খাদ্য ও পুষ্টি
শিশুদের জন্য লবণ যতটুকু দরকার
অতিরিক্ত লবণ শিশুর বৃদ্ধিতে বাধা প্রদানের পাশাপাশি অল্প বয়সে রক্তচাপের ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। খাদ্যাভ্যাসে এমন পরিমাণ লবণ রাখতে হবে যা পরিমাণে বেশিও না আবার কমও না।
আবার শিশুদের লবণের চাহিদা বড়দের থেকে আলাদা। তাহলে বুঝবেন কীভাবে কী পরিমাণ লবণ শিশুদের জন্য দরকার?
এই বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন, দিনাজপুরের ‘রাইয়ান হেল্থ কেয়ার হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার’য়ের পুষ্টিবিদ লিনা আকতার।
হাজার বছর ধরে খাবারের স্বাদ ও সংরক্ষনের জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে লবণ; যা সোডিয়াম ক্লোরাইডের একটি সাধারণ নাম। এতে থাকে ৪০ শতাংশ সোডিয়াম এবং ৩০ শতাংশ ক্লোরাইড। মানে ২.৫ গ্রাম লবণে ১ গ্রাম সোডিয়াম ও ১.৫ গ্রাম ক্লোরাইড থাকে।
প্রতিদিন শরীরের যে পরিমাণ লবণ গ্রহণ করা হয় তা আমাদের হজমের সময় শোষিত হয় এবং প্রসাবে নির্গত হয়।
সোডিয়ামের ভারসাম্য বজায় রাখার মৌলিক প্রক্রিয়া লবণ। এছাড়া রক্তনালীর ‘লুমেনে’ কোষের ভেতরে এবং বাইরে পানির ভারসাম্য বজায় রাখতে, অসমোটিক চাপ বজায় রাখতে স্নায়ু প্রবণতা সঞ্চালনে গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা পালন করে।
প্রাণিজ খাবার যেমন- মাংস, ডিম, দুধ ও সামুদ্রিক খাবারে বেশি থাকে সোডিয়াম। আর সবজি ও ফলে থাকে কম।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুযায়ী- একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীরে লবণের প্রয়োজন দিনে প্রায় ৫ গ্রাম। আর এই ৫ গ্রাম লবণে ২০০০ মি.লি.গ্রাম সোডিয়াম থাকে।
এক বছরের কম বয়সি শিশুদের জন্য ১ গ্রামের কম লবণের প্রয়োজন। কারণ শিশু যে প্রাকৃতিক খাবার খায়, যেমন- মাংস, দুধ, ডিম, ইত্যাদিতে সোডিয়াম উপাদান থাকে।
বলা হয় যে, প্রতিদিনের খাবারে প্রাকৃতিকভাবে ৪০০ মি.লি.গ্রাম সোডিয়াম থাকে যা ১ গ্রাম লবণের সমতূল্য।
প্রাকৃতিক খাবারের মধ্যে সামুদ্রিক খাবারে বেশি লবণ থাকে। এক থেকে তিন বছর বয়সি শিশুদের জন্য লবণের পরিমাণ প্রতিদিন প্রায় ৩ গ্রাম পর্যন্ত। আর ৭ বছর বা তার বেশি বয়সিদের ৫ গ্রাম লবণ পর্যন্ত হতে পারে।
তাই শিশুদের অতিরিক্ত লবণ খাওয়ার প্রয়োজন নেই। কারণ অতিরিক্ত লবণ শিশুর রেচনতন্ত্রকে প্রভাবিত করে।
সুস্বাস্থের জন্য লবণ প্রয়োজন, তবে অতিরিক্ত নয়। আবার খুব কম লবণ গ্রহণে শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে, যা শিশুর থাইরয়েড হরমোনকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করবে।
অতিরিক্ত লবণ শিশুদের যেসব সমস্যা তৈরি করতে পারে
কম বয়সি শিশুরা অতিরিক্ত লবণ খেলে ‘অ্যানোরেক্সিয়া’ এবং শরীরে পানির ভারসাম্যহীনতার কারণে বেশি ক্লান্ত অনুভব করতে পারে।
অতিরিক্ত লবণের পাশাপাশি সোডিয়াম পাবে বেশি। অতিরিক্ত সোডিয়াম প্রস্রাবে ক্যালসিয়াম নির্গমণের ঝুঁকি বাড়ায়।
ফলে শিশুরা ক্যালসিয়ামের ঘাটতির ঝুঁকিতে পড়তে পারে, যা তাদের উচ্চতা বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলে। পরবর্তী সময়ে শিশুর ‘রিকেট’, ‘কিডনি ফেইলর’ এবং ‘অ্যানোরেক্সিয়া’র ঝুঁকি বেড়ে যাবে।
এছাড়া শিশু বেশি লবণ খেয়ে বড় হলে, স্বাভাবিকভাবেই বড়বেলাতেও তার বেশি লবণ গ্রহণের অভ্যাস থাকবে।
অতিরিক্ত লবণ খেলে অল্প বয়সে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, কিডনি বা বৃক্ক রোগ ও শিশুদের অল্প বয়সে হাড় ক্ষয়ের ঝুঁকিতে থাকবে।
খাবারে লবণের পরিমাণ সীমিত করা শিশুর খাদ্য নির্বাচনের অভ্যাস এবং রান্নার অনুশীলনের ওপর অনেকটাই নির্ভর করে।
একই সময়ে মাঝারি এবং কম সোডিয়ামযুক্ত খাবার বেছে নেওয়া উচিত। শিশুদের প্রাকৃতিক খাবার খাওয়ানো তাদের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।
শিশুদের সুস্থ ও ভালো বিকাশের জন্য প্রয়োজন পরিমাণ ও গুনমাণের ভারসাম্যের দিক থেকে পুষ্টিকর খাবার। না হলে শিশুরা সহজেই পুষ্টির অভাবজনিত রোগে ভুগবে যা শারীরিক ও মানসিক বিকাশকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত ফেলতে পারে।
খাদ্যে লবণের হিসাব
খাদ্যে প্রতিদিন ৮০০ থেকে ১২০০ মি.লি.গ্রাম সোডিয়াম, মানে দুই থেকে তিন গ্রাম লবণের সমতুল্য। যা ভাত ও শাকসবজি থেকে পাওয়া যায় ১ গ্রাম পরিমাণ।
আবার ৪০০ থেকে ৭০০ মি.লি.গ্রাম সোডিয়াম, মানে এক থেকে দুই গ্রাম লবণের সমতুল্য। ২০০ থেকে ৩০০ মি.লি.গ্রাম সোডিয়াম ০.৫ থেকে এক গ্রাম লবণের সমতুল্য।
এই পরিমাণ সোডিয়াম ইতিমধ্যে খাবারে উপস্থিত রয়েছে। তাই খাদ্যে রান্নার সময় প্রয়োজন ছাড়া লবণ ব্যবহার করা উচিত না।
এছাড়াও বেছে নিতে হবে কম সোডিয়ামযুক্ত খাবার। যেমন- সবুজ শাকসবজি, ফলমূল, চর্বিহীন মাংস।
যেসব লক্ষণে বোঝা যায় শরীরে লবণ বেশি
১. সব সময় পিপাসা বোধ হবে। যতবার লবণাক্ত খাবার খাওয়া হবে ততই দ্রুত পিপাসা অনুভব করবেন।
২. অতিরিক্ত লবণাক্ত খাবার খেলে বৃক্ক বিষাক্ত পদার্থকে বের করে দিতে পারে না। যার ফলে ক্যালসিয়াম ঘাটতি দেখা দিবে। পরবর্তী সময়ে ‘অস্টিওপরোসিস’ বা হাড়ভঙ্গুর রোগ ও দাঁতের অবস্থা খারাপ করে দিতে পারে।
৩. অতিরিক্ত লবণ শরীরে প্রবেশ করলে রক্তের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে ‘ভ্যারিকজ ভেইনস’ সৃষ্টি হয় এবং রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। এটি তীব্র মাথাব্যথার কারণ হতে পারে।
৪. সকালে উঠে যদি দেখেন- চোখ ফুলে গেছে, পা, হঠাৎ ফুলে গেছে, ‘ক্র্যাম্প’ অনুভব করছেন তাহলে বুঝবেন শরীরে লবণের পরিমাণ বেড়ে গিয়েছে।
৫. প্রসাবের পরিমাণ বেশি হতে পারে। প্রসাব গাঢ় হলুদ হতে পারে।
লবণের ঘাটতি হলে যেসব সমস্যা হতে পারে
১. শরীরে লবণের অভাব হলে ‘হাইপোনেট্রোমিয়া’ হতে পারে। যে কারণে হাত, পা, ফুলে যাওয়া মতো সমস্যা হয়।
২. মানুষের ঘাম, চোখের জল, এবং প্রস্রাবে লবণ থাকে। ফলে শরীরে লবণের পরিমাণ স্বাভাবিকের থেকে কমে গেলে হতে পারে ‘ইলেকেট্রালাইট’য়ের ঘাটতি।
৩. রক্তে সোডিয়ামের মাত্রা স্বাভাবিকের থেকে কমে গেলে ক্রমাগত মাথাব্যাথা, বমি, বমিভাব, খিচুনি হতে পারে।
৪. শরীরে লবণের পরিমাণ কমে গেলে রক্তনালীতে ‘অসমোটিক’ চাপ কমে গিয়ে রক্তচাপ কমে যেতে পারে। আর নিম্ন রক্তচাপের ফলে যকৃত, বৃক্ক, মস্তিষ্ক-সহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে অক্সিজেন ও পুষ্টির অভাব হতে পারে। যা থেকে দেখা দেয় ক্লান্তি ও অবসাদগ্রস্ততা।
৫. লবণের ঘাটতির কারণে হতে পারে পেশির কার্যকারিতায় হ্রাস।
বয়স অনুযায়ী দৈনিক লবণ গ্রহণের সর্বোচ্চ পরিমান (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র গাইডলাইন ২০১২)
১ থেকে ৩ বছর: দৈনিক ২ গ্রাম।
৪ থেকে ৬ বছর: দৈনিক ৩ গ্রাম।
৭ থেকে ১০ বছর: দৈনিক ৫ গ্রাম।
১১ বছর বেশি হলে: দৈনিক ৫ থেকে ৬ গ্রাম।
পরামর্শ
রান্নায় কম লবণ ব্যবহার করা।
চিপস, চানাচুর, সস, প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলা।
খাবারে স্বাদ আনতে ভেষজ মসলা ধনেপাতা, পুদিনাপাতা, রসুন ব্যবহার করা উচিত।
বাইরের খাবার গ্রহণ করলে প্যাকেটের গায়ে সোডিয়ামের মাত্রা দেখে শিশুকে খাওয়াতে হবে।
কিছু ওষুধে সোডিয়াম থাকে সেগুলো দেখে খাওয়াতে হবে শিশুকে, বিশেষ করে কাশির সিরাপ।
