প্রধান খবর
বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস: চিকিৎসা থেকে দূরে ৯২ ভাগ মানুষ

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস আজ। এবারের প্রতিপাদ্য করা হয়েছে ‘এক্সেস টু সার্ভিস : মেন্টাল হেলথ ইন ক্যাটাসট্রোফিস অ্যান্ড ইমার্জেন্সিস’। অর্থাৎ, যে কোনো দুর্যোগ ও জরুরি পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। গত কয়েক দিন ধরে নানা আয়োজনে পালিত হচ্ছে দিনটি। আজ ও আগামীকাল রয়েছে নানা কর্মসূচি।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য অবহেলিত ও উপেক্ষিত। প্রায় ১৮ কোটি মানুষের দেশে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সংখ্যা ৪০০ জনের মতো। অর্থাৎ, সাড়ে ৪ লাখ রোগীর বিপরীতে চিকিৎসক রয়েছেন একজন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের গ্রামাঞ্চলে এই রোগ নিয়ে উদ্বেগ নেই, আগ্রহ নেই। অনেকের মধ্যে কুসংস্কার স্থায়ী ঠাঁই করে নিয়েছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য ব্যাপক সচেতনতামূলক কর্মসূচির পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এখনও মানসিক রোগকে ‘পাগলামি’ বলে মনে করা হয়। এ কারণে আক্রান্ত ব্যক্তিরা
পরিবার ও সমাজের সমালোচনার ভয়ে অসুস্থতা গোপন করেন।
এ ছাড়া বেশিরভাগ অঞ্চলে মানসিক অসুস্থতাকে অতিপ্রাকৃত কারণে ঘটেছে বলে মনে করা হয়। ফলে চিকিৎসকের বদলে ঝাড়ফুঁক বা ধর্মীয় পদ্ধতির আশ্রয় নেওয়া হয় এবং অধিকাংশ রোগী প্রাথমিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়। গ্রামাঞ্চলে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা অনুপস্থিত। শহরেও সুযোগ সীমিত। জাতীয় স্বাস্থ্য বাজেটে মানসিক স্বাস্থ্য খাতকে অগ্রাধিকার না দেওয়ায় চিকিৎসা অবকাঠামো ও মানবসম্পদ তৈরি করা যাচ্ছে না। পারিবারিক ও সামাজিক সহানুভূতির অভাব মানসিক রোগীদের আরও বিচ্ছিন্ন করে তুলছে।
করণীয় : বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই সংকট কাটাতে হলে জরুরি ভিত্তিতে সচেতনতা বাড়াতে হবে এবং মানসিক অসুস্থতা নিয়ে সামাজিক অসঙ্গতি দূর করতে হবে। চিকিৎসা শিক্ষায় মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিতে হবে, প্রশিক্ষিত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সংযুক্ত করতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, ‘মানসিক স্বাস্থ্য কেবল রোগের অনুপস্থিতি নয়; এটি সামগ্রিক সুস্থতার অপরিহার্য অংশ।’ মানসিক স্বাস্থ্য বিলাসিতা নয়, মৌলিক মানবাধিকার।
উল্লেখ্য, ইংল্যান্ডের জনসংখ্যা প্রায় ৬ কোটি ৯০ লাখ। সেখানে প্রায় ৬ হাজার ৩০০ জন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আছেন, প্রতি ১১ হাজার মানুষের জন্য একজন। এই বিশাল পার্থক্য বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের ভয়াবহ ঘাটতিকে স্পষ্ট করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, বিশ্বে প্রতি আটজনের একজন মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগেন। এই অনুপাত বিবেচনায় বাংলাদেশে প্রায় ২ কোটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত। যদিও বাংলাদেশের মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষের এই রোগের চিকিৎসা নেওয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএমইউ) মনোরোগবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সালাহ্?উদ্দিন কাউসার বিপ্লব বলেন, কোনো বিপর্যয় বা ইমারজেন্সি কন্ডিশনে যাতে মানসিক স্বাস্থ্যের এক্সেসটা পাওয়া যায়- এমন ধারণা থেকে এবার মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালিত হবে।
তিনি জানান, দেশে টোটাল মানসিক স্বাস্থ্যসেবা এখনও আশানুরূপ পর্যায়ে যায়নি। ৯২ শতাংশ মানুষ চিকিৎসাসেবা থেকে দূরে। ২০১৮ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৬.৮ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ মানসিক রোগী। শিশুদের মধ্যে ১৩.৪ শতাংশ।
অধ্যাপক সালাহ্?উদ্দিন কাউসার বিপ্লব আরও জানান, দেশে সাইকিয়াট্রিস্ট আছেন প্রায় ৪০০ জন। বেশিরভাগই শহরকেন্দ্রিক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ডা. মো. শাহানুর হোসাইন বলেন, দেশে কারও হয়তো ডিপ্রেশনের সিম্পটম আছে, কারও ভয়-উদ্বেগের; অর্থাৎ কমপ্লিট ফাংশনিং মানুষ নেই বললেই চলে। এইভাবে চিন্তা করলে দেশে প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নেওয়া দরকার। মানুষের ফাংশনালিটি কী করে আরও বাড়বে, তাঁরা জাতিকে কী করে আরও ভালো সেবা দিতে পারবেন, সে বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে- হোন ডাক্তার, সরকারি চাকরিজীবী, কৃষিবিদ বা চাষি।
তিনি বলেন, মানুষের মধ্যে সচেতনতা নেই। যে কারণে মানুষ চিকিৎসাসেবা নিতে যায় না। অন্যদিকে এমন ধারণা আছে- মানসিক স্বাস্থ্যের কথা বললেই মনে করা হবে আমার মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা আছে; কোথাও গেলে লোকজন আমাকে খারাপ ভাববে, দুর্বল ভাববে, ফ্যামিলিতে কলঙ্ক হবে। মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে আমরা মানুষের কাছে নিয়ে যেতে পারছি না। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা মূলত ঢাকাকেন্দ্রিক। আর বড় বড় কিছু শহরে মেডিক্যাল কলেজগুলোতে আছে। জেলার জেনারেল হসপিটালেও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নেই। থানা পর্যায়ে তো দূরের কথা। দেশের বেশিরভাগ মানুষ থাকে গ্রামে।
জানা গেছে, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে প্রতিদিন বহির্বিভাগ থেকে ২৫০ থেকে ৩০০ ব্যক্তি স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে থাকেন। কিছু বিশেষায়িত ক্লিনিকের মাধ্যমেও সেবা দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিষণœতা, ওসিডি বা শুচিবাই রোগ, যৌন সমস্যা ও মাদকাসক্তির চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত ক্লিনিক রয়েছে। চিকিৎসকদের পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠানে সাইকোলজিস্ট রয়েছেন যাঁরা রোগীদের কাউন্সেলিং এবং সাইকোথেরাপি দিয়ে থাকেন।
সারা বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে ১৯৯২ সাল থেকে প্রতিবছর ১০ অক্টোবর ‘বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস’ পালন করা হয়। দিবসটি উপলক্ষে আগামীকাল বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকিয়াট্রি বিভাগ আলোচনার আয়োজন করেছে।