ডা. জিএম জাহাঙ্গীর হোসেন
আমাদের শারীরিক সমস্যাগুলোর মধ্যে ঘাড় ব্যথা অন্যতম। মেরুদণ্ডের ঘাড়ের অংশকে সারভাইক্যাল স্পাইন বলে। সাতটি কশেরুকা ও দুই কশেরুকার মাঝখানের ডিস্ক, পেশি ও লিগামেন্ট নিয়ে সারভাইক্যাল স্পাইন বা ঘাড় গঠিত। মাথার হাড় (স্কাল) থেকে মেরুদণ্ডের সপ্তম কশেরুকা পর্যন্ত ঘাড় বিস্তৃত। আট জোড়া সারভাইক্যাল স্পাইন নার্ভ (øায়ু) ঘাড়, কাঁধ, বাহু, নিুবাহু এবং হাত ও আঙুলের চামড়ার অনুভূতি ও পেশির মুভমেন্ট প্রদান করে। এ জন্য ঘাড়ের সমস্যায় রোগী ঘাড়, কাঁধ, বাহু ও হাত বা শুধু হাতের বিভিন্ন উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। ঘাড়ের সমস্যা পুরুষের তুলনায় মহিলাদের বেশি হয়। ঘাড়ে দুই ধরনের ব্যথা হয়Ñ লোকাল বা স্থানীয় ব্যথা এবং রেফার্ড বা দূরের রোগের কারণে ব্যথা।
ঘাড় ব্যথার কারণ
অধিকাংশ ক্ষেত্রে কারণ জানা নেই
পেশি, হাড়, জোড়া, লিগামেন্ট, ডিস্ক (দুই কশেরুকার মাঝখানে থাকে) ও øায়ুর রোগ বা ইনজুরি
অস্বাভাবিক পজিশনে নিদ্রা বা অনিদ্রা
উচ্চ রক্তচাপ ও হƒদরোগ
বুক ও পেট মধ্যকার বিভিন্ন অঙ্গের সমস্যার জন্য (যেমন, পিত্তথলির পাথর, ডায়াফ্রাম ইরিটেশন ইত্যাদি) ঘাড় ব্যথা হতে পারে। একে রেফার্ড পেইন বলে
হারনিয়াটেড ডিস্ক নার্ভকে ইরিটেশন করে
পেশাগত কারণে দীর্ঘক্ষণ ঘাড় নিচু বা উঁচু করে রাখলে যেমন ডেস্কে বসে কাজ করা, কম্পিউটার নিয়ে কাজ করা, টেলিফোন অপারেটর ইত্যাদি
ছাত্র-ছাত্রীর চেয়ারে বসে পড়াশোনা করার সময় ঘাড় ও মাথার অবস্থান ঠিকমতো না হলে
ড্রাইভিং করার সময় ঘাড় ও মাথা সঠিকভাবে না থাকলে
উপুড় হয়ে শুয়ে বই পড়লে
সারভাইক্যাল স্পনডাইলোসিস
সারভাইক্যাল স্পনডাইলাইটিস
সারভাইক্যাল স্পনডাইলিসথেসিস
সারভাইক্যাল স্পাইনাল ক্যানাল সরু হওয়া
হাড় ও তরুণাস্থির প্রদাহ এবং ক্ষয়
হাড়ের ক্ষয় ও ভঙ্গুরতা
হাড় নরম ও বাঁকা হওয়া
আর্থ্রাইটিস-রিউমাটয়েড ও সেরো নেগেটিভ আর্থ্রাইটিস
ফাইব্রোমায়ালজিয়া
সামনে ঝুঁকে বা পাশে কাৎ হয়ে কিছু তুলতে চেষ্টা করেছেন
হাড়ের ইনফেকশন
ডিস্কাইটিস (ডিস্কের প্রদাহ)
হাড় ও øায়ুর টিউমার
যে কোন কারণে অতিরিক্ত চিন্তাগ্রস্ত হলে ঘাড় ব্যথা হয়
উপসর্গ
ঘাড় ব্যথা এবং এই ব্যথা কাঁধ, বাহু, হাত ও আঙুল পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে
কাঁধ, বাহু, হাত ও আঙুলে অস্বাভাবিক অনুভূতি বা অবশ ভাব
বাহু, হাত ও আঙুল দুর্বল হতে পারে
সব সময় ঘাড় ধরে বা জমে (স্টিফনেস) আছে এবং আস্তে আস্তে বাড়তে থাকবে
ঘাড়ের মুভমেন্ট ও দাঁড়ানো অবস্থায় কাজ করলে ব্যথা বেড়ে যায়
ঘাড় নিচু করে ভারি কিছু তোলা বা অতিরিক্ত কাজের পর তীক্ষœ ব্যথা
হাঁচি, কাশি দিলে বা সামনে ঝুঁকলে ব্যথা বেড়ে যায়
ব্যথা মাথার পেছন থেকে শুরু হয়ে মাথার সামনে আসতে পারে
শরীরে অসহ্য দুর্বলতা লাগে, ঘুমের বিঘœ ঘটে এবং কাজ করতে অক্ষমতা লাগে, শারীরিক ভারসাম্য হারাবে
প্রস্রাব ও পায়খানার নিয়ন্ত্রণ নষ্ট হবে।
লেগ বা পায়ে দুর্বলতা বা অবশ অবশ ভাব এবং টিংগ্লিং সেনসেশন হলে
রাতে বেশি ব্যথা হলে বা ব্যথার জন্য ঘুম ভেঙে গেলে
ব্যথার সঙ্গে জ্বর, ঘাম, শীত শীত ভাব বা শরীর কাঁপানো ইত্যাদি থাকলে
অন্য কোন অস্বাভাবিক সমস্যা দেখা দিলে
ল্যাবরেটরি পরীক্ষা-নিরীক্ষা
ঘাড় ব্যথার চিকিৎসা প্রদানের আগে কারণ নির্ণয় করার জন্য প্রয়োজনীয় ল্যাবরেটরি পরীক্ষা করতে হবে।
রক্তের বিভিন্ন পরীক্ষা
এক্স-রে
আলট্রাসনোগ্রাফি
এমআরআই
সিটি স্ক্যান
করণীয়
ঘাড় ব্যথার চিকিৎসা এর কারণগুলোর ওপর নির্ভর করে। চিকিৎসার মূল লক্ষ্য হলÑ ১. ব্যথা ও অন্যান্য উপসর্গ নিরাময় করা এবং ২. ঘাড়ের মুভমেন্ট স্বাভাবিক করা। উপসর্গ নিরাময় হতে কয়েক মাস লেগে যেতে পারে।
প্রয়োজনীয় বিশ্রাম নিতে হবে
তীব্র ব্যথা কমে গেলেও ঘাড় নিচু বা উঁচু করা, মোচড়ানো (টুইসটিং) পজিশন ও অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম বন্ধ করতে হবে
এন্টিইনফ্ল্যামেটরি ওষুধ সেবন
গরম সেঁক যেমন গরম প্যাড, গরম পানির বোতল ও গরম পানির গোসল
ব্যায়ামÑ ঘাড়ের পেশি নমনীয় ও শক্তিশালী হওয়ার ব্যায়াম করতে হবে
ফিজিক্যাল থেরাপিÑ একোয়া থেরাপি, আল্ট্রাসাউন্ড থেরাপি, শর্টওয়েভ ডায়াথার্মি ও ইলেকট্রিক্যাল ট্র্যাকশন
গলায় সার্ভাইক্যাল কলার ব্যবহার করা
ইনজেকশন চিকিৎসা পদ্ধতি
ইপিডুরাল স্টেরয়েড ইনজেকশন
ফ্যাসেট জয়েন্ট ইনজেকশন
কেমিকেল ডিস্কোলাইসিস
সার্জিক্যাল চিকিৎসা
কনজারভেটিভ বা মেডিকেল চিকিৎসায় ভালো না হলে, ব্যথা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকলে, øায়ু সমস্যা দেখা দিলে, বাহু, হাত ও আঙুলে দুর্বলতা এবং অবশ ভাব দেখা দিলে এবং প্রস্রাব বা পায়খানার নিয়ন্ত্রণ না থাকলে দ্রুত সার্জিক্যাল চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। বিভিন্ন ধরনের সার্জিক্যাল চিকিৎসা কারণগুলোর ওপর নির্ভর করে।
লেখক : কনসালটেন্ট : হাড়, জোড়া, ট্রমা ও আর্থোস্কোপিক সার্জারি, ডিজিল্যাব মেডিকেল সার্ভিসেস, মিরপুর, ঢাকা