ডায়াবেটিস এমন একটি শারীরিক অবস্থা, যা সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হয়। সারা বিশ্বে এ রোগে প্রতি বছর ১০ লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। শরীর যখন রক্তের সব চিনিকে (গ্লুকোজ) ভাঙতে ব্যর্থ হয়, তখনই ডায়াবেটিস হয়। এ জটিলতার কারণে মানুষের হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক হতে পারে। এছাড়া ডায়াবেটিসের কারণে মানুষ অন্ধ হয়ে যেতে পারে, নষ্ট হতে পারে কিডনিও। নতুন একটি গবেষণা বলছে, ওষুধ ছাড়াই টাইপ টু ডায়াবেটিস থেকে চিরতরে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। যদিও এটি নিয়ে এখনো আরো বিস্তর গবেষণা প্রয়োজন
১৯৮০-২০১৪ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা ১১ কোটি থেকে বেড়ে ৪২ দশমিক ২ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ৯০ শতাংশ মানুষ টাইপ টু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ডায়াবেটিসকে মহামারী হিসেবে উল্লেখ করা হলেও এ রোগ থেকে উত্তরণের কার্যক্রম খুব সীমিত। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে অন্য যেকোনো পদ্ধতি ব্যর্থ হলেও খাদ্যাভ্যাস ও জীবনধারা পরিবর্তন সফল হতে পারে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
কয়েক বছর আগে প্রকাশিত ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রথম ফলে দেখা যায়, কোনো ধরনের ওষুধ গ্রহণ ছাড়াই নিবিড়ভাবে ওজন হ্রাসের মাধ্যমে টাইপ টু ডায়াবেটিস থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। এ ট্রায়ালকে ডায়াবেটিস রেমিশন ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বলা হয় এবং এটার অন্যতম সহনেতা ছিলেন যুক্তরাজ্যের নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রয় টেইলর। তবে এ উপশমটি কীভাবে ঘটে এবং এটা কি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে? কিছু মানুষ অন্যদের থেকে কেন স্থায়ী উপশম লাভ করে? বা এ রোগ কি আবারো ফিরে আসতে পারে? ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ডাটা, কাটিং-এজ ইমেজিং এবং রক্ত পর্যবেক্ষণ কৌশল ব্যবহার করে অধ্যাপক টেইলর তার দলকে নিয়ে এ প্রশ্নগুলো উত্তর খোঁজা শুরু করেছিলেন। সম্প্রতি সেই গবেষণাটি সেল মেটাবলিজম জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
‘টুইন সাইকেল হাইপোথিসিস’ পরীক্ষা
এ গবেষণার লক্ষ্য ছিল এক দশকেরও বেশি সময় আগে প্রকাশ হওয়া অধ্যাপক টেইলর ও তার দলের ‘টুইন সাইকেল হাইপোথিসিস’ নতুন করে পরীক্ষার মাধ্যমে পুনরায় নিশ্চিত হওয়া। গবেষণাটি প্রস্তাব করেছিল, লিভারে ফ্যাট জমা হওয়ার ফল হলো টাইপ টু ডায়াবেটিস, যা ইনসুলিন প্রতিরোধ করে এবং রক্তে শর্করার উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়।
লিভারের চর্বিগুলোর এ বর্ধিত স্তরের কারণে লিপিডগুলো অগ্ন্যাশয়সহ বেশ কয়েকটি টিস্যুতে ছড়িয়ে পড়ে। আর ইনসুলিন তৈরি করা বিটা কোষগুলোর অবস্থান এ অগ্ন্যাশয়েই। এ কারণে স্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিডগুলোর দীর্ঘমেয়াদি প্রকাশ বিটা কোষগুলোর জন্য ক্ষতিকর। গবেষকরা টাইপ টু ডায়াবেটিসের পুনরাবৃত্তির মূল প্যাথফিজিওলজিক প্রক্রিয়াগুলো বর্ণনা করতে চেয়েছিলেন, যা প্রাথমিকভাবে উপশম বা নিরাময় হলেও সেটা আবার ফিরে এসেছিল। এর কারণ উদ্ধারে গবেষকরা ১২-১৪ মাস এমআরআই স্ক্যান ব্যবহার করে অন্তঃকোষ এবং পেটের ফ্যাটকে পরিমাপ করেছেন। বিশেষভাবে তারা অগ্ন্যাশয় ও লিভারের চর্বি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন।
বিশ্লেষণে গ্লুকোজ, এইচবিএ১সি, উচ্চ ঘনত্বের লাইপোপ্রোটিন (এইচডিএল) কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের পরিমাপ অন্তর্ভুক্ত ছিল। দলটি ফ্যাটি অ্যাসিড, ইনসুলিন নিঃসরণ এবং বিটা-সেল ফাংশনও বিশ্লেষণ করেছিল।
লিভার ফ্যাট অগ্ন্যাশয়কে অচল করে দেয়
সমীক্ষায় উঠে এসেছে, পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী সিংহভাগ মানুষেরই দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে ডায়াবেটিস ছিল না, তবে এটি কেবল লিভার ও অন্ত্রে ফ্যাট কম থাকাতেই সম্ভব হয়েছিল। বিশেষভাবে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে যারা ১৫ কেজি বা তার বেশি ওজন কমাতে সক্ষম হয়েছিলেন, তাদের ১০ জনের মধ্যে নয়জনই এ ফল পেয়েছিলেন। এর দুই বছর পর অংশগ্রহণকারীদের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি মানুষ ডায়াবেটিসমুক্ত ছিল। অথচ ডায়াবেটিসের ওষুধ গ্রহণে টানা ২৪ মাস সময় প্রয়োজন হয়। তবে এর বাইরে যাদের ডায়াবেটিস ফিরে এসেছিল, তাদের উচ্চ লিভার ট্রাইগ্লিসারাইড এবং উচ্চ ইন্টারপ্যানক্রিয়াটিক ফ্যাট স্তর ছিল।
অধ্যাপক টেইলর ব্যাখ্যা করেছেন, ‘গবেষণায় আমরা দেখেছি, যখন কোনো ব্যক্তির শরীরে ফ্যাট জমতে থাকে, তখন সেটি ত্বকের নিচে নিরাপদে সংরক্ষিত হতে থাকে। এটা পরে প্রয়োজন অনুযায়ী শরীরের যেকোনো অংশে যেতে পারে। ত্বকের নিচে নিরাপদ এ ফ্যাট জমার পরিমাণ ব্যক্তিভেদে আলাদা হয়ে থাকে, এটাকে ‘পারসোনাল ফ্যাট থ্রেশহোল্ড’ বলা হয়। তবে নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে বেশি হয়ে গেলেই ফ্যাট ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠে।’
তিনি বলেন, ‘ত্বকের নিচে ফ্যাট নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি হয়ে গেলে সেটি লিভারের ভেতরে সংরক্ষিত হতে থাকে এবং অগ্ন্যাশয়সহ শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে যায়। এটা অগ্ন্যাশয়কে পুরো ব্লকড বা অচল করে দেয় এবং কার্যকর ইনসুলিন তৈরিতে জড়িত জিনগুলো বন্ধ করে দেয়। এটাই টাইপ টু ডায়াবেটিসের কারণ।’
‘ডায়েট এবং সেটা ধরে রাখা’ স্থায়ী সমাধান
গবেষক রয় টেইলর জোর দিয়ে বলেন, গবেষণার এ ফলের অর্থ হলো, আমরা এখন টাইপ টু ডায়াবেটিসের সহজ সূত্র দেখতে পাচ্ছি, যেখানে ব্যক্তির নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে বেশি চর্বি জমছে। এক্ষেত্রে ডায়েট ও সেটা ধরে রাখার মাধ্যমে রোগীরা চর্বি কমাতে সক্ষম হচ্ছে এবং তাদের ডায়াবেটিসকে চিরতরে বিদায় জানাতে পারছে। যত দ্রুত এ ফ্যাট কমানো যাবে, ক্ষতির আশঙ্কা ততই কমে আসবে।
অধ্যাপক টেইলর ও তার দল গবেষণার উপসংহারে বলেছেন, ‘প্রথমবারের মতো আমরা এ রোগের বিপর্যয় এবং পুনরায় উত্থানের পুরো চক্র চলাকালীন অন্তর্নিহিত শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনগুলো তুলে আনতে সক্ষম হয়েছি।’
এটা নিয়ে বিস্তর পরীক্ষা করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস) এমন একটি প্রোগ্রাম তৈরি করবে, যার মাধ্যমে তারা টাইপ টু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হাজার হাজার মানুষের ওপর এ ‘ওয়েট লস থেরাপি’ পরীক্ষা করবে।