে। আমাদের রোগীরাও দেখেন, কোন ডাক্তার কোথায় লেখাপড়া করেছেন। তবে অনেক মেডিকেল ডিগ্রি সম্পর্কে রোগীদের ধারণা মোটেই স্বচ্ছ নয়। অনেক ডাক্তার শুধু ট্রেনিংকে ডিগ্রির মতো করে লিখে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেন। বাংলাদেশেও কয়েকটি ওষুধ কোম্পানী হারবাল ওষুধ তৈরি করছে। তবে এক্ষেত্রে ডাক্তারের সংকট আছে।

Advertisement

অধ্যাপক আবু আহমেদ : শিক্ষক ও অর্থনীতিবিদ

Continue Reading
Advertisement