লিভারে অতিরিক্ত চর্বি জমে ফ্যাটি লিভার ডিজিজ হয়। লিভারের সব কোষের শতকরা ৫ ভাগের বেশি কোষের মধ্যে চর্বি জমা হলে তাকে ফ্যাটি লিভার ডিজিজ বলে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফ্যাটি লিভার ডিজিজ ২৭-৩৮% পর্যন্ত হতে পারে।
বিভিন্ন কারণে ফ্যাটি লিভার হতে পারে। তবে আমাদের দেশে নন অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ বেশি হয়। বর্তমানে অল্প বয়সের তরুণ তরুণী থেকে শুরু করে বেশি বয়সের মানুষের মধ্যে যে রোগটি ছড়িয়ে পড়েছে তা হলো ফ্যাটি লিভারের সমস্যা। তবে আপনি চাইলে ঘরে বসেই এই সমস্যার সমাধান করতে পারেন।
লিভার বা যকৃত আমাদের পাচন প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এই অঙ্গটি আমাদের শরীরে খাদ্য হজমে সাহায্য করে এবং শরীরের বিষাক্ত পদার্থ দূর করে। কিন্তু ফ্যাটি লিভারে এ কাজ অনেকটাই বাঁধাপ্রাপ্ত হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভ্যাসের অনিয়ম এই রোগটি বৃদ্ধি পাওয়ার একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি লিভারের ওজনের ৫ থেকে ১০ শতাংশ ফ্যাট জমে তা হলে এই অবস্থা লিভার সিরোসিস বা ফ্যাটি লিভারের আকার নিতে শুরু করে।
ফ্যাটি লিভারের কারণসমূহ-
ডায়াবেটিস, অত্যধিক স্থূলতা, রক্তে চর্বির মাত্রা বেশি (মেটাবলিক সিনড্রম)
অ্যালকোহল সেবন
অতিরিক্ত জাংক ফুড ও কোমল পানীয় পান
থাইরয়েড হরমনের সমস্যা
দ্রুত ওজন হ্রাস
পাকস্থলীর সার্জারি
উইলসন ডিজিজ
ক্ষতিকারক ওষুধ- গ্লুকোকর্টিকয়েড, ইস্ট্রোজেন, টেমোক্সিফেন ইত্যাদি
ফ্যাটি লিভার হলে কি হয়?
১. স্বাভাবিক ফ্যাটি লিভার (৮০%)
লিভারে শুধু চর্বি জমে। কোনো প্রদাহ বা ফাইব্রোসিস থাকে না। এই সময় যথাযথ চিকিৎসা না করলে লিভারে প্রদাহ হয়ে ফাইব্রোসিস হতে পারে। এমনকি প্রদাহ না হয়েও সরাসরি লিভার ক্যানসার হতে পারে। এ কারণে স্বাভাবিক ফ্যাটি লিভার হলেও চিকিৎসা না করে বসে থাকার সুযোগ নেই।
২. স্টিয়াটো হেপাটাইটিস (২০%)
এই পর্যায়ে লিভারে প্রদাহ থাকে। প্রদাহ হতে ফাইব্রোসিস হয়। স্টিয়াটো হেপাটাইটিসে আক্রান্ত প্রায় ১১% রোগীর পরবর্তী ১৫ বছরে লিভার সিরোসিস হয়। অতঃপর এদের মধ্যে ৭% রোগী ৬.৫ বছরের মধ্যে লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। এ পর্যায়ে চিকিৎসা গ্রহণ করলে ফাইব্রোসিসের গতি কমানো গেলেও পুনরায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব না।
উপসর্গ
ফ্যাটি লিভারের সাধারণত কোনো উপসর্গ থাকে না। রুটিন চেক আপ বা অন্য কোনো কারণে পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাম করতে গিয়ে ফ্যাটি লিভার ধরা পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে তখন রোগটি অনেক অগ্রসর হয়ে যায়। অন্যান্য উপসর্গের মধ্যে পেট ব্যাথা, দুর্বল লাগা ইত্যাদি।
আগে ফ্যাটি লিভারকে খুব হালকাভাবে দেখা হতো। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে যে, ফ্যাটি লিভার থেকে লিভার সিরোসিস এমনকি লিভার ক্যানসারও হতে পারে। এছাড়া ফ্যাটি লিভার রোগীদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই যাদের ফ্যাটি লিভার আছে তাদের উচিত রোগটি সম্পর্কে জানা এবং চিকিৎসা গ্রহণ করা।
ফ্যাটি লিভারের চিকিৎসা
ফ্যাটি লিভারের চিকিৎসার দুটি অংশ-
১. মেটাবলিক সিনড্রমের চিকিৎসা
– শরীরের অতিরিক্ত মেদের চিকিৎসা
– ইনসুলিন রেজিসটেন্সের চিকিৎসা
– উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা
– রক্তের অধিক চর্বির চিকিৎসা
২. ফ্যাটি লিভারের চিকিৎসা
– জীবনাচার পরিবর্তন
– খাদ্যভাস পরিবর্তন
– নিয়মিত ব্যায়াম করা
– ফার্মাকোলজিক্যআল চিকিৎসা- পাইওগ্লিটাজন, মেটফরমিন, এন্টি অক্সিডেন্ট, আরসোডিঅক্সিকলিক এসিড, ফাইব্রেট।
– সার্জারি- বারিয়াট্রিক সার্জারি
পরিশেষে মনে রাখতে হবে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফ্যাটি লিভার সাধারণ ফ্যাটি হলেও এটিই আমাদের দেশে লিভার সিরোসিসের অন্যতম প্রধান কারণ। তাই আসুন, এখনই আমরা এ রোগটি সম্পর্কে জানি এবং প্রয়োজনে শুরুতেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিই এবং অন্যদেরকেও এ ব্যাপারে উৎসাহিত করি।
ডা. মো. মামুন -উর রশিদ
এফসিপিএস(মেডিসিন), এমডি (গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি) পরিপাকতন্ত্র, লিভার ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ