সাধারণত আমাদের বৃহদন্ত্রে অবস্থিত ই.কোলাই ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণের কারণে ইউরিন ইনফেকশন হয়। তবে অন্যান্য ব্যাক্টেরিয়াও এর জন্য দায়ী হতে পারে যেমন প্রোটিয়াস ইত্যাদি। কিছু কিছু পরজীবীও এই ইনফেকশন ছড়ায়। অনেক সময় আক্রান্ত রোগীর দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কারণেও এ ধরণের ইনফেকশন হতে পারে যখন শরীর সাধারণ ব্যাক্টেরিয়ার আক্রমণ ঠেকানোর ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে।
গর্ভাবস্থায় ইউরিন ইনফেকশন কি স্বাভাবিক?
গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীরে নানা ধরণের হরমোন নির্গত হয়। তাছাড়া ভ্রূণের টিকে থাকার জন্য মায়ের সাধারণ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে যায়। ফলে এসময় ব্যাক্টেরিয়ার আক্রমণে ইউরিন ইনফেকশন হতেই পারে। আবার এসময়ে মায়ের ইউটেরাস বড় হতে থাকে। ফলে ইউরেটারে চাপ লেগে মূত্র আটকে ইউরিন ইনফেকশন হতে পারে। গর্ভাবস্থায় এটি স্বাভাবিক সমস্যা হলেও দ্রুত চিকিৎসা না করালে এটি কিডনি পর্যন্ত ছড়িয়ে পরতে পারে যা গর্ভস্থ শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় ইউরিন ইনফেকশন হলে তা নিরীক্ষণ করা হয় কিভাবে?
ইউরিন ইনফেকশন আছে কি না তা জানার জন্য ডাক্তার সাধারণ প্রস্রাব পরীক্ষা বা ইউরিন এনালাইসিস দিতে পারেন যা গর্ভবতী মায়ের জন্য মোটেও ঝুঁকিপূর্ণ নয়। এর মাধ্যমে প্রস্রাবে ব্যাক্টেরিয়া আছে কিনা এবং প্রস্রাবে অনুচক্রিকা বা শ্বেত রক্তকণিকা আছে কি না তা জানা যায়। এছাড়া ডাক্তার প্রস্রাবের কালচার বা ইউরিন কালচার পরীক্ষাও দিতে পারেন যার মাধ্যমে কী ধরনের ব্যাক্টেরিয়া আক্রমণ করেছে সেটি জানা যায় ও সে অনুযায়ী এন্টিবায়োটিক দেয়া যায়।
চিকিৎসা: গর্ভাবস্থায় সব ধরনের ওষুধ মা ও শিশুর জন্য ঝুঁকিমুক্ত নয়। তাই এসময় ডাক্তাররা সাধারণ এন্টিবায়োটিক দিয়ে থাকেন। এমকজিসিলিন, পেনিসিলিন, এরিথ্রোমাইসিন এধরণের এন্টিবায়োটিকগুলো গর্ভাবস্থায় নিরাপদ বলে ডাক্তাররা এগুলোই প্রেসক্রাইব করে থাকেন। এ ওষুধগুলো রোগের তীব্রতা ও ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ৩-৭ দিন খেলেই ইনফেকশন নিরাময় হয়। তবে খেয়াল রাখতে হবে ডাক্তার যে কয়দিন এ ওষুধগুলো খেতে পরামর্শ দেবেন সে কয়দিনই ওষুধ চালিয়ে যেতে হবে।
কোনোভাবেই তার আগে ওষুধ খাওয়া একবেলার জন্যও বন্ধ করা যাবে না। এছাড়াও গবেষণায় এসেছে সালফামেথোক্সাজোল, ট্রাইমেথোপ্রিম, সিপ্রোফ্লোক্সাসিন, টেট্রাসাইক্লিন ইত্যাদি এন্টিবায়োটিকগুলো গর্ভাবস্থায় ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। তাই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ গ্রহণ করা একদমই উচিত হবে না। এমনকি যদি গর্ভধারণের আগেও কখনো ইউরিন ইনফেকশন হয়ে থাকে তবে সেসময় যে ওষুধে রোগ নিরাময় হয়েছিল সেটি গর্ভাবস্থায় খাওয়া যাবে কিনা তাও ডাক্তারের নিকট থেকে আগে নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে।
প্রতিরোধ
১. প্রচুর পানি পান করতে হবে। দিনে অন্তত ৮ গ্লাস পানি পান করলে তা ইউরিনারি সিস্টেমকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
২. রিফাইন্ড ও প্রিজারভেটিভ যুক্ত খাবার যেমন, পরিশোধিত চিনি, প্যাকেটজাত ফলের জুস, ক্যাফেইন, কোক বা কোমল পানীয়, এলকোহল ইত্যাদি পরিহার করতে হবে।
৩. ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ভিটামিন সি, ক্যারোটিন বি, জিংক ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে।
৪. মূত্রচাপ অনুভবের সাথে সাথে মূত্রত্যাগ করার অভ্যাস করতে হবে।
৫. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে। মূত্রত্যাগের পর পানি বা টিস্যু ব্যবহার করার অভ্যাস করতে হবে।
৬. সঙ্গমের আগে ও পরে মূত্রনিঃসরণ করা উচিত।
৭. সময়মত অন্তর্বাস পরিবর্তন করা উচিত অর্থাৎ একই অন্তর্বাস পরে দীর্ঘসময় থাকা স্বাস্থ্যসম্মত নয়।
৮. সবসময় ঢিলেঢালা পোষাক ও প্যান্ট পরা উচিত।
৯. স্রাবের জায়গা শুকনা রাখতে হবে। প্রয়োজনে টিস্যু ব্যাবহার করতে হবে।
১০. বাথটাবে ৩০ মিনিটের বেশি সময় ধরে গোসল করা উচিত নয়।
মনে রাখতে হবে চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। তাই গর্ভাবস্থায় ইউরিন ইনফেকশন এড়াতে প্রয়োজনীয় উপায় অবলম্বন করাটাই অধিক যুক্তিসম্মত। গর্ভাবস্থায় এমনিতেই দিনে ১২ গ্লাস পানি পান করতে বলা হয়। প্রতিদিন জীবাণুমুক্ত ও বিশুদ্ধ পানি পান করলে ইউরিন ইনফেকশন হবার সম্ভাবনা এমনিতেই কমে যায়। গর্ভাবস্থায় গর্ভবতী মা এমনিতেই অনেক অস্বস্তিকর শারীরিক অবস্থার সম্মুখীন হন। আবার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও এসময় কমে যায়। তাই অন্যান্য রোগ যেন না হয় সে ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করার কোনো বিকল্প নেই। আর সতর্কতা অবলম্বনের জন্য বিভিন্ন রোগ ও তা প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে জানাটাও জরুরি।