প্রধান খবর
৬৪ হাসপাতালের চিত্র: গুদামে ওষুধ পচলেও রোগীরা চাইলেও পায় না

বিনা মূল্যে বরাদ্দের ওষুধ গুদামে মজুত। অথচ রোগী এলে বলা হয়, ওষুধের সাপ্লাই নেই। বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে বাধ্য হন রোগী বা তাদের স্বজনেরা। অন্যদিকে বছরের পর বছর ওষুধ গুদামে মজুত রেখে মেয়াদোত্তীর্ণ ও ব্যবহারের অনুপযোগী করে ফেলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আবার হাসপাতালে ভর্তি রোগীকে খাবার দেওয়া হয় বরাদ্দের অর্ধেক। অনেক ক্ষেত্রেই এই খাবার নিম্নমানের। দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের ৬৪টি সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বিরুদ্ধে গুরুতর এসব অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
✅ রোগীর পথ্যেও থাবা—নিম্নমান, পরিমাণে কম।
✅ মোট সাত ধরনের দুর্নীতি-অনিয়ম।
✅ চিকিৎসক ও কর্মীদের দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ।
✅ ৯ মাসে ৫০ কর্মকর্তা-কর্মচারী বরখাস্ত।
অভিযোগ থাকা দেশের ৩৭ জেলার ৬৪ হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বিরুদ্ধে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পৃথক অভিযান ও গোপন অনুসন্ধান চালায় দুদক। তাতেই ওপরের তথ্যগুলো উঠে এসেছে। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে সাত ধরনের অনিয়ম পেয়েছে দুর্নীতি-অনিয়ম নজরদারি করা সংস্থাটি। এর মধ্যে রয়েছে রোগীদের বরাদ্দের চেয়ে কম ও নিম্নমানের খাবার সরবরাহ, ওষুধ না দিয়ে বাইরে থেকে কিনতে বাধ্য করা, অতিরিক্ত ফি আদায়, রোগ নির্ণয়ে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করা, পরিচ্ছন্ন চাদর ও বিছানা না দেওয়া, কেনাকাটা ও নিয়োগে অনিয়ম এবং দায়িত্বে অবহেলা ইত্যাদি অভিযোগ।
অভিযোগ থাকা হাসপাতালগুলোর মধ্যে একটি গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। যেখানে প্রায়ই রোগীদের সরকারি ওষুধ না দিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। বাধ্য করা হয় বাইরের দোকান থেকে ওষুধ কিনতে। স্থানীয়দের অভিযোগ, চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টরা ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে কমিশন নিয়ে এই অসততার আশ্রয় নিচ্ছেন।
গত ১৮ এপ্রিলে সালমা বেগম নামে একজন রোগী জ্বর-ঠান্ডা নিয়ে গিয়েছিলেন কাপাসিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। তাঁকে কোনো ওষুধ দেয়নি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বাধ্য হয়ে বাইরের দোকান থেকে ওষুধ কেনেন তিনি। হাসপাতালটিতে ওষুধ থাকা সত্ত্বেও রোগীদের না দেওয়ার অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে দুদক।
২৯ এপ্রিল দুদকের কর্মকর্তারা হাসপাতালটিতে অভিযান চালান। অভিযানে বিপুল পরিমাণ মেয়াদোত্তীর্ণ সরকারি ওষুধ ও যন্ত্রাংশ পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। অনিয়মের কারণে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কর্মকর্তা ডা. মামুনুর রহমানকে অপসারণ করা হয়েছে।
অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া দুদকের সহকারী পরিচালক মো. সেলিম মিয়া বলেন, ‘ওষুধ বিতরণ না করে গুদামে ফেলে রেখে মেয়াদ শেষ করে রাষ্ট্রের ক্ষতিসাধনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। বরাদ্দের চেয়ে কম খাবার সরবরাহ এবং রোগ পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করার অভিযোগেরও সত্যতা পেয়েছি। যথাযথ ব্যবস্থা নিতে কমিশনে সুপারিশ করা হয়েছে।’
কর্মকর্তারা বলেছেন, দুদকের অভিযানে হাসপাতালটিতে টেন্ডারসংক্রান্ত নথি পর্যালোচনায়ও অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে। একই নথি ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। কম দর দেওয়া ঠিকাদারদের বাদ দিয়ে বেশি দামে কেনা হয়েছে। ভুয়া বিল তৈরি করে অর্থ আত্মসাতের প্রমাণও পাওয়া গেছে।
যশোরের ২৫০ শয্যা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পর্যাপ্ত পরিমাণ ডায়রিয়ার স্যালাইন মজুত থাকার পরও রোগীদের তা বাইরে থেকে কিনতে বাধ্য করেছে। রোগীদের দেওয়া খাবারের পরিমাণ ছিল কম। সকালের নাশতায় নিম্নমানের খাবার পরিবেশন করতে দেখা গেছে।
আজকের পত্রিকার প্রতিবেদক এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে যশোরের হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক ডা. হুসাইন শাফায়েত বলেন, ‘প্রতিটা অভিযোগই সত্য। দুঃখের বিষয়, আমি অনেক চেষ্টা করেও প্রতিকার করতে পারছি না। এর সঙ্গে হাসপাতালের কিছু লোক জড়িত। এমনিতেই এক দিনের খাবারের যে বাজেট, সেটা অনেক কম (১২৫ টাকা)। এখান থেকেও চুরি করা হলে আর খাবারের কোনো মানই থাকে না।’
‘চেষ্টা করেও প্রতিকার করতে না পারার’ কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তত্ত্বাবধায়ক চিকিৎসক হুসাইন শাফায়েত বলেন, ‘আমাদের চিকিৎসকদের বদলি হয় এক, দুই বা তিন বছর পরপর। আমাদের পক্ষে যাঁরা এখানে ২০-২৫ বছর ধরে কাজ করছেন, তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন! আমি নিজেও অনিয়মের একটি লিখিত অভিযোগ জানিয়েছি।’
কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাওয়া গেছে মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট। এ ছাড়া রোগীকে সকালে নিম্নমানের নাশতা ও দুপুরে নির্ধারিত ১০৫ গ্রামের পরিবর্তে ৭০ গ্রাম মাছ দেওয়ার অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে।
মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বিরুদ্ধে বরাদ্দের ওষুধ বিতরণ না করে আইনবহির্ভূতভাবে রোগীদের তালিকাবহির্ভূত ওষুধ সুপারিশ করার অভিযোগ উঠেছে। এই অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে দুদক। এর সত্যতা স্বীকার করেছেন উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার মো. জাহিদুল হাসান। দুদক সূত্র বলেছে, এটি বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল আইন, ২০১০-এর পরিপন্থী।
রাজশাহীর পবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফি কাঁচা রসিদ ও টোকেনে আদায় করা হয়। এ অর্থ যথাযথভাবে সরকারি কোষাগারে জমা না নিয়ে আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া গেছে। দালালদের মাধ্যমে রোগীদের বেসরকারি ক্লিনিকে পাঠানোর তথ্য-প্রমাণও পাওয়া গেছে।
দুদকের একটি সূত্র জানায়, গত ৯ মাসে দুদকের বিভিন্ন অভিযান ও অনুসন্ধানে অভিযুক্ত হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অন্তত ৫০ জনকে বরখাস্ত করা হয়েছে। আর্থিক অনিয়ম, দায়িত্বে অবহেলাসহ বিভিন্ন কারণে তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ৩৩৪ কোটি টাকার একটি প্রকল্প, ১৫টি মেডিকেল কলেজ ও ৪৪ জেলায় ডায়ালাইসিস ইউনিট স্থাপনে অনিয়মের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক। একই সময়ে সংস্থাটি বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে রাঙামাটি, ঝিনাইদহ ও যশোরের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে অভিযান চালিয়েছে।
সরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতে এসব অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে অভিমত জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘দুদক খুবই ভালো কাজ করেছে। সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ সবার জানা। দুদক যেহেতু প্রমাণসহ চিহ্নিত করেছে, কর্মকর্তা-কর্মচারী, চিকিৎসকসহ যাঁরা এতে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত, তাঁদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। দুর্বৃত্তদের এই সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে।’
সরকারি কর্তৃপক্ষ যা বলল
এসব অভিযোগের বিষয়ে স্বাস্থ্যবিষয়ক উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমকে গত কয়েক দিনে কয়েকবার ফোন করা হলেও তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে এ বিষয়ে কথা বলেছেন স্বাস্থ্যসচিব সাইদুর রহমান। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এ বিষয়ে দুদক এখনো আমাদের জানায়নি। যদি দুদক জানায়, আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।’
একই ধরনের কথা বলেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর। তিনি বলেন, ‘দুদকের অভিযান ও অনুসন্ধানের বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। যদি আমাদেরকে জানানো হয়, আমরা সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেব।’
অভিযোগ ওঠা হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও বাঁশখালী, কক্সবাজারের চকরিয়া, ফেনীর দাগনভূঞা, কুমিল্লার বুড়িচং ও নাঙ্গলকোট, চাঁদপুরের হাইমচর ও শাহরাস্তি, লক্ষ্মীপুরের কমলনগর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাঞ্ছারামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া, ফরিদপুরের সালথা ও ভাঙা, গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী ও কোটালীপাড়া, মাদারীপুরের কালকিনি, শরীয়তপুরের জাজিরা ও গোসাইরহাট, নরসিংদী পলাশ, টাঙ্গাইলের কালিহাতী, কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী, পাকুন্দিয়া ও ভৈরব, জামালপুরের বকশীগঞ্জ ও মাদারগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
কুষ্টিয়ার ২৫০ শয্যা হাসপাতাল, দৌলতপুর, খুলনা জেলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, খুলনার ফুলতলা, চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা, বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ, যশোরের অভয়নগর উপজেলা, বরিশালের উজিরপুর, পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ, পিরোজপুরের নাজিরপুর ও মঠবাড়িয়া, বিয়ানীবাজার ৫০ শয্যা হাসপাতাল, সুনামগঞ্জের ছাতক ও মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
দিনাজপুরের বিরামপুর ও বীরগঞ্জ, ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ, রাজশাহীর বাঘা, পুঠিয়া ও পবা, চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর, নওগাঁর মহাদেবপুর, বগুড়ার ধুনট, নন্দীগ্রাম ও শাজাহানপুর, পাবনার ঈশ্বরদী, চাটমোহর ও ভাঙ্গুরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
সুত্র: আজকের পত্রিকা