রোগের নতুন কারন ও কার্যকর নতুন চিকিৎসা আবিষ্কার গবেষকদের কাছে সবসময় এক ধরনের কঠিন চ্যালেঞ্জ। এর জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করে দীর্ঘ সময় নিয়ে গবেষণা করতে হয়। পাশাপাশি নতুন ঔষধ আবিস্কারের গবেষণার সাথে জড়িত সবার মেধা, শ্রম, কমিটমেন্ট ও স্যাক্রিফাইস। এটা এমনি এমনি একদিনে হয় না। এই লেখাটি পাঠকদের জন্য সহজ ও সাবলীল ভাষায় রোগের নতুন ঔষধ আবিস্কার বা তৈরির পিছনের অজানা কাহিনী নিয়ে।
মানবদেহর গঠন খুব কমপ্লেক্স। এর রোগবালাইও খুব জটিল। তারপর প্রতিনিয়ত ফেস করতে হয় নতুন নতুন অজানা রোগ। কমপ্লেক্স মানবদেহ অসংখ্য ছোট ছোট কোষের দ্বারা তৈরি। এই কোষগুলো একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর মারা যায়। এই পুরনো কোষগুলোর জায়গায় নতুন কোষ এসে জায়গা করে নেয়। সাধারণত কোষগুলো নিয়ন্ত্রিতভাবে এবং নিয়মমতো বিভাজিত হয়ে নতুন কোষের জন্ম দেয়।
সাধারনভাবে বলতে গেলে যখন এই কোষগুলো কোনো কারণে (যেমন – ইনফেকশন, কেমিক্যাল, ড্রাগ বা ফুড) অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়তে থাকে তখনই শরীরে রোগবালাই দেখা দেয়। কোন কোন সময় শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে দলা অথবা চাকা দেখা যায়। এগুলোকে টিউমার বলে। এই টিউমার বিনাইন (নিরীহ) বা ম্যালিগন্যান্ট হতে পারে। ম্যালিগন্যান্ট টিউমারকেই ক্যান্সার বলে। নিরীহ বা বিনাইন টিউমর ক্যান্সার নয়। মেটাস্ট্যাসিস হলো ক্যান্সারের একটি পর্যায়, যখন ক্যান্সার কোষগুলি রক্ত ও লসিকাতন্ত্র (Lymphatic System) ইত্যাদির মাধ্যমে শরীরের আশেপাশে ও দূরবর্তী অঙ্গগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে শরীরে বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দেয়। এসব রোগবালাই ও ক্যান্সারে মানুষের মৃত্যু হয়। রোগবালাই থেকে বাঁচার জন্য গবেষণার মাধ্যমে নতুন চিকিৎসা বা ড্রাগ আবিস্কার করতে হয়।
ড্রাগ একটি রাসায়নিক পদার্থ, যা একটি জীবিত জীবকে দেওয়া হলে একটি জৈবিক প্রভাব (Biological Effect) তৈরি করে। ফার্মাসিউটিক্যাল ড্রাগ, যাকে ঔষধ বলা হয়। যা রোগের চিকিৎসা, নিরাময়, প্রতিরোধ বা রোগ নির্ণয় করতে বা সুস্থতার জন্য ব্যবহৃত হয়। ঐতিহ্যগতভাবে সাধারণত ঔষধগুলি ঔষধি উদ্ভিদ (Extract of plants) থেকে তৈরি করা হয়। তবে সম্প্রতি কৃত্রিম বা সিন্থেটিক (Synthetic) ভাবেও ঔষধ তৈরি করা হয়। ফার্মাসিউটিক্যাল ঔষধগুলি রোগের চিকিৎসার (Acute Diseases) জন্য সীমিত সময়ের জন্য বা দীর্ঘস্থায়ী ব্যাধিগুলির জন্য নিয়মিত ভিত্তিতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
ঔষধ কোটি কোটি মানুষের শরীরে দেওয়া হয় বলে নতুন ঔষধ আবিষ্কার বা তৈরির ক্ষেত্রে অনেক সতর্কতা ও নিরাপত্তা বিষয় মাথায় রাখতে হয়। বেশ কয়েকটি ধাপ পেরিয়ে তবেই ঔষধ ব্যবহারের উপযোগী হয়। তাই সাধারনত নতুন ঔষধ তৈরিতে সাধারণত ১০ থেকে ১৫ বছর সময় লাগে। নতুন ঔষধ তৈরির ক্ষেত্রে মূলত ৬টি ধাপ অনুসরণ করতে হয় যেমন – ১. অনুসন্ধানী, ২. প্রি-ক্লিনিক্যাল, ৩. ক্লিনিক্যাল, ৪. নিয়ন্ত্রক পর্যালোচনা এবং অনুমোদন, ৫. উৎপাদন ও ৬. মান নিয়ন্ত্রণ।
ঔষধ তৈরির জন্য প্রতিটি ধাপই খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই একটা বাদ দিয়ে আরেক ধাপে যাওয়া যায় না। অনুসন্ধানী ধাপকে ঔষধ তৈরির গবেষণার নিবিড় ও প্রাথমিক ধাপ বলা হয়। এই ধাপে প্রাকৃতিক বা সিন্থেটিক পদার্থ সনাক্ত বা তৈরির কাজ করা হয় যা রোগ প্রতিরোধ বা চিকিৎসায় সহায়তা করতে পারে। তারপর প্রি-ক্লিনিক্যাল ধাপ, এই ধাপের প্রথমে গবেষকেরা অনুসন্ধানী ধাপে তৈরি ঔষধ ছোট পশুর (ইদুর, গিনিপিগ বা খরগোশ) দেহে প্রয়োগ করে পশুর রক্ত ঔষধের লেবেল দেখা হয়। এই ঔষধের ছোট পশুর দেহের রোগ প্রতিরোধ করতে পারে কিনা দেখা হয়। ছোট পশুর দেহে ঔষধ কার্যকারী হলে বড় পশুর (বানর) দেহে প্রয়োগ করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, চিকিৎসা, নিরাপত্তা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার বিষয়গুলো দেখা হয়। ঔষধ বড় পশুর দেহে কার্যকারী হলে সাধারণত ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদন চাওয়া হয়ে থাকে। এই ধাপ দুটির পর গবেষকেরা বলতে পারে তারা ঔষধ আবিষ্কারের প্রাথমিক কার্য সফলতার সাথে সম্পূর্ণ করেছে। তার আগে ঔষধ আবিষ্কার করেছে এটা গবেষকেরা বলতে পারে না। এরপর ক্লিনিক্যাল ধাপ, এই ধাপের চারটি অংশ। প্রথম ধাপে পরীক্ষায় ১০ থেকে ২০ জন মানুষের শরীরে ঔষধ প্রয়োগ করে এর নিরাপত্তা ও প্রতিরোধী ক্ষমতা দেখা হয়। দ্বিতীয় ধাপে কয়েক শত মানুষের শরীরে ঔষধ প্রয়োগ করে এর নিরাপত্তা ও ডোজ সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তৃতীয় ধাপে এসে কয়েক হাজার মানুষের শরীরে ঔষধ দিয়ে এর কার্যকারিতা, নিরাপত্তা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা হয়। এ সময় নিয়ন্ত্রিত গ্রুপকে ভিন্ন ওষুধ বা প্লাসেবো দিয়েও পরীক্ষা করে দেখা হয়। তৃতীয় ধাপে যদি ঔষধ নিরাপদ এবং কার্যকর হয় তাহলে অনুমোদন চাওয়া হয় মানুষের দেহে প্রয়োগের, এটা রেগুলেটরী এবং অনুমোদন ধাপ। তারপর উৎপাদন ধাপ, এরপর মান নিয়ন্ত্রণ ধাপ। আমেরিকাতে এফডিএ সাধারণত রেগুলেটরী এবং অনুমোদন, উৎপাদন এবং মান নিয়ন্ত্রণ ধাপ অনুমোদন দেয় ও তদারকি করে থাকে। আর চতুর্থ ধাপে ঔষধ ব্যবহারকারীর দেহে দীর্ঘমেয়াদী প্রতিরোধ ক্ষমতা, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও ঔষধের ব্যবহার মনিটর করা হয়। গবেষকদের গবেষণালব্ধ ফল ধারাবাহিক ভাবে পর্যায়ক্রমে রিসার্চ জার্নালে প্রকাশ করতে হয়। এই ভাবে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে রোগের চিকিৎসার জন্য আবিস্কৃত নতুন ঔষধ ব্যবহারের উপযোগী হয়।
নতুন ঔষধের মানুষের দেহে কার্যকারিতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া জানা থাকে না, তাই নতুন ঔষধের ক্লিনিক্যাল ধাপের পরীক্ষার জন্য সাধারণত স্বেচ্ছাসেবক (volunteer) পাওয়া খুব কঠিন হয়। এই ধাপের পরীক্ষায় স্বেচ্ছায় অংশগ্রহন করে তাদেরকে অনেক সময় জোক করে গিনিপিগ বলা হয়। সম্প্রতি আমিও একটি নতুন ঔষধের ক্লিনিক্যাল ধাপের পরীক্ষার জন্য স্বেচ্ছাসেবক (volunteer) বা গিনিপিগ হলাম। নতুন ঔষধের নাম ও রোগ নিয়ে পরে আরেক দিন বিস্তারিত লিখবো ইনশাল্লাহ।
লেখক : ড. জাহিদ দেওয়ান শামীম
সিনিয়র সাইন্টিষ্ট, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র