নতুন বছর শুরুর আগেরদিন চীনে নতুন এক প্রাণঘাতী ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে। ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ হুবেই প্রদেশের উহানে সংক্রমিত নোভেল করোনা ভাইরাস-২০১৯ চিহ্নিত হয়। এই ভাইরাস নিয়ে বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন বিষয় জানার জন্য ছুটছেন।
এ দিকে করোনা ভাইরাসে ইতোমধ্যে ২৫৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ১১ হাজারের বেশি মানুষ। করোনা ভাইরাসের সঙ্গে ২০০২-০৩ সালে ছড়ানো মহামারী সার্স ভাইরাসের অনেক মিল রয়েছে। সে সময় সার্স ভাইরাসে ৩৭টি দেশের ৭৭৪ জন লোক আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বর্তমানে ছড়ানো নোভেল করোনা ভাইরাসও বিশ্বের প্রায় সব দেশকেই আতঙ্কিত করে তুলেছে।
চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ করোনা ভাইরাসের প্রকোপের ইতি টানার জন্য ব্যাপক গবেষণা ও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নোভেল করোনা ভাইরাস সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে বিজ্ঞানীরা ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন। যে প্রশ্নগুলোর উত্তর জানলে ভাইরাস মোকাবিলা করা অনেক সহজ হবে।
নোভেল করোনা ভাইরাস কীভাবে ছড়ায়?
কোনো রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটলে এই প্রশ্নটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। ২১ জানুয়ারি চীন প্রথম নিশ্চিত করে যে করোনা ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে ছড়াচ্ছে। তবে মানুষ প্রথম আক্রান্ত হয় বাদুড় থেকে। আবার কখনো বলা হয় সাপ থেকে। কিন্তু বলা হয়ে থাকে সাপ মূলত বাদুড় থেকেই করোনা ভাইরাস পায়।
কোনো লক্ষণ ছাড়াই কী আক্রান্ত রোগী ভাইরাস ছড়াচ্ছে?
নোভেল করোনা ভাইরাস সম্পর্কে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কিন্তু এর উত্তর যথাযথভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। আসলেই লক্ষণ প্রকাশ করা ছাড়াই কিংবা কতটা ব্যাপকভাবে এই ভাইরাস ছড়াচ্ছে তা এখনো অজানাই আছে।
শেনজেন শহরে একটি শিশু নোভেল করোনা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল। সেই শিশুর মাঝে কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায়নি। যদি রোগের লক্ষণ প্রকাশ না পায় কিন্তু রোগী সংক্রমিত হয় তবে বিপদ আরও ভয়াবহ হতে পারে। এই ভয়াবহতা বাড়বে যদি সংক্রমিত রোগীতে লক্ষণ প্রকাশ না পেলেও তার থেকে অন্যরা সংক্রমিত হয়। তবে এই লক্ষণ প্রকাশ না করেই সংক্রমিত হওয়া রোগীর সংখ্যা যদি কম থাকে ভয়াবহতাও কম হবে। সার্স ভাইরাসের ক্ষেত্রে এই ধরনের রোগীর সংখ্যা খুবই কম ছিল।
ভাইরাস কতটা প্রাণঘাতী?
নোভেল করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে রোগী মারাত্মকভাবে ফুসফুসের প্রদাহজনিত সমস্যা তথা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়। গবেষকরা এ কারণেই এটিকে ক্ষতিকর ভাইরাস হিসেবেই দেখছেন। তবে এটি এখনো সার্স ভাইরাসের মতো মারাত্মক পর্যায়ে যায়নি। সার্স ভাইরাসে মৃত্যুহার শতকরা ১০ ভাগের মতো হয়েছিল। হয়তো দ্রুত করোনা ভাইরাস নিয়ে কাজ করায় ক্ষতির মাত্রা কিছুটা কমের ভেতর রয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন।
ভাইরাস কোথা থেকে এসেছে?
চীন কর্তৃপক্ষ ধারণা করছে অজ্ঞাত এক বা একাধিক প্রাণী থেকে এই ভাইরাসের উৎপত্তি হয়েছে। এজন্য তারা উহানের স্থানীয় সিফুড মার্কেট বন্ধ করে দিয়েছে। যদি উৎস হিসেবে প্রাণী শনাক্ত হয় তবে এই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করাও সহজ হবে।
জিনগত অনুক্রম বের করার পর জানা যায় ভাইরাসটি বাদুড় থেকে ছড়াচ্ছে। আর এই নোভেল করোনা ভাইরাস ৮০ ভাগ সার্স ভাইরাসের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।
গত সপ্তাহে একদল গবেষক ভাইরাসটির জিনগত অনুক্রম গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার পর জানিয়েছিলেন এটি সাপের মাধ্যমে ছড়িয়েছে। কিন্তু অনেক গবেষক এটি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, স্তন্যপায়ী প্রাণী ও পাখি থেকে এই ভাইরাস ছড়ানোর সম্ভাবনাই বেশি।
ভাইরাসের জিনগত অনুক্রম থেকে কী শিখতে পারি?
করোনা ভাইরাসের জিনগত অনুক্রম বের করলে এটির উৎপত্তি ও ছড়ানোর উপায় জানা সহজ হয়।গবেষকরা মূলত খোঁজার চেষ্টা করছেন কী ধরনের জিনগত অনুক্রম পরিবর্তিত হওয়ায় এই ভাইরাস প্রাণী থেকে মানুষে রোগ বিস্তার করছে। আবার যদি ব্যাপকভাবে মানুষ থেকে মানুষে এই ভাইরাস ছড়াতে থাকে তবে মানুষেও এরা জিনগত পরিবর্তন ঘটাতে পারে। তখন আরও ব্যাপকভাবে এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। তবে এই ধারণাগুলো এখনো ততটা গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে নিচ্ছেন না অনেক গবেষকই।
চিকিত্সার জন্য কী কোনো ওষুধ তৈরি করা যাবে?
সার্স ভাইরাসসহ অন্যান্য করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে কোনো ওষুধই কাজ করে না। এছাড়াও কোনো টিকাও ফলপ্রসূভাবে প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্মায় বলে জানা যায় না।
মানুষের কোষের যে অংশ রিসেপটর অর্থাৎ করোনা ভাইরাসকে গ্রহণ করে চীনের একদল গবেষক সেই অংশকে বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। এ দিক ভেবে তারা ওষুধ তৈরির চেষ্টা করছেন। ইতোমধ্যে তারা কিছুটা সফলতাও পেয়েছেন। এছাড়াও কিছু কিছু গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, এইচআইভি ভাইরাসের জন্য ব্যবহৃত ওষুধ করোনা ভাইরাসের জন্যও ব্যবহার করছেন।
বনজঙ্গল উজাড়, বন্য জীবজন্তুকে খাদ্য তালিকায় রাখা, বনের আশপাশে বসবাস ইত্যাদি নানাবিধ কারণে মারাত্মক রোগের ঝুঁকি থাকে। আমাদের দেশে অতিথি পাখি শিকারও এক ধরনের বিপজ্জনক কাজ। এতে বার্ড ফ্লুর মতো ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে।
সুতরাং খাদ্যের জন্য সভ্য সমাজের মানুষদের বন্য জীবজন্তু ও পাখির ওপর নির্ভর না করে খামার দিয়ে নিরাপদ পশুপাখি উৎপাদনে মনোযোগী হওয়া উচিত।