Connect with us

প্রধান খবর

মেধাস্বত্বের ছাড় শেষে বাড়বে ১০ শতাংশ ওষুধের দাম

Published

on

সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৬ সালে নভেম্বর মাসে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তরণ ঘটবে বাংলাদেশের। উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় স্থান পাওয়া যেমন গৌরবের, তেমনি তা অর্থনৈতিকভাবে চ্যালেঞ্জেরও। কারণ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পাওয়া কিছু সুযোগ-সুবিধা বাতিল হবে।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) প্রপার্টি রাইটস বা মেধাস্বত্ব ছাড় দেওয়া হয় ট্রেড রিলেটেড অ্যাসপেক্ট অব ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস (ট্রিপস) চুক্তির আওতায়।

ওষুধ শিল্পের মেধাস্বত্ব (Patent) আইন হলো, কোনো একটি ওষুধ কোম্পানি কর্তৃক উদ্ভাবিত নতুন কোন ওষুধের ফর্মুলা বা প্রযুক্তিকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য একচেটিয়াভাবে ব্যবহারের অধিকার দেওয়া। এই অধিকারের ফলে অন্য কোনও কোম্পানি সেই ওষুধ বা প্রযুক্তি অনুমতি ছাড়া তৈরি, বিক্রি বা বাজারজাত করতে পারে না।

বাংলাদেশ বর্তমানে স্বল্পোন্নত দেশ হওয়ায় বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নীতি অনুযায়ী ওষুধের মেধাস্বত্বের ক্ষেত্রে ছাড় পায়। এই ছাড়ের কারণে, ২০৩৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ কিছু নির্দিষ্ট ওষুধ এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ছাড় পাচ্ছে, এতে দেশের ওষুধ শিল্প উপকৃত হচ্ছে। দেশের চাহিদার প্রায় ৯৮ শতাংশ মিটিয়ে ১৫০টির বেশি দেশে ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে।

মেধাস্বত্বের বেড়াজালে সংকটের মুখে পড়তে পারে দেশীয় ওষুধ শিল্প। মেধাস্বত্ব আইন সম্পূর্ণরূপে কার্যকর হলে দেশীয় ওষুধ কোম্পানিগুলোকে বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে ওষুধ তৈরি বা বাজারজাত করার জন্য রয়্যালটি দিতে হতে পারে। এতে ওষুধের দাম বেড়ে যেতে পারে। অন্যদিকে দাম বেড়ে গেলে ওষুধ রপ্তানিতেও বড় ধরনের ধাক্কা লাগতে পারে।

Advertisement

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) তথ্য মতে, এলডিসি থেকে বের হলে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে ওষুধ শিল্প। এলডিসি থেকে বের হলে ওষুধ শিল্পের ওপর মেধাস্বত্ব বিধিবিধান আরও কড়াকড়ি হবে। এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশের ওষুধ প্রস্ততকারক কোম্পানিগুলোকে আবিষ্কারক প্রতিষ্ঠানকে মেধাস্বত্বের জন্য অর্থ দিতে দিতে হয় না। এ কারণে এলডিসির গরিব নাগরিকেরা স্বল্প মূল্যে ওষুধ পায়। ২০৩৩ সালের আগে কোনও দেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে গেলে ওষুধ শিল্পের এই সুবিধা থাকবে না।

সিপিডির একটি হিসাবে দেখা গেছে, ওষুধ শিল্পে ট্রিপস সুবিধা না থাকলে দেশে উৎপাদিত অন্তত ২০ শতাংশ ওষুধে পেটেন্ট প্রযোজ্য হবে। পরবর্তী সময়ে আবিষ্কৃত নতুন ওষুধেও পেটেন্ট প্রযোজ্য হওয়ায় দাম বেড়ে যাবে। ইনসুলিন তৈরিতে এখন যে খরচ হয়, বর্তমান সুবিধা বাতিল হলে তা আট গুণ পর্যন্ত বাড়তে পারে।

ট্রিপস সুবিধা বাতিল হয়ে গেলে ক্যানসার, কিডনি, হার্টসহ জটিল সব রোগের ওষুধের দাম বহুগুণ বেড়ে যাবে, ফলে এসব ওষুধের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যেতে পারে।

ওষুধ খাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় কঠিন প্রতিযোগিতায় পড়বে দেশের ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো। বড় ওষুধ কোম্পানিগুলো টিকে থাকতে পারলেও সমস্যার সম্মুখীন হবে ছোট ও মাঝারি কোম্পানিগুলো। ফলে ওষুধের বাজারে সংকট তৈরি হতে পারে।

সংকট মোকাবিলায় খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এলডিসি থেকে উত্তরণের আগেই সব প্যাটেন্টের প্রোডাক্টগুলো যদি ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের (ডিজিডিএ) মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করে রাখা যায়, তাহলে মেধাস্বত্বের জটিলতা এড়ানো সম্ভব। তখন কোনো বিদেশি কোম্পানি মেধাস্বত্বের দাবি করতে পারবে না। সব ওষুধের প্যাটেন্টের রেজিস্ট্রেশন ২০২৬ সালের নভেম্বরের মধ্যেই করতে হবে।

Advertisement

এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটলে ওষুধ শিল্পে কী ধরনের প্রভাব পড়বে, জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে আমাদের যেসব জেনেরিক ওষুধ রেজিস্টার্ড হয়ে গেছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে আমাদের কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু যেসব ওষুধ আমাদের দেশের কোম্পানিগুলো এখনও তৈরি করে না, রেজিস্ট্রেশন হয়নি, কিংবা নতুন আসবে সেগুলো ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর রেজিস্ট্রেশন করে উৎপাদনে গেলে রয়্যালটি দিতে হবে।

কী পরিমাণ রয়্যালটি প্রদান করতে হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নতুন ওষুধের দাম তখন দেড় থেকে দুইগুণ বেড়ে যেতে পারে।

তিনি আরও জানান, আমাদের কোম্পানিগুলো দেড় বছর ধরে অনেক নতুন ওষুধ রেজিস্ট্রেশন করে ফেলছে, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরও সেগুলোর অনুমোদন দিচ্ছে। কোম্পানিগুলো হয়তো এখন উৎপাদনে যাচ্ছে না, কিন্তু জেনেরিক প্রোডাক্ট হিসেবে রেজিস্ট্রেশন করে রাখছে। কিন্তু আমাদের সমস্যা হচ্ছে নতুন নতুন অসুখের জন্য নতুন ওষুধ তৈরি করতে হয়। আবার একই ওষুধের নতুন ধরন তৈরি করতে হয়। সুতরাং ২০২৬ সালের পর নতুন ওষুধের ক্ষেত্রে মেধাস্বত্ব আইন প্রযোজ্য হবে।

বিদেশে ওষুধ রপ্তানির ক্ষেত্রে এর প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে এ স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, ওষুধ রপ্তানির বাজার প্রতিযোগিতামূলক। এখন যেসব পণ্য আমাদের রেজিস্টার্ড আছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে তেমন প্রভাব পড়বে না। নতুন যেসব ওষুধ তৈরি করা হবে, সেগুলোর জন্য তখন মেধাস্বত্ব আইন প্রযোজ্য হবে এবং উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। যারা আমাদের থেকে ওষুধ ক্রয় করবে, তারা আমাদের থেকে বেশি দামে ক্রয় করবে না। একই ওষুধ ভারত যদি ১০ ডলারে বিক্রি করে, আমরা সেটা ১১ ডলারে বিক্রি করতে পারবো না। সুতরাং ওষুধ রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় আমরা পিছিয়ে পড়বো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য এবং ফার্মেসি অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক সীতেশ চন্দ্র বাছার বাংলানিউজকে এই বিষয়ে বলেন, আমরা এখন ট্রিপস সুবিধার মধ্যে আছি। এটা ২০২৬ সালের নভেম্বর মাসে শেষ হয়ে যাবে। এরপর আমরা ডেভেলপ কান্ট্রি হিসেবে আর এলডিসির সুবিধা পাবো না। এতে যে ওষুধের প্যাটেন্ট রাইট এখনো শেষ হয়ে যায়নি কিংবা ভবিষ্যতে প্যাটেন্টেড যে ওষুধগুলো আসবে, সেগুলোর বিষয়ে এতদিন আমরা যে ছাড় পেতাম, সেগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। এই ওষুধের সংখ্যা মোট ওষুধের ৫ থেকে ১০ শতাংশ। আমাদের দেশে এক হাজার ৭০০ জেনেরিক ওষুধ তৈরি হয়। বাংলাদেশ একমাত্র দেশ যেখানে চাহিদার ৯৮ শতাংশ ওষুধ উৎপাদন হয়। এমনকি আমেরিকারও এই সক্ষমতা নেই। এতো সফলতার পরেও কিন্তু আমাদের প্রদীপের নিচেই অন্ধকার, সেই অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে।

Advertisement

তিনি আরও বলেন, প্রায় ৬০০ থেকে ৭০০ নতুন মলিকুল ওষুধ লিস্টেড হয়ে আছে, এগুলো যদি আমরা খুব দ্রুত নভেম্বর ২০২৫ সালের মধ্যে রেজিস্ট্রেশন করে ফেলতে পারতাম, তাহলে আমরা এই সুবিধা পেতাম। আবার কেউ বলছে ২০২৬ সালের নভেম্বরের মধ্যেও রেজিস্ট্রেশন করে ফেলতে পারলেও সুবিধা পাওয়া যাবে। এটা নিয়ে কিছুটা মত ভিন্নতা আছে। তবে আমরা যদি এই নতুন ৬০০ থেকে ৭০০ মলিকুল দ্রুত রেজিস্ট্রেশন করে ফেলতে পারি, তাহলে আগামী ১০ বছর আমরা নিরাপদে থাকবো। কিন্তু সেটা আমরা এখনো করতে পারি নাই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের সাবেক এই ডিন আরও জানান, বায়োসিমিলার ড্রাগ, ভ্যাকসিন এবং বায়োলজিক ড্রাগ এগুলো এখন সব থেকে বেশি ব্যবহার করা হয়। ইনসুলিন, ভ্যাকসিন, এন্টি ক্যানসার ড্রাগ যেগুলো লাইনে আছে, সেগুলো যদি আমরা রেজিস্ট্রেশন না করে ফেলতে পারি, ভবিষ্যতে সমস্যা হবে। সব মিলে আইনগতভাবে ট্রিপসের যে ইস্যু আছে এই ট্রানজিশনাল পিরিয়ডের মধ্যে সেগুলো যদি আমরা সমাধান না করতে পারি, তাহলে আমরা খুব সমস্যার মধ্যে পড়তে পারি।

তিনি আরও বলেন, এখন আমরা দেশের চাহিদার ৯৮ শতাংশ ওষুধ উৎপাদন করতে পারি। ২০২৬ সালের পর এটা ৮ শতাংশ কমে আসবে। তখন স্থানীয় চাহিদার ৯০ শতাংশ ওষুধ দেশে উৎপাদন করা সম্ভব হবে। বাকি ১০ শতাংশ ওষুধ তখন বিদেশ থেকে আমদানি করতে হবে। সেই ওষুধের মূল্যও অনেক বেশি হবে।

সমস্যা থেকে উত্তরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে জোড়ালোভাবে বলতে হবে, আমরা বিশ্বের অনেক অনুন্নত দেশে কম দামে ওষুধ সরবরাহ করি, আমরা যদি কম খরচে ওষুধ উৎপাদন না করতে পারি, তাহলে কম দামে সেইসব দেশকেও আমরা ওষুধ দিতে পারবো না। সুতরাং আমাদেরকে সেই সুযোগ দিতে হবে। এলডিসি থেকে উত্তরণ হলেও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সাথে বার্গেনিং করে এই পিরিয়ডটাকে বাড়াতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশের মন্ত্রণালয়গুলো ফার্মাসিউটিক্যাল ট্রিপস সম্পর্কে খুবই কম জানেন। এছাড়া ফার্মাসিউটিক্যাল ট্রিপস বিষয়ে যারা কাজ করেন, তাদের সংখ্যাও খুব কম। বড় বড় কোম্পানির কিছু এক্সপার্ট আছেন, তারা এই বিষয়গুলো খুব ভালো জানেন।

বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতির সভাপতি এবং ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল মুক্তাদির এ বিষয়ে বাংলানিউজকে বলেন, আমরা বহু সভা, সেমিনার করে বলেছি, এলডিসি থেকে উত্তরণের পরে প্যাটেন্টেড যে ওষুধ যেগুলো আসবে, সেগুলো আমরা উৎপাদন করতে পারবো না। সেসব ওষুধ হয় আন্ডার লাইসেন্স বানাতে হবে, নাহয় আমদানি করতে হবে। সেক্ষেত্রে এসবের ওষুধের দাম অনেক বাড়বে।

Advertisement

নতুন ওষুধের দাম কত বাড়তে পারে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমরা যে ইনজেকশন সাধারণত ১০ হাজারে বিক্রি করছি, সেটা তারা বিক্রি করে দুই লাখ টাকায়, পার্থক্যটা অনেক বেশি। প্রায় ২০ গুণ বেশি। হেপাটাইটিস সি এর ইনজেকশন বা ট্যাবলেট আমরা বিক্রি করি সাত ডলারে, তারা বিক্রি করে এক হাজার ডলারে। অর্থাৎ নতুন প্যাটেন্টেড ওষুধের দাম বহুগুণ বাড়বে।

Continue Reading
Advertisement