ডেঙ্গু বর্তমানে মহামারী ধারণ করেছে। এ বছর দেখা যাচ্ছে ডেঙ্গুর লক্ষণ ভিন্ন। ডেঙ্গু জ্বরের স্বাভাবিক যেসব লক্ষণ থাকে, সেগুলো এ বছর অনেক রোগীর মাঝেই পাওয়া যাচ্ছে না। সাধারণত ডেঙ্গু জ্বর হলে রোগীর প্রচণ্ড জ্বর (১০৩ থেকে ১০৬ ডিগ্রি), শরীর এবং গিরায় গিরায় ব্যথা, যাকে বলে হাড়ভাঙা জ্বর বা ব্রেকবোন ফিভার, চার থেকে পাঁচ দিন পরে জ্বর কমে যায় এবং গায়ে র্যাশ ওঠে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, সারা বিশ্বে প্রায় ৫০ থেকে ১০০ মিলিয়ন মানুষ প্রতিবছর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়। এ রোগের অন্যতম বাহক হচ্ছে এডিস মশা। এই মশা কামড়ালে ডেঙ্গুর ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। সাধারণত এডিস মশা কামড়ানোর ৪ থেকে ৭ দিনের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গ দেখা যায়। উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে তীব্র জ্বর, মাথাব্যথা, শরীরে ছোট ছোট লাল ফুসকুড়ি (rash), মাংসপেশী এবং অস্থি-সন্ধিতে ব্যথা ইত্যাদি।
তবে এখন ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গ বদলে গিয়েছে। অনেকসময় রোগীরা বিভিন্ন ধরনের জটিলতা নিয়ে আসে। যেমন, ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিবার। এতে শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে রক্তক্ষরণ হতে থাকে। অথবা ডেঙ্গু শক সিনড্রোম (DSS)- এতে অনবরত বমি, তীব্র পেট ব্যাথা, নাড়ীর গতি কমে যাওয়া, রক্তচাপ কমে যাওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়। সাধারনত জ্বর কমে যাওয়ার পর এসব জটিলতা দেখা দেয়।
গর্ভবতী নারীরা কেন বেশী ঝুঁকিপূর্ণ?
গর্ভাবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই নারীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় (Low immunity instead of low immunite.). এই সময়ে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে প্রসূতি মা এবং গর্ভস্থ শিশুর নানা ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন-
১. ডেঙ্গু রোগের উপসর্গ অনেকটা প্রেগন্যান্সির কিছু উপসর্গের সাথে মিল রয়েছে, তাই রোগ নির্ণয় দেরী হতে পারে।
২. প্রেগন্যান্সিতে রক্তের CBC রিপোর্টে পরিবর্তন হয়। তাই ডেঙ্গু রোগীদের রক্ত রিপোর্ট যেমন হয়, তার সাথে সবসময় নাও মিলতে পারে।
৩. আবার ডেঙ্গু রোগীদের প্লাটিলেট কমে, লিভার ফাংশন খারাপ হতে পারে, পেটে পানি জমা হতে পারে, এইসব গর্ভবতীর হেলপ সিনড্রোম ( HELLP Syndrom) এর সাথে মিলে যায়, যা খুব ঝুঁকিপূর্ণ একটা অবস্থা।
৪. গর্ভবতী নারীদের যদি রক্তক্ষরণ শুরু হয়, তা মা ও বাচ্চা দুইজনের জন্যই ভীষণ ঝুঁকিকর, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।
৫. আবার একজন গর্ভবতীরোগীর যে কোন অসুখ বা সমস্যা তার গর্ভস্থ শিশুটির জন্যও ঝুঁকির কারণ হয়, তাই চিকিৎসার সময় অনেক কিছু ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
৬. মায়ের অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ – গর্ভকালীন, প্রসবকালীন ( নরমাল বা সিজারিয়ান সেকশন) অথবা প্রসব পরবর্তী সময়ে। বিশেষ করে প্রসূতি মা যদি ডেঙ্গুজনিত জটিলতায় ভোগেন সেক্ষেত্রে রক্তক্ষরণের মাত্রা বেড়ে যায়।
এছাড়াও
কম ওজনের শিশু জন্ম নেয়া (Low birth weight baby).
অকাল প্রসব (Preterm birth).
গর্ভস্থ শিশুর মস্তিষ্ক/স্পাইনাল কর্ড পূর্ণাঙ্গভাবে গঠিত না হওয়া।
মৃত সন্তান প্রসব।
গর্ভকালীন সময়ে ডেঙ্গু জ্বরে করণীয়
কোন উপসর্গ ছাড়া জ্বর দেখা দিলে পরিমিত বিশ্রাম নিতে হবে। তাজা ফলমূল খান। নিয়মিত দুই থেকে তিন লিটার ফলের রস, স্যুপ, ওরস্যালাইন, লেবুর শরবত, ইত্যাদি খেতে হবে। এসবের পাশাপাশি স্বাভাবিক নরম খাবার দিন।
জ্বর ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তার চেয়ে বেশি হলে সারা শরীর বিশেষ করে হাতের তালু, পায়ের তালু, মাথা স্বাভাবিক পানিতে কাপড় ভিজিয়ে মুছে দিন।
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী শুধুই ব্যাথানাশক ওষুধ, প্যারাসিটামল ট্যাবলেট (Acetaminophen) খেতে দিন।
গর্ভবতী নারীর রক্তের জেনে চার থেকে পাঁচজন ডোনার খুঁজে রাখুন যেন যেকোন জরুরী অবস্থায় রক্ত পাওয়া যায়।
অতিশয় সতর্কতা- ডেঙ্গুর এই সময়ে প্রসূতি মা জ্বরে আক্রান্ত হলে দ্রুত চিকিৎসকের সরনাপন্ন হোন।
হাসপাতালেও চিকিৎসকগনের প্রতি একই সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ থাকবে। জ্বরে আক্রান্ত গর্ভবতী মাকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করে প্রথম থেকেই ডেঙ্গু ম্যানেজমেন্ট প্রটোকল অনুসরণ করবেন।
শুধুমাত্র ডেঙ্গু জ্বরের কারনে জরুরী ভিত্তিতে ডেলিভারি করানোর কোন প্রয়োজন নেই। সঠিক চিকিৎসা ও যত্ন চালিয়ে যেতে হবে।
কি করবেন?
১. গর্ভবতী নারীকে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
২. জ্বর ও ব্যথার জন্য প্যারাসিটামলের বাইরে আর কিছু দেওয়া যাবেনা।
৩. মুখে স্বাভাবিক খাবারের পাশাপাশি তরল খাবার খেতে হবে।
৪. ক্রিস্টালয়েড স্যালাইন দিতে হবে শিরাপথে, এটা ওজন হিসাব করে ঠিক করতে হবে।
৫. বমি থাকলে ঔষধ দিতে হবে।
৬. রক্তক্ষরণ হলে বা হিমোগ্লোবিন কমে গেলে ফ্রেশ রক্ত দেওয়া যায় ।
৭. প্লাটিলেট অনেক কমে গেলে বা অল্প সময়ের মাঝে অপারেশন করা লাগলে প্লাটিলেট দেওয়া যেতে পারে।
৮. মায়ের পালস, ব্লাড প্রেশার বারে বারে রেকর্ড রাখতে হবে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয়
* ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী এডিস মশা পরিস্কার জমানো পানিতে ডিম পাড়ে। তাই বালতি, ফুলের টব ইত্যাদি জায়গায় নিয়মিত নজর রাখুন।
এই মশা দিনের বেলায় কামড়ায়। তাই দিনের বেলা যতটা সম্ভব হাত-পা ঢাকা হালকা রঙের পোশাক পরুন।
গর্ভাবস্থায় ক্ষতিকারক নয় এমন mosquito repellent (cream/ spray) শরীরে ব্যবহার করতে পারেন।
দিনে এবং রাতে অবশ্যই মশারী ব্যবহার করুন।