শারীরিক যন্ত্রণাদায়ক অস্বস্তিকর অনুভূতিই হচ্ছে ব্যথা। প্রত্যেক মানুষেরই কখনো না কখনো ব্যথায় ভুগে কষ্ট পাওয়ার ইতিহাস রয়েছে। আমদের প্রতিদিনকার জীবনপ্রণালী এবং অনিয়ন্ত্রিত মাত্রায় চলাফেরা ও খাদ্যে বিভিন্নরকম উপাদানের অভাব ইত্যাদির কারণে আমরা হরহামেশাই ব্যথায় ভুগছি। আমাদের দেশে কোন নীতিমালা না থাকায় হরদম বিভিন্ন ধরনের ব্যথানাশক ওষুধ দোকান থেকে ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কিনে না খায় লোকজন। নিজে কিনে বা চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রসহ যে কারণে বা যেভাবেই ব্যথার ওষুধ খাই না কেন এর ব্যবহারে অবশ্যই সতর্ক হওয়া উচিত। দীর্ঘমেয়াদী, অনিয়ন্ত্রিত, মাত্রাতিরিক্ত- ব্যথানাশক শরীরের বিশেষ ক্ষতি করতে পারে।
কখন ব্যথার ওষুধ খাবেন না
কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যথার ওষুধ একদম খাওয়া উচিত নয়। এই সমস্ত ক্ষেত্রে ব্যথার ওষুধ খেলে শরীরে বিভিন্ন রকম নতুন উপসর্গ এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। গর্ভাবস্থা, শিশুকে বুকের দুধ দেন এমন মায়েরা রক্ত পাতলা করার ওষুধ খেতে থাকলে, গ্যাস্ট্রিক বা আলসার থাকলে রক্তক্ষরণ বেশী হলে ব্যথার ওষুধ খাওয়া উচিত নয়। হাপানি থাকলে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যেতে পারে। এমনকি হাপানির ওষুধের পাশাপাশি ব্যথানাশক ওষুধ খেলে রোগী অজ্ঞানও হতে পারে। ব্যথানাশক কিডনী ও যকৃতের সমস্যা তৈরি করতে পারে। যদি যকৃতের সমস্যা, কিডনীর বিভিন্নরকম অসুখ বা কিডনীর সমস্যা উচ্চ রক্তচাপ হ্নদরোগ ও হাপানি থাকে তবে ব্যথানাশক ওষুধ না খাওয়াই ভালো। একদম ছোট বাচ্চা এবং অতি বৃদ্ধ লোকদেরও ব্যথার ওষুধ না খেতে দেওয়াই ভালো।
ব্যাথানাশক ওষুধ কিভাবে কাজ করে
ব্যথানাশক মূলত কাজ করে প্রোস্টাগস্ন্যান্ডিন তৈরিতে বাধাদানের মাধ্যমে। প্রোস্টাগস্ন্যান্ডিন শরীর ব্যথা ও ফোলার জন্য দায়ী। ব্যথানাশক শরীরে সাইক্লোঅক্সিজেনস থেকে প্রোস্টাগস্ন্যান্ডিন তৈরি হতে দেয় না, ফলে ব্যথা অনুভূত হয় না। কিন্তু ব্যথানাশক ওষুধ শরীরে প্রোস্টাগস্ন্যান্ডিন তৈরি হতে বাধা দিয়ে পরিপাকতন্ত্রের উপরিভাগে প্রতিরক্ষামূলক আবরণ তৈরি হতে দেয় না। কারণ এই আবরণ তৈরির কাজটি করে প্রোস্টাগস্ন্যান্ডিন। কিন্তু ব্যথানাশকের প্রভাবে এই প্রোস্টাগস্ন্যান্ডিন তৈরি না হওয়ায় মিউকাস লেয়ারে ক্ষত হয়। ফলে গ্যাস্ট্রিক ও ক্ষত বা আলসার হয়।
আরেক ধরনের ব্যথার ওষুধ রয়েছে সেগুলো ব্যথার জন্য দায়ী প্রোস্টাগস্ন্যান্ডিন তৈরিতে বাধা দিলেও সে প্রোস্টাগস্ন্যান্ডিন পরিপাকতন্ত্রে প্রতিরোধী আবরণ তৈরি করে তাকে বাধাগ্রস্ত করে না। ফলে গ্যাস্ট্রিক বা আলসার হয় না। কিন্তু এ জাতীয় ব্যথার ওষুধে হ্নদরোগের ঝুঁকি বেশি থাকে। যার জন্য একটু বয়স্ক বিভিন্নরকম হ্নদরোগে আক্রান্ত ও উচ্চ রক্তচাপের রোগীরা- এই ওষুধ একদম ব্যবহার করা উচিত নয়।
কখনো কখনো গ্যাস্ট্রিক থেকে মুক্ত থাকার জন্য ব্যথার ওষুধের সাথে মিসোপ্রোস্টল মুক্ত করে নতুন ওষুুধ ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু এই মিসোপ্রোস্টল গর্ভপাত ঘটায় এবং বিকলাঙ্গ শিশু জন্মানোর ঝুঁকি বাড়ায়।
ব্যথানাশক ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
ব্যথানাশক ওষুধগুলোর অনেকধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে যেমনঃ এক নাগাড়ে ব্যথার ওষুধ খেলে মাথা ঘোরা বমি বমি ভাব, অস্থির অস্থির লাগা, বুক ধড়ফড়, চুলকানী, ত্বক লাল হয়ে যাওয়া, পাতলা পায়খানা, পায়খানা কালো হয়ে যাওয়া, গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা বেড়ে যাওয়া বা পেটে গ্যাস জমা ইত্যাদি হতে পারে।
ব্যথানাশক ওষুধ ছাড়া ব্যথার চিকিৎসা
অনেকেরই প্রশ্ন থাকে ব্যথার ওষুধ ছাড়া ব্যথা কমানো সম্ভব কিনা। ব্যথানাশকের বিভিন্নরকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং সমস্যা থেকে মুক্ত থাকার জন্য চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বেশ কিছু পদ্ধতি বের করেছেন ব্যথা কমানোর জন্য। এই সমস্ত চিকিৎসা পদ্ধতির তেমন কোন ক্ষতিকারক দিক নেই এবং তা সাফল্যজনক ব্যথা নিরাময় করে।
লেজার চিকিৎসা
লেজার পেইন চিকিৎসা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত অত্যাধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি। হাড় ও মাংস না কেটে মেরুদণ্ডের ডিস্ক প্রোলাপস হাড় ও জোড়ার বাত বিকলাঙ্গতায় ওষুধ এবং ঝুঁকিবিহীন সার্জারি ছাড়া শুধুমাত্র নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় লেজার রশ্মি দিয়ে ব্যথা কমানো হয়।
আকুপাংচার
প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহ্নত শরীরের বিভিন্ন নির্দিষ্ট পয়েন্টে নির্দিষ্ট স্থানের ব্যথার জন্য আকুপাংচার সুই ঢুকিয়ে ওষুধ ছাড়া পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত চীনা চিকিৎসা পদ্ধতি হলো আকুপাংচার। শরীরের বিভিন্ন মটরপয়েন্টে অবস্থিত আকুপাংচার বিন্দুতে সঠিক স্টিমুলেশনের মাধ্যমে অত্যন্ত সাফল্যজনকভাবে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত ব্যথা নিরাময় সম্ভব।
ফিজিওথেরাপী
বিভিন্নরকম মাংস পেশীর ব্যথা, হাড় ও জোড়ার অবস্থান পরিবর্তন মেকানিক্যাল ব্যথা এই সমস্ত ব্যথার চিকিৎসায় সঠিক ফিজিওথেরাপী চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করলে অত্যন্ত সাফল্যজনকভাবে ওষুধ ছাড়া ব্যথা নিরাময় সম্ভব। ফিজিওথেরাপিস্টরা সাধারণত বিভিন্নরকম হাতের টেকনিক মবিলাইজেশন, ম্যানিকুলেশন, ব্যায়াম শব্দ আলো তাপ বিদ্যুৎ মোম ইত্যাদির মাধ্যমে ওষুধবিহীন ব্যথার চিকিৎসা দিয়ে থাকেন।
রিফ্লেক্সলোজী
এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে শুধুমাত্র পায়ের পাতায় অবস্থিত নির্দিষ্ট রিফ্লেক্স সেন্টারে স্টিমুলেশন, ম্যাসাজ ইত্যাদির মাধ্যমে ব্যথা কামানো হয়। মালয়েশিয়া ইন্দোনেশিয়া সিঙ্গাপুর এই সমস্ত দেশে রিফ্লেক্সলোজি চিকিৎসা পদ্ধতি অনেক জনপ্রিয়।
ব্যথার জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা
শরীরের যেকোন স্থানের ব্যথার জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা হলোঃ বরফকুচির ম্যাসাজ নতুন ব্যথা হলে বরফকুচির ম্যাসাজ বা বরফের সেক এবং পুরোনো ব্যথা হলে ময়েস্ট হীট বা গরম পানির সেক অনেক উপকারী। বাড়িতে বসে প্রাথমিক চিকিৎসা হিসাবে বরফকুচি এবং গরম পানির সেক ব্যবহার করা যেতে পারে।
———————
ডাঃ নিসর্গ দাশ (অন্তু)
ফিজিওথেরাপী চিকিৎসক
নর্থ ইস্ট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল
দক্ষিণ সুরমা, সিলেট-৩১০০