বিশ্বব্যাপী শারীরিক অক্ষমতার অন্যতম কারন হল স্ট্রোক। ডব্লিউএইচও মতে, প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী ১৫ মিলিয়ন মানুষ স্ট্রোকের শিকার হন। যার মধ্যে ৫ মিলিয়ন মানুষ মারা যান আর ৫ মিলিয়ন মানুষ স্থায়ীভাবে শারীরিক ভাবে অক্ষম হয়ে পড়েন। ২০১০ সালের Global Burden of Disease Study’র সুপারিশ মতে স্ট্রোক হল বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারন। অ্যাডজাস্টেড লাইফ ইয়ারস হিসেবে স্ট্রোক হল অকাল মৃত্যু ও অক্ষমতার তৃতীয় কারন। নিউরোলজিকাল রোগীদের মধ্যে সেরিব্রভাস্কুলর ডিজিস বা স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীরাই সর্বাধিক মারা যান যা বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর শতকরা প্রায় ৪.১।
স্ট্রোক কি?
মস্তিষ্কের কোন অংশে রক্ত সরবরাহ বাধা প্রাপ্ত হলে বা বন্ধ হলে মস্তিষ্কের টিস্যু গুলো অক্সিজেন ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপাদান পায় না ফলে স্ট্রোক হয়। স্ট্রোকের কিছুক্ষণের মধ্যেই মস্তিষ্কের কোষ গুলো মরতে শুরু করে। এটা ঘটে যখন মস্তিষ্কে একটি অংশে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়:
ইসকেমিক স্ট্রোক (Ischemic stroke); মস্তিষ্কে ব্লকেজের দ্বারা অথবা হিমোরেজিক স্ট্রোক (Hemorrhagic Stroke); রক্তপাতের দ্বারা এমন ঘটলে, মস্তিষ্কে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন পায়না এবং মস্তিষ্কে কোষগুলি বন্ধ হতে শুরু করবে এবং মরে যাবে-
যে সব কারনে স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি:
পরিবর্তন যোগ্য কারনঃ
• উচ্চরক্তচাপ (হাইপারটেনশন) ধমনির ভিতর আস্তরণ সৃষ্টি করে (অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস) এবং ধমনির উপর বাড়তি চাপ দেয়
• উচ্চ কোলেস্টেরল
• ডায়াবিটিস (টাইপ১ এবং টাইপ২ )
• অ্যাট্রিয়াল ফিব্রিলেশন (অনিয়মিত হৃদস্পন্দন )
• হৃদরোগ
জীবনযাত্রার পরিবর্তন:
• ধূমপান, মদ্যপান , মাদক দ্রব্য সেবন , শারিরিক অসক্রিয়তা স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়.
• মহিলাদের জন্য অস্ট্রোজেন থাকা গর্ভনিরোধক, এবং হরমোন রিপ্লেসমেন্টথেরাপি।
অপরিবর্তনীয় কারন:
• দুর্ভাগ্যবশত, যে সব কারনে স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি হতে পারে যা বদলাতে পারা সম্ভব না; এগুলি হল :
• পারিবারিক ইতিবৃত্তঃ পরিবারের কারও স্ট্রোক হয়ে থাকলে তাদের বেশি ঝুঁকি থাকে।
• বয়সঃ বয়স বাড়ার সাথে সাথে ধমনিগুলি শক্ত হয় এবং তার ভিতরে আস্তরণ পড়ে, যার অর্থ বয়স্ক মানুষদের স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
• লিঙ্গঃ ৬৫ বছরের কম বয়সের মানুষদের ক্ষেত্রে মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের বেশি স্ট্রোক হয়।
• জাতিগত পরিচয়ঃ দক্ষিণ এশিয় বা আফ্রিকান–ক্যারিবিয়ান স্ট্রোকের ঝুঁকিবেশি
স্ট্রোক হলে সাধারণত নিচের লক্ষণ ও উপসর্গ গুলো দেখা যায় :
• হাঁটতে বা চলাফেরা করতে এবং ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমস্যা হয় এবং মাথা ঝিমঝিম করে
• কথা জড়িয়ে যায় এবং অস্পষ্ট শোনায়
• শরীরের একপাশ দূর্বল, অসাড় ও প্যারালাইজড হয়ে যায়
• চোখে কোন কিছু অস্পষ্ট, অন্ধকার ও দুইটি দেখা যায়
• অস্বাভাবিকমাথা ব্যথার সাথে ঘাড়ব্যথা, মুখব্যথা, দুইচোখের মধ্যখানে ব্যথা, বমি হয়
স্ট্রোকের ঝুকি কমানোর উপায় কি?
স্বাস্থ্যসম্মত জীবনব্যবস্থা বজায় রাখলে অনেক খানি ঝুকি কমানো যায় :
• ব্লাড প্রেসার জানা এবং কন্ট্রোল করা
• ধুমপান না করা
• কোলেসটেরল এবং চর্বি জাতীয় খাবার না খাওয়া
• নিয়ম মাফিক খাবার খাওয়া
• সতর্ক ভাবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা
• নিয়ম করে হাটা বা হালকা দৌড়ানো
• দুশ্চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করা
• মাদক না নেয়া , মদ্য পান না করা
স্ট্রোক পরবর্তী ব্যথা:
লোকাল বা মেকানিকাল ব্যথা সাধারণত জয়েন্ট গুলির মধ্যে অনুভূত হয়। স্ট্রোক থেকে বেঁচে যাওয়াদের মধ্যে কাঁধের ব্যথা বিশেষত সাধারণ। সেন্টাল পোস্ট-স্ট্রোক পেইন (সিপিএসপি) মস্তিষ্কের ক্ষতির কারণে স্বল্প, মাঝারি বা গুরুতর ব্যথা হিসাবে বর্ণনা করা হয়। স্ট্রোক দ্বারা আক্রান্ত শরীরের অংশ বা সমস্ত অংশে ব্যথা অনুভব হতে পারে।
ব্যথার প্রকার গুলি:
আঘাতের ব্যথা (Injured Pain) : রোগীর দেহের টিস্যুর ক্ষতির কারনে এধরণের ব্যথা অনুভব হয়।একে নোকিসেপটিভ (Nociceptive pain) ব্যথাও বলা হয়।
এই ধরণের ব্যথা সাধারণত :
• সোল্ডার সাবলাক্সেশন (Shoulder subluxation): রোগীর বাহু রোগীর কাঁধের সকেট থেকে বেরিয়ে আসে।
• ফ্রযেন সোল্ডার (Frozen Shoulder)- রোগীর কাঁধটি শক্ত ও বেদনাদায়ক হয়ে ওঠে ।
• কন্ট্রাকচার (Contracture): পেশী সংক্ষিপ্ত হয়ে জয়েন্টকে একটি অবস্থানে fixed রাখে।
• হাই অথবা লো টন (High Tone or Low Tone): পেশী শক্ত অথবা নরম হয়ে যায় ।
নিউরোপেথিক পেইন (Neropathic pain):
স্ট্রোকের পরে মস্তিষ্কের ব্যথা-প্রক্রিয়াজাত করণের রাস্তাগুলো বন্ধ হয়, একে সেন্ট্রাল পোস্ট স্ট্রোক পেইন (সিপিএসপি) বা স্নায়ুর ব্যথাও বলা হয়। স্ট্রোকের পরে সংবেদন কমে গেলে এই ধরণের ব্যথা প্রায়শই ঘটে। মস্তিষ্কটি সাধারণ সংবেদনশীল ইনপুটগুলি গ্রহণ করতে অভ্যস্ত হয় এবং যখন তা না হয় তখন মস্তিষ্ক নিজেই বেদনাদায়ক সংবেদনগুলি তৈরি করে। সিপিএসপ স্ট্রোকের কয়েকদিন, মাস বা বছর পরে শুরু হতে পারে।
হাত ফুলে যাওয়া (Swellon Hand): স্ট্রোকের পরে হাতের পেশি পর্যাপ্ত রক্ত প্রবাহ না পাওয়ার কারনে হাতের টিস্যু গুলিতে তরল জমে হাত ফুলে যেতে থাকে যার ফলে হাতে তীব্র ব্যথা অনুভব হয়।
মাথা ব্যথা:
মস্তিষ্কে রক্ত নালীর দেওয়াল ভেঙে হেমোর্র্যাজিক স্ট্রোক হয়।মস্তিষ্কের আস্তরণের জ্বালা, বা আস্তরণের উপর চাপ পরে মাথা ব্যথার কারণ হতে পারে।ইস্কেমিক স্ট্রোক রক্তজমাট বাঁধার কারণে ঘটে যা মস্তিষ্কের একটি রক্তনালীকে ব্লক করে। রক্ত জমাট বাঁধার এই জমাট বা অশ্রু গুলি তখন মাথা ব্যথার কারণ হতে পারে। মাথা ব্যথা ওষুধেরও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে।
তীব্রযন্ত্রনা ও দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা: দীর্ঘ সময়ের সাধারণত তিন মাস বা তার বেশি তীব্র ব্যথাই দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা।
চিকিৎসা পদ্ধতি:
একজন স্ট্রোক রোগীর চিকিৎসার জন্য মাল্টি ডিসিপিস্ননারি টিম (MDT) পদ্ধতিতে চিকিৎসা প্রয়োজন। এই টিমে থাকেন নিউরোলজিষ্ট, জেনারেল ফিজিশিয়ান, ফিজিওথেরাপিষ্ট, অকুপেশনাল থেরাপিষ্ট, নার্স, ভোকেশনাল ট্রেইনার ইত্যাদি। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, ঔষধ স্ট্রোক রোগীকে মেডিকেলি ষ্ট্যাবল করতে পারলেও তার শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা ফিরিয়ে আনতে পারে না। স্ট্রোক পরবর্তী সমস্যাগুলো দূর করে শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজন সঠিক ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা।
ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকরা ব্যথার কারণ সনাক্ত করার জন্য রোগীকে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন এবং বিভিন্ন শারীরিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে থাকেন।
স্ট্রোক পরবর্তী দীর্ঘস্থায়ী ব্যথায় ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা:
একজন কোয়ালিফাইড ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক রোগীর সমস্যা অনুযায়ী চিকিৎসার পরিকল্পনা বা ট্রিটমেন্ট প্লান করে থাকেন এবং সেই প্লান অনুযায়ী সঠিক ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা সেবা প্রদান করে থাকেন।
• স্ট্রোকে আক্রান্ত ব্যক্তি ও তাদের পরিবার বা কেয়ারারদের সঠিক ম্যানুয়াল হ্যান্ডলিং এবং পজিশনিং সম্পর্কিত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা।
• সঠিক পজিশনিং বা শরীরের সঠিক অ্যালাইনমেন্ট বজায় রাখা।
• শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক করণ
• রোগীকে সঠিকভাবে নড়াচড়া করানো বা Transfering করান।
• পেসিভ বা অ্যাক্টিভ এক্সারসাইজ
• জয়েন্ট মবিলাইজেশন বা ROM এক্সারসাইজ
• মাংস পেশীর স্বাভাবিক দৈর্ঘ্য বজায় রাখা অর্থাৎ রেগুলার Streching exercise করানো।
• শরীরের বিভিন্ন জয়েন্টের স্বাভাবিক নাড়ানো বা মাংস পেশীর স্বাভাবিক টান ফিরিয়ে আনা
• শরীরের স্বাভাবিক অ্যালাইনমেন্ট ফিরিয়ে আনা
• বিভিন্ন Orthotics devices অথবা স্প্লিন্ট সহ অন্যান্য সহায়ক সামগ্রী ব্যবহার করা
• Electrical Modalities অর্থাৎ TENS, Deep Brain stimulation (DBS).
• প্রয়োজন হলে ঠাণ্ডা বা গরম সেঁক দেওয়া
• পারিবারিক ও মানসিক Support অথবা কাউন্সেলিং করানো।
• Cognitive Behavioral Therapy
• Psychotherapy: মনস্তাত্ত্বিক থেরাপিগুলি ব্যথার সাথে সম্পর্কিত চিন্তাভাবনা,বিশ্বাস এবং আচরণগুলি পরিবর্তন করতে সহায়তা করে এবং রোগীর মানসিক অবস্থা উন্নত করে।
• বায়োফিডব্যাক থেরাপি
• স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট এবং রিলাক্সাশন থেরাপি
• শারিরিকভাবে সক্রিয় থাকা যা দেহের এন্ডোরফিন বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবে ব্যাথা কমাতে সাহায্য করে।
স্ট্রোক পরবর্তী ব্যাথায় সঠিক ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা রোগীর উন্নত জীবনযাপনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
লেখক: মো. আব্দুল ফাত্তাহ
সিনিয়র ফিজিওথেরাপিষ্ট, সিআরপি- মিরপুর।