Connect with us

প্রধান খবর

ফ্রিজের মাংসেও ক্ষতিকর জীবাণু, মৃত্যুর তথ্য নেই অধিদপ্তরে

Published

on

উত্তরাঞ্চলীয় জেলা রংপুরের পীরগাছা উপজেলায় আটজনের শরীরে অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু পাওয়ার কথা নিশ্চিত করেছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। ওই এলাকার কিছু বাড়ির ফ্রিজে রাখা গরুর মাংসেও অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু শনাক্ত হয়েছে। এই রোগে আক্রান্ত হয়ে দুইজনের মৃত্যুর খবর ছড়িয়েছে। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, মারা যাওয়া ব্যক্তিরা অন্য রোগে আক্রান্ত ছিলেন। চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অ্যানথ্রাক্সের চিকিৎসা সহজলভ্য এবং এতে মৃত্যুঝুঁকি খুব বেশি নয়। সংক্রমণ ঠেকাতে অসুস্থ পশু জবাই বন্ধের পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা। এমন প্রেক্ষাপটে হঠাৎ করে সারা দেশে বেড়ে গেছে এই রোগের ভ্যাক্সিনের চাহিদা।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট আইইডিসিআরের পরিচালক তাহমিনা শিরীন আমাদের সময়কে বলেন, ১২ জনের মধ্যে আটজনের নমুনা পরীক্ষা করে অ্যানথ্রাক্স জীবাণু পাওয়া গেছে। এদের সবাই গরুর মাংস থেকে আক্রান্ত বলে জানিয়েছেন।

অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়ে দুইজনের মৃত্যুর খবরও ছড়িয়েছে। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক-ডিজি অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর আমাদের সময়কে বলেন, এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা তৎপর রয়েছেন। তবে যে দুইজনের মৃত্যুর খবর এসেছে তাঁরা অ্যানথ্রাক্সে মারা যাননি বলে জেনেছি, তাঁরা অন্য রোগে আক্রান্ত ছিলেন।

দেশের কিছু এলাকায় এর আগেও অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ২০১০ সালে অ্যানথ্রাক্স নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে একটি জাতীয় সমন্বয় কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। এবার এখনও রংপুরের বাইরে অ্যানথ্রাক্স সংক্রমণের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। অ্যানথ্রাক্স আক্রান্তের তথ্য পাওয়ার পর গত এক মাসে অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধে মিঠাপুকুর, পীরগাছা, কাউনিয়া ও রংপুর সদরে ১ লাখ ৬৫ হাজার পশুকে ভ্যাক্সিন প্রয়োগ করা হয়েছে। পাশাপাশি কসাই ও গরু চাষিদের সচেতন করা হচ্ছে বলে স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে।

অ্যানথ্রাক্স গরু, ছাগল, মহিষ- এই ধরনের প্রাণীর মধ্যে দেখা যায়। এসব পশুর মাংস স্পর্শ বা নাড়াচড়া করার মাধ্যমেই এটি মানুষের মধ্যে ছড়ায়। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, যদি কারও চামড়ার মধ্যে ফুসকুরির মতো হয়; সে হাসপাতালে আসবে, হাসপাতালে চিকিৎসা আছে। একদম প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত এই চিকিৎসা আছে। এই রোগে মৃত্যুর আশঙ্কা খুবই কম, যারা মারা গেছেন, তারা হয়তো অন্যান্য রোগে মারা গেছেন।

Advertisement

চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে যেভাবে রান্না করে মাংস খাওয়া হয়, তাতে অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু থাকার আশঙ্কা খুব একটা থাকে না। তবে রান্নার আগে যারা কাঁচা মাংসের সংস্পর্শে যান, তাদের অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

রংপুরে অ্যানথ্রাক্স রোগ শনাক্ত এবং মৃত্যুর খবরে আতঙ্ক ছড়িয়েছে দেশব্যাপী। এর জেরে গরু, ছাগল ও মহিষে ভ্যাকসিন দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। ঢাকার প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক (গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও মূল্যায়ন) ড. মোস্তফা কামাল জানান, রংপুরের ঘটনার পর তাঁদের কাছে হঠাৎ করে একসঙ্গে ২০ লাখ ডোজ অ্যানথ্রাক্স টিকার চাহিদা এসেছে। আগামী ৭ অক্টোবরের মধ্যে এই টিকা সরবরাহ করা যাবে। তিনি বলেন, এই টিকা রংপুর, গাইবান্ধা, বগুড়াসহ আশপাশের জেলায় সরবরাহ করা হবে। এসব জেলার গবাদি পশুতে এই টিকা দেওয়া হবে।

আধুনিক কসাইখানা বা ভেটেরিনারি সার্জনের অনুপস্থিতিতে বাড়ছে সংক্রমণ

রংপুর জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, গত জুলাই ও সেপ্টেম্বরে রংপুরের পীরগাছায় অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ নিয়ে দুজন মারা গেছেন। একই সময়ে অ্যানথ্রাক্স রোগে উপজেলার চারটি ইউনিয়নে অর্ধশত ব্যক্তি আক্রান্ত হন। পরে আইইডিসিআরের একটি প্রতিনিধিদল গত ১৩ ও ১৪ সেপ্টেম্বর পীরগাছা সদর এবং পারুল ইউনিয়নের অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ থাকা ১২ নারী-পুরুষের নমুনা সংগ্রহ করে। এর মধ্যে আটজনের অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত করা হয়। ওই সময় ঘটনাস্থল থেকে অসুস্থ গরুর মাংসের নমুনা পরীক্ষা করে অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত করেছিল প্রাণিসম্পদ বিভাগ।

গত ১৫ সেপ্টেম্বর রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার ইমাদপুর ইউনিয়নের আমাইপুর গ্রামে কৃষক ইব্রাহিম মিয়ার একটি গরু অসুস্থ হয়। পরে সেটি জবাই করা হলে আশপাশের লোকজন মাংস কাটাকাটি করেন। ঘটনার দুই দিন পর স্থানীয় চারজন সোহরাব হোসেন, আব্দুর রাজ্জাক, মনির হোসেন, মজিবর রহমানসহ কয়েকজন চর্মরোগে আক্রান্ত হন। তাদের শরীর থেকে সংগৃহীত নমুনা পরীক্ষার জন্য আইইডিসিআরে পাঠানো হয়েছে। তাঁদের মধ্যে একজনের অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হয়।

Advertisement

মিঠাপুকুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিক্যাল অফিসার (রোগ নিয়ন্ত্রণ) এমএ হালিম লাবলু বলেন, ইমাদপুরে যারা আক্রান্ত হয়েছেন, তারা অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত গবাদিপশুর শ্লেষ্মা, লালা, রক্ত, মাংস, হাড় ও নাড়িভুঁড়ির সংস্পর্শে এসেছিলেন। রোগীরা যাতে সামাজিকভাবে কোনো হেয় পরিস্থিতির মধ্যে না পড়েন, সেজন্য তাঁদের নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না।

পীরগাছা ও মিঠাপুকুর উপজেলার পর কাউনিয়া উপজেলায় এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে আক্রান্ত পাঁচ ব্যক্তির নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআরে পাঠানো হলে দুজনের শরীরে অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হয়।

রংপুর জেলা স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক আরবিন্দু কুমার মোদক বলেন, আমরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছি। উপজেলাগুলোয় আমাদের স্বাস্থ্য সহকারীদের নমুনা সংগ্রহের প্রশিক্ষণ দিয়েছে আইইডিসিআর। আক্রান্তের খবর পেলে তাঁরা নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআরকে পাঠাচ্ছে। একইসঙ্গে অ্যানথ্রাক্স সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার কাজও অব্যাহত রেখেছে স্বাস্থ্য বিভাগ।

এদিকে রংপুর বিভাগে আধুনিক কসাইখানা বা ভেটেরিনারি সার্জনের উপস্থিতি না থাকায় যত্রতত্র অসুস্থ গরু জবাইয়ের ঘটনায় প্রতিনিয়ত বাড়ছে অ্যানথ্রাক্স সংক্রমণ।

জানা যায়, রংপুর বিভাগজুড়ে প্রতিদিন গড়ে দেড় হাজারের বেশি পশু জবাই করা হচ্ছে। কিন্তু এসব পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয় না। বিভাগে ১ হাজার ৩০৩টি হাট-বাজার রয়েছে, তবে কোথাও নেই আধুনিক কসাইখানা বা ভেটেরিনারি সার্জনের উপস্থিতি।

Advertisement

পশু জবাইয়ের আগে স্বাস্থ্য পরীক্ষা মানা হচ্ছে না

পশু জবাইয়ের আগে স্বাস্থ্য পরীক্ষা বাধ্যতামূলক হলেও তা মানা হচ্ছে না। ফলে রোগাক্রান্ত পশুর মাংস সরাসরি মানুষের খাদ্যচক্রে প্রবেশ করছে। এর মধ্য দিয়ে জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও খাদ্য নিরাপত্তা একসঙ্গে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ছে। পশুর রোগ ছড়াচ্ছে মানবদেহে।

প্রচলিত আইনে মাংস ব্যবসা শুরু করার আগে প্রত্যেক ব্যবসায়ীকে সিভিল সার্জনের কার্যালয় থেকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার সনদ নিতে হয়। এরপর প্রাণিসম্পদ দপ্তর থেকে মাংস বিক্রির লাইসেন্স নিতে হয়। কিন্তু রংপুর বিভাগের অধিকাংশ মাংস ব্যবসায়ীরই এ ধরনের সনদ নেই। অনেকেই নিয়মটির ব্যাপারে জানেনই না।

রংপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আবু ছাঈদ জানান, পুরো রংপুর বিভাগে কোনো সার্টিফাইড জবাইখানা নেই। তিনি বলেন, জনবল সংকটের কারণে পশু জবাইয়ের পূর্বে ভেটোরিনারি সার্জন দিয়ে পরীক্ষা করে জবাই নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। তবে আমরা ভলান্টিয়ার ও কৃত্রিম প্রজনন কর্মীদের মাধ্যমে পশু জবাইয়ের পূর্বে হাটবাজারগুলোতে নিয়মিত তদারকি কার্যক্রম পরিচালনা করছি।

Advertisement
Continue Reading
Advertisement