ঢাকায় এক রোগীর বাম কানের বদলে ডান কানে অস্ত্রোপচারে ‘যথেষ্ট অবহেলা গাফিলতির’ প্রমাণ পাওয়ায় ইএনটি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আলী জাহীর আল-আমীনের চিকিৎসক নিবন্ধন এক বছরের জন্য স্থগিত করেছে বিএমডিসি।
বাম কানের সমস্যা নিয়ে ২০২০ সালের মার্চে রাজধানীর ইমপালস হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব এক নারী। তার চিকিৎসার তত্ত্বাবধানে ছিলেন হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) অধ্যাপক ডা. আলী জাহীর আল-আমীন। রোগী বাম কানে সমস্যা নিয়ে ভর্তি হলেও ডা. আলী জাহীর আল-আমীন তার অস্ত্রোপচার করান ডান কানে। এতে মুখের আকৃতি বাঁকা হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি আরো অনেক দুর্ভোগে পড়তে হয় রোগীকে। ভুক্তভোগী ওই নারীর স্বামীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্তের ভিত্তিতে ডা. আলী জাহীর আল-আমীনের নিবন্ধন এক বছরের জন্য স্থগিত করেছে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)। এ এক বছর নিজেকে চিকিৎসক হিসেবেও পরিচয় দিতে পারবেন না তিনি।
স্বয়ং এমডির বিরুদ্ধে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ ওঠার বিষয়টিকে গোটা ইমপালস হেলথ সার্ভিসেস অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার তথা ইমপালস হাসপাতালের প্রশ্নবিদ্ধ চিকিৎসাসেবার প্রতিফলন হিসেবে দেখছেন স্বাস্থ্য খাতসংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, শুরু থেকেই হাসপাতালটির বিরুদ্ধে রোগীর প্রতি অবহেলার পাশাপাশি চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ রয়েছে। সেবার মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে বিস্তর। মহামারীর প্রাদুর্ভাবের পর হাসপাতালটিতে বেশকিছু সংখ্যক রোগী কভিডের চিকিৎসা পেতে ভর্তি হয়েছিলেন। সে সময় তারাও হাসপাতালটির বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ফি আদায়ের অভিযোগ তুলেছিলেন।
অধ্যাপক ডা. আলী জাহীর আল-আমীন একজন নাক, কান ও গলা (ইএনটি) এবং হেড-নেক সার্জারি বিশেষজ্ঞ। তার নিবন্ধন স্থগিত করে গত বুধবার এক চিঠি জারি করে বিএমডিসি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বিএমএসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থা ও ভুক্তভোগীর স্বামীকেও (অভিযোগকারী) এ চিঠির অনুলিপি পাঠানো হয়। বিএমডিসির রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মো. লিয়াকত হোসেন স্বাক্ষরিত ওই চিঠির ভাষ্য অনুযায়ী, আলী জাহীর আল-আমীনের (চিকিৎসক নিবন্ধন নম্বর এ-১২৬৮৮) তত্ত্বাবধানেই ২০২০ সালের ১১ মার্চ তেজগাঁওয়ে ইমপালস হাসপাতালে ভুক্তভোগী নারী বাম কানের সমস্যা নিয়ে ভর্তি হন। কিন্তু চিকিৎসক তার ডান কানে অস্ত্রোপচার করানোয় ওই নারীর মুখের আকৃতি বাঁকা হয়ে যায়। একই সঙ্গে চরম দুর্ভোগেও পড়তে হয়। পরে এ বিষয়ে রোগীর স্বামী বিএমডিসিতে অভিযোগ করেন। সেখানে ওই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য সরবরাহের অভিযোগ তোলা হয়। সেই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ডা. আল-আমীনের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হলে গত ৩১ অক্টোবর তিনি বিএমডিসিকে লিখিত জবাব দেন। তবে জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় এক বছরের জন্য তার চিকিৎসক নিবন্ধন স্থগিত করা হয়েছে। সে অনুযায়ী আলী জাহীর আল-আমীন ২০ নভেম্বর (আজ) থেকে আগামী এক বছর কোথাও চিকিৎসা দিতে পারবেন না। এমনকি এ সময় নিজেকে চিকিৎসক হিসেবেও পরিচয় দিতে পারবেন না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চিঠিতে স্বাক্ষরকারী বিএমডিসির রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মো. লিয়াকত হোসেন বলেন, আমরা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত করেছি। এতে সত্যতাও পাওয়া গিয়েছে। একই সঙ্গে অভিযুক্তের জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় কাউন্সিলে ওই চিকিৎসকের নিবন্ধন এক বছরের জন্য স্থগিত করা হয়েছে।
সাশ্রয়ী মূল্যে সর্বোচ্চ ও সর্বাধুনিক সেবা দেয়ার অঙ্গীকার নিয়ে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে চালু হয় ৪০০ শয্যাবিশিষ্ট মাল্টি ডিসিপ্লিনারি চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান ইমপালস হাসপাতাল। ২৪ ঘণ্টা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, আইসিইউ, সিসিইউ, এনআইসিসিইউ, ডায়ালাইসিস, ইমার্জেন্সিসহ বিশ্বমানের সব ধরনের চিকিৎসাসেবা দেয়ার প্রতিশ্রুতি থাকলেও বিভিন্ন সময়ে হাসপাতালটির বিরুদ্ধে নানা অব্যবস্থাপনার অভিযোগ উঠেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, ইমপালস হাসপাতালের মালিকানায় রয়েছেন শতাধিক ব্যক্তি। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন চিকিৎসক। শুরুতে দেশের স্বনামধন্য চিকিৎসকরা এখানে সেবা দিতে এলেও একসময় অনেককেই বের করে দেয়া হয়। বিভিন্ন সময়ে হাসপাতালটির পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের দ্বন্দ্বের কারণে সঠিকভাবে স্বাস্থ্যসেবা দিতে না পারারও অভিযোগ পেয়েছে অধিদপ্তর। সেবার মান নিয়ে সন্তুষ্টি না থাকায় রোগীরাও তেমন আসত না। কভিডকালে কভিড রোগীদের চিকিৎসার বিনিময়ে মাত্রাতিরিক্ত ফি আদায়েরও অভিযোগ রয়েছে হাসপাতালটির বিরুদ্ধে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের জাতীয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই-মাহবুব বলেন, চিকিৎসাসেবা দেয়ার ক্ষেত্রে ডাক্তারের ভুল হওয়ার বিষয়টি অস্বাভাবিক কিংবা অসম্ভব কিছু নয়। তবে দেখতে হবে ভুল করার ক্ষেত্রে চিকিৎসকের কোনো অবহেলা ছিল কিনা। যদি অবহেলার কারণে কোনো রোগী ভুক্তভোগী হয়, সেটা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত। এ বিষয়ে আরো বেশি সচেতন হওয়া প্রয়োজন। আমরা দেখছি, কিছু হাসপাতাল মালিকপক্ষের মাধ্যমে পরিচালনা না করে ভিন্ন ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছে। সেগুলোর স্বাস্থ্যসেবার মান তুলনামূলক ভালো। আবার যেখানে মালিকরা সরাসরি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন, সেখানে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলার কথা শোনা যায়।
জানা গিয়েছে, ইমপালস হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী জাহীর আল-আমীন ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন ১৯৮৩ সালে। পরে বিদেশ থেকে বেশ কয়েকটি উচ্চতর ডিগ্রিও নিয়েছেন তিনি। ১৯৯৭ থেকে ২০১৭ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত চিকিৎসা ও অধ্যাপনা করেন বারডেম জেনারেল হাসপাতাল ও ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজে। ইমপালস হাসপাতালের দায়িত্ব পালনকালে তার বিরুদ্ধে রোগী, চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে।
ইমপালস হাসপাতালের ফ্লোর বিভিন্ন সময়ে নাটক ও সিনেমার জন্য ভাড়া দেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। হাসপাতালটির নানা অব্যবস্থাপনার জন্য আলী জাহীর আল-আমীনকেই এখন দায়ী করা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতাল ও একটি ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানিয়েছেন, আলী জাহীরের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে হাসপাতালের পরিচালনা পর্ষদ ভালোভাবে চলছে না। তিনি যাকে ইচ্ছা নিয়ে সভা করেন, আবার যাকে ইচ্ছা তাকে ডেকে নিয়ে বকাঝকা করেন।
বিএমডিসির শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ও অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ইমপালস হেলথ সার্ভিসেস অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অধ্যাপক আলী জাহীর আল-আমীন বলেন, বিএমডিসি যেটা করেছে আমরা তার বিরুদ্ধে আদালতে যাব। আমার মনে হয় এখানে প্রকৃত সত্যটা বের হয়ে আসবে। আমার প্রতি সুবিচার করা হয়নি। একজন রোগী টিউমার নিয়ে আমার কাছে এসেছিলেন। তার অপারেশন আমি করেছিলাম আড়াই বছর আগে। তিনি অভিযোগ করেছেন, তার মুখ বেঁকে গিয়েছে। আপনি গিয়ে দেখেন, আসলেই তার মুখ বেঁকেছে কিনা? এটি তো টিউমার ছিল। সেই টিউমার এখন আর নেই। তাহলে অপারেশন সাকসেসফুল, না ভুল?
সুত্র: বণিক বার্তা