Connect with us

স্পটলাইট

‘অপ্রতুল’ কৈশোরবান্ধব সেবা, যৌন-প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে অজ্ঞ বড় অংশ

Published

on

দেশের মোট কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে প্রায় ৬৫ শতাংশ সরকারের কৈশোরবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র সম্পর্কে ধারণা রাখলেও বাকি ৩৫ শতাংশের মতো কিশোর-কিশোরী এখনো এই সেবা সম্পর্কে কিছুই জানে না। এমনকি যারা এই সেবা সম্পর্কে জানে, তাদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি কিশোর-কিশোরী সেবা কেন্দ্রে এসে এই সেবা নিতে আগ্রহ প্রকাশ করে না। ফলে দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বড় অংশই তাদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং অধিকার সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ।

রোববার (১৫ ডিসেম্বর) বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে রিপ্রোডাক্টিভ হেলথ সার্ভিস ট্রেনিং অ্যান্ড এডুকেশন প্রোগ্রাম (আরএইচস্টেপ) আয়োজিত এক সেমিনারে উপস্থাপিত এক গবেষণা প্রবন্ধে এসব তথ্য জানান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান।

২০২২ সালের জরিপ অনুসারে দেশে কিশোর-কিশোরী, বয়সভিত্তিক জনসংখ্যার মধ্যে যারা ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী তাদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জনের মধ্যে ১ কোটি ৭১ লাখ ৬০ হাজার ১৭৫ জনই ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী, শতাংশের হিসাবে যা ১০.১০। এর পরই আছে ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী, যাদের সংখ্যা ১ কোটি ৬৮ লাখ ৪২ হাজার ৬৮২ জন। শতাংশের হিসাবে ৯.৯২। এজন্য বাংলাদেশে স্বাস্থ্য এবং পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর বিশেষভাবে নজর দিচ্ছে কিশোর-কিশোরী ও যুববান্ধব স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ ব্যবস্থায়।

মোস্তাফিজুর রহমান জানান, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ দশমিক ৫ শতাংশ কিশোর-কিশোরী। তাদের জন্য দেশে বর্তমানে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কৈশোরবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র রয়েছে ১২৫৩টি। তবে এত সংখ্যক সেবা কেন্দ্র থাকলেও ৩৫ শতাংশের মতো কিশোর-কিশোরী এখনো এই সেবা সম্পর্কে কিছুই জানেন না। যে ৬৫ শতাংশের মতো জানে, তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ ২৭ থেকে ২৮ শতাংশ কিশোর-কিশোরী স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে সেবা নিতে আসে, বাকি অর্ধেকেরও বেশি কিশোর-কিশোরী এই সেবা নিতে আগ্রহ দেখায় না।

গবেষণায় দেখা গেছে, কৈশোরবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের সম্পর্কে জেনেও যারা সেবা নিতে যায় না তাদের মধ্যে ১০ শতাংশ এই কার্যক্রম নিয়ে উৎসাহবোধ করেন না। এ ছাড়া প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশের মতো কিশোর-কিশোরী সোশ্যাল স্টিগমার কারণে যায় না। আর সাড়ে ৩ শতাংশের মতো কিশোর-কিশোরী বলছে এই কার্যক্রমে যেতে তাদের পরিবারের বাধা-নিষেধ রয়েছে।

Advertisement

গবেষণা প্রসঙ্গে ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমরা চারটি উপজেলায় (সাভার, নড়াইল, গাইবান্ধা, সিলেট) ৩০০ জন কিশোর-কিশোরীর উপর এই জরিপটি পরিচালনা করেছি। কৈশোরবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমে যেসব সেবা থাকার কথা, অধিকাংশতেই সেগুলো পুরোপুরি উপস্থিতি নেই। এমনকি অসংখ্য কিশোর-কিশোরী জানেই না যে, এই সেবা কেন্দ্রে কী ধরনের সেবা পাওয়া যায়। এমনকি কার্যক্রমে শিক্ষক এবং গার্ডিয়ানদের উপস্থিতি কম পাওয়া গেছে। আমরা মনে করি, কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যগত বিষয়গুলোতে তাদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে আমাদের শিক্ষা কারিকুলামে যৌনতা সংক্রান্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে যা আছে, এগুলো সম্পর্কে আমাদের শিক্ষকেরা ঠিকমতো ডেলিভারি দিতে পারছেন না। এমনকি সেক্সচুয়াল বিষয়গুলোর সামনে এলে সেগুলোর বিষয়ে শিক্ষার্থীদের ধারণা না দিয়ে তারা ভিন্ন টপিকে চলে যাচ্ছেন।

তিনি আরও বলেন, গবেষণা করতে গিয়ে আরেকটি বিষয়ে আমরা দুর্বলতা পেয়েছি, তা হলো এই ধরনের বিষয়গুলো কিশোর-কিশোরীরা শুধু বিভিন্ন প্রজেক্টের মাধ্যমেই পাচ্ছে। কিন্তু আমাদের বর্তমান যুগে দেখছি যে বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো যেখানে বিভিন্ন বিষয়ে বড় ভূমিকা রাখছে, সেই জায়গাতে কৈশোরবান্ধব স্বাস্থ্য সেবা পিছিয়ে আছে। এ বিষয়গুলো নিয়ে সরকারের কাজ করার সুযোগ রয়েছে। আমরা মনে করি বিভিন্ন অনলাইন অ্যাক্টিভিজম কিংবা বিভিন্ন গ্রুপ তৈরি করে সেগুলোর মাধ্যমে যৌন প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে ধারণা দিতে পারি, তাহলে কিশোর-কিশোরীরা সামাজিক স্টিগমা বা ট্যাবুটা অনুভব করবে না।

এ সময় সরকারের পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের প্রোগ্রাম ম্যানেজার (এঅ্যান্ডআরএইচ) ডা. মো. মনজুর হোসেন বলেন, কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে আমরা যে উদ্যোগগুলো নিয়েছি, সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি কিছু উন্নয়ন সহযোগী আমাদের সঙ্গে কাজ করছে। আমাদের যে ৩ কোটি ২৮ লাখ কিশোর-কিশোরী রয়েছে, তাদের পুষ্টি, প্রজনন স্বাস্থ্য, সহিংসতা প্রতিরোধ এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে আমরা যৌথভাবে কাজ করে যাচ্ছি। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে আমরা জেলা-উপজেলা পর্যায়ে কৈশোরবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা কর্নার প্রতিষ্ঠা করেছি।

তিনি আরও বলেন, আমাদের কৈশোরবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে কিশোর-কিশোরীরা সেবা নিচ্ছে কি না, বা নিয়ে থাকলে তারা আমাদের সেবায় সন্তুষ্ট কি না, এমনকি কিশোরদের তুলনায় কিশোরীদের উপস্থিতি সেখানে কেন বেশি, এগুলো নিয়ে আমাদের পর্যবেক্ষণ হলো, ওই সেবাকেন্দ্রে যদি তিনজন কিশোরী আমাদের কেন্দ্র থেকে সেবা নেয়, তাহলে কিশোর সেবা নেয় একজন। এখন প্রশ্ন হলো, কেন কিশোরীরা বেশি নিচ্ছে আর কিশোররা কেন নিচ্ছে না? এর মূল বিষয়বস্তুগুলো আমরা লিঙ্গভেদে চিন্তা করি, তাহলে দেখব মেয়েদের এবং ছেলেদের স্বাস্থ্যসেবায় বেশ ভিন্নতা রয়েছে। কারণ মেয়েদের মাসিক ব্যবস্থাপনা সেবার প্রয়োজন হয়, যা কিশোরদের প্রয়োজন হয় না। আবার কিশোরীদের রক্তস্বল্পতার হার বেশি, যা কিশোরদের মধ্যে নেই। মেয়েদের গুণগত মাসিক ব্যবস্থাপনাগুলো নিশ্চিতে আমরা মেয়েদের স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণ করি, যে ছেলেদের প্রয়োজন হয় না। বিশেষ করে মেয়েলি রোগগুলো শুধু কিশোরীদেরই হয়, কিন্তু কিশোরদের হয় না।

মনজুর হোসেন বলেন, দেশে অন্তত ৫০ শতাংশ মেয়েরই বিয়ে হয়ে যায় ১৮ বছরের আগে, তারাও তো কিশোরী। তাদের ফ্যামিলি প্ল্যানিং, গর্ভকালীন সেবা, প্রসব সেবা এবং প্রসব পরবর্তী সেবা সবগুলোই কিশোরীদের প্রয়োজন হয়, এ বিষয়গুলো কিশোরদের প্রয়োজন হয় না বলেই তারা আমাদের কাছে আসে না। এসব কারণেই কিশোরীদের সেবা গ্রহণের হার আমাদের সেবা কেন্দ্রগুলোতে কিশোরদের তুলনায় বেশি।

Advertisement

তিনি আরও বলেন, কৈশোরবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে আমরা যে সেবাগুলো দিচ্ছি, সেগুলোতে ডিমান্ড এবং সাপ্লাই _দুটো পক্ষেরই অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আপনি আপনার প্রয়োজনটা যখন অনুভব করবেন, তখনই আমাদের কাছে আসবেন এবং আমরা সে অনুযায়ী সেবা দেব। সেক্ষেত্রে আমাদের কিশোর-কিশোরীদের হেলথ চেকিং বিহেভিয়ার এটা কেন কম, এটা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।

পরিবার পরিকল্পনার এই কর্মকর্তা বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে বাড়ি থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যন্ত কিশোর-কিশোরীদের যতটা বার্তা দেওয়া দরকার, আমরা সেটি শতভাগ দিতে পারছি না। সেটা বাড়ি থেকেও সে পাচ্ছে না, স্কুল থেকেও পর্যাপ্ত দিচ্ছে না, এমনকি যারা স্কুলে যায় না তারা তো আরও কম পাচ্ছে। এই যে বড় একটা গ্যাপ তৈরি হয়েছে, এই জায়গাগুলো নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। আমরা আমাদের জায়গা থেকে এগুলো নিয়ে আরও কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে চেষ্টা করবো এবং আমাদের পরবর্তী কার্যক্রমে সেগুলো যুক্ত করা যায় কি না এসব বিষয়ে পর্যালোচনা করব।

আরএইচস্টেপ’র আয়োজনে ‘অধিকার এখানে এখনই-২’ প্রকল্পের উদ্যোগে গবেষণার ফলাফল প্রকাশের এই আয়োজনে আরও বক্তব্য দেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (এমসিএইচ সার্ভিসেস ইউনিট) ডা. আনম মোস্তফা কামাল মজুমদার, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রোগ্রাম ম্যানেজার (এডোলোসেন্ট অ্যান্ড স্কুল হেলথ প্রোগ্রাম) ডা. মো. শামসুল হক, ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মধুছন্দা হাজরা মৌ। এ ছাড়া সেমিনারে আরও উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এবং আরএইচস্টেপ’র কর্মকর্তারা। অনুষ্ঠানটিতে শুভেচ্ছা ও সমাপনী বক্তব্য দেন আরএইচস্টেপ’র নির্বাহী পরিচালক কাজী সুরাইয়া সুলতানা।

Continue Reading
Advertisement