কভিডকালে সারা দেশে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) চরম সংকট দেখা দেয়। একটি আইসিইউ শয্যা পেতে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটতে হয় সংকটাপন্ন রোগীদের। আইসিইউ শয্যার আশায় সংকটাপন্ন রোগীর ভিড় জমে বিভাগীয় ও রাজধানীর বিশেষায়িত হাসপাতালে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় সীমিত শয্যা থাকায় সেবা পাওয়ার আগেই বহু মৃত্যু হয় করোনা আক্রান্ত রোগীর। এমন অবস্থায় ২০২০ সালের ২৭ এপ্রিল এক ভিডিও কনফারেন্সে প্রতিটি জেলায় ১০ শয্যার আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের নির্দেশ দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে ওই বছরের ২ জুন একনেক সভায় বিষয়টি ওঠে। এরপর শুরু হয় তোড়জোড়।
সে সময়েই বিশ্বব্যাংকের দেওয়া ঋণে ‘কভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস (ইআরপিপি)’ শীর্ষক প্রকল্প শুরু হয়। এই প্রকল্পের আওতায় টিকা কেনা, জেলা হাসপাতালগুলোতে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন, ১০ শয্যার আইসিইউ ও ২০ শয্যার আইসোলেশন ইউনিট স্থাপনের কথা। ৬ হাজার ৩৩৮ কোটি ৬৪ লাখ টাকা বরাদ্দের এই প্রকল্পের মেয়াদ শুরুতে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ছিল, পরে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়াতে সম্মত হয় বিশ্বব্যাংক। ফলে চলতি বছরই শেষ হচ্ছে প্রকল্প। সাড়ে চার বছর আগে সারা দেশের জেলা সদর হাসপাতালে ১০ শয্যার আইসিইউ ইউনিট স্থাপন প্রকল্পের আওতায় বরাদ্দ দেওয়া হয় প্রায় ৫১২ কোটি টাকা। কভিড নেই, প্রকল্পেরও মেয়াদ শেষের পথে। কিন্তু দীর্ঘ সময়ে প্রকল্পটি শেষ করা সম্ভব হয়নি। সব জেলায় অবকাঠামো হলেও আইসিইউ শয্যা স্থাপন করা সম্ভব হয়েছে মাত্র ১৩ জেলা সদর হাসপাতাল ও ১০ মেডিকেল কলেজে। প্রকল্পের ৩৭ জেলার মধ্যে অবকাঠামো তৈরির পরও ৩৩ জেলায় হচ্ছে না আইসিইউ শয্যা আর চার জেলায় নেই অবকাঠামো তৈরি করার মতো জায়গা। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের গাফিলতিতে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করা সম্ভব নয় বলছে বিশ্বব্যাংক। তাই এ কাজ না করার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। ফলে ফেরত যাচ্ছে প্রকল্পের দেড়শ কোটি টাকা।
জানা যায়, প্রকল্পের শুরুতে জেলা হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ স্থাপনের সক্ষমতা যাচাইয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। যাচাই শেষে গণপূর্ত অধিদপ্তর একাধিক চিঠিতে ৬২টি জেলা হাসপাতালের মধ্যে ১২টিতে অবকাঠামো বিদ্যমান থাকলেও আইসিইউ ইউনিট স্থাপন করা যাবে না। কারণ ভবনগুলো অনেক পুরোনো। সেখানে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন লাইন বসানোও সম্ভব নয়। এর মধ্যে আবার চারটি জেলায় একেবারে অযোগ্য। এরপর ৫০ জেলা ও ১০ মেডিকেল কলেজে আইসিইউ শয্যা স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়। প্রকল্পের আওতায় ১০ মেডিকেল কলেজ ও ১৩ জেলায় আইসিইউ স্থাপনও করা হয়। ৩৭ জেলার চার জেলা হাসপাতালে আইসিইউ শয্যার অবকাঠামো করার জায়গা নেই। বাকি ৩৩ জেলা হাসপাতালে যন্ত্রপাতি ক্রয়ের বিষয়ে প্রাথমিক দরপত্র আহ্বান সভায় সরবরাহকারীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে একাধিকবার সংশোধন করার প্রয়োজন হওয়ায় দরপত্র দাখিলের সময় বৃদ্ধি করতে হয়। সবশেষ গত ১৫ জুলাই দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় বিপিপিএ (বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটি) থেকে দরপত্র দাখিলের সময় অটোমেশনের কারণে আবারও দরপত্র দাখিলের সময় বৃদ্ধি করতে হয়। দরপত্র দাখিলের সময় বৃদ্ধি পাওয়ায় চুক্তি থেকে মালপত্র সরবরাহ শেষ করা পর্যন্ত বাস্তবায়ন সময় কমে যায়। ফলে আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে পণ্য সরবরাহ সম্ভব হবে না মর্মে আশঙ্কা থেকেই বিশ্বব্যাংক ক্রয় প্রক্রিয়া বাতিলের পরামর্শ দেয়।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ৫০ জেলা সদর হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট স্থাপন বাস্তবায়নে চার সদস্যের পর্যালোচনা কমিটি রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিও কমিটিকে ছাড়পত্র দিয়েছেন। চলতি বছরের মার্চে আইসিইউ শয্যার যন্ত্রপাতি কেনাকাটার দরপত্রও আহ্বান করা হয়। এরপর মে মাসে মন্ত্রণালয় থেকে বিশ্বব্যাংক অনুমোদিত কারিগরি নির্দেশনা কমিটি (স্পেসিফিকেশন কমিটি) বাদ দিয়ে নতুন কমিটি করার নির্দেশ দেয়। এতে সময়ক্ষেপণ হয়। এ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংক। জটিলতা তৈরি হওয়ায় বাতিল করতে হয় ওই দরপত্র। সবশেষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে দরপত্র আহ্বান করা হয়। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় সেই দরপত্রও পেছাতে হয়। এদিকে আগামী ডিসেম্বরে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে। এই সময়ে জেলাগুলোতে আইসিইউ শয্যা স্থাপন করা সম্ভব নয়। কভিডের প্রকল্প, তাই নতুন করে আর সময় বাড়াতে রাজি নয় বিশ্বব্যাংক। এমনিতেই টেন্ডার ওপেনিং হলে ট্রায়াল রিভিউ ও এলসি খোলা নিয়ে জটিলতা পোহাতে হয়। এর মধ্যেই মন্ত্রণালয়ের এমন পদক্ষেপ। মার্চের দরপত্রে আপত্তি না জানালে এতদিনে প্রায় সব জেলায় আইসিইউ শয্যা স্থাপন করা হয়ে যেত। কাজ না হওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্লিপ্ততাকে দুষছেন তারা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হসপিটাল সার্ভিস ম্যানেজমেন্টের প্রোগ্রাম ম্যানেজার এবং প্রকল্পের কারিগরি নির্দেশনা কমিটির সদস্য সুপ্রিয় সরকার বলেন, প্রজেক্টের সময়সীমা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। কভিড তো প্রায় আড়াই বছর আগে শেষ হয়ে গেছে, বিশ্বব্যাংক প্রজেক্টের সময়সীমা বাড়াতে চাইছে না। ডিসেম্বরের মধ্যে কভিড প্রজেক্ট শেষ হয়ে যাবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যেসব কাজ বা যন্ত্রপাতি কেনাকাটা ও স্থাপন করা সম্ভব নয়, সেসব কাজ বন্ধ রাখতে বলেছে বিশ্বব্যাংক। কারণ, ডিসেম্বরের পরে কাজ শেষ হলে ওই কাজের পেমেন্ট বিশ্বব্যাংক করবে না। পরে সরকারকেই বিল দিতে হবে। জটিলতা এড়াতে কাজটি করা যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, আরেকটি জটিলতা আমরা আইসিইউ স্থাপনের জন্য অবকাঠামো তৈরি করলাম, তারপরও যদি সার্ভিস চালু করতে না পারি, তাহলে এই অবকাঠামোর কী হবে? অবকাঠামো তৈরির উদ্দেশ্য তো রোগীকে সেবা দেওয়া। সেটাই যদি দিতে না পারি, তাহলে তো টাকাটা অপচয় হলো।
ইআরপিপি প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ গোলাম নবী (তুহিন) বলেন, ইতোমধ্যে ৫০ জেলার অবকাঠামো চূড়ান্ত হয়েছে। দরপত্রও আহ্বান করা হয়েছিল। মন্ত্রণালয়ের কিছু শর্ত দাতাদের পছন্দ হয়নি। বিশ্বব্যাংক অনুমোদিত কারিগরি নির্দেশনা কমিটি বাতিল করে নতুন কমিটি করার কথা বলায় বিশ্বব্যাংক বিস্ময় প্রকাশ করে। পরে ওই দরপত্রও বাতিল করতে হয়। এখন তো সময়ও নেই, বিশ্বব্যাংকও সময় বাড়াতে রাজি নয়। নয়তো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই ৫০ জেলায় আইসিইউ স্থাপন করা হয়ে যেত। সরকার চাইলে এখন অপারেশন প্ল্যানের (ওপি) আওতায় করতে পারে। তবে নতুন করে আরেকটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে। জরুরিভিত্তিতে স্বাস্থ্যে কী দরকার, তা জানতে চেয়েছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন। আমরা আইসিইউ স্থাপনের কথা বলেছি। তবে তারা অর্থ দেবে কি না, এখনো জানায়নি।
ইআরপিপি প্রকল্পের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এখন পর্যন্ত ১৩টি জেলা ও ১০টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দশ শয্যা করে ২৩০টি শয্যা স্থাপন করা হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে ৫৭ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। গত বছর ১৪ নভেম্বর ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী এই সেবার উদ্বোধন করেন। এসব আইসিইউ বর্তমানে চালু রয়েছে। প্রকল্পের আওতায় আইসিইউ স্থাপন করা হয়েছে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, টাঙ্গাইল শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মানিকগঞ্জ কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। অন্যদিকে ১৩ জেলার মধ্যে রয়েছে গোপালগঞ্জ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল, মাদারীপুর সদর হাসপাতাল, মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল, নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল, টাঙ্গাইল ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল, কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতাল, ফেনী ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল, নোয়াখালী ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল, সুনামগঞ্জ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল, বাগেরহাট সদর হাসপাতাল, চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল, ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল এবং শেরপুর জেলা হাসপাতাল।