স্বাস্থ্যসেবায় একটি গুরুত্বপূর্ণ জীবন রক্ষাকারী পদক্ষেপ হল টিকাদান কর্মসূচি। এই কর্মসূচি শুরু করার আগে প্রতিবছর আড়াই লাখ শিশু টিকা প্রতিরোধযোগ্য রোগে মারা যেত। বর্তমান এ মৃত্যুর হার অনেক কমে আসলেও আরও বেশি সচেতনতা দিতে পারে আমাদের শিশুদের নিরাপদ ও সুস্থ ভবিষ্যৎ।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত আমাদের দেশে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এই কর্মসূচি পালিত হয়ে আসছে ৭ এপ্রিল, ১৯৭৯ সাল থেকে। বিভিন্ন সময় প্রয়োজনমত বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে এই কর্মসূচি সফলতার সাথে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।
সংক্ষিপ্ত ইতিহাসঃ ১৯৭৯ সালে আনুষ্ঠানিক ভাবে পথচলা শুরু করার পর ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত শুধুমাত্র বড় হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমে টিকার সেবা সীমিত থাকে। ফলে দেখা যায় মাত্র ২% শিশুদের পূর্ণ মাত্রায় টিকাদান সম্ভব হয়েছে। তাই টিকাদান কর্মসূচিকে জনগণের দোরগোড়ায় নিতে ব্যাপক সম্প্রসারণ ও সফল বাস্তবায়নের জন্য ‘ইপিআই কৌশল ও কর্মসূচি কাঠামো’ তৈরি এবং বাস্তবায়ন করা হয় যা এখনও চলছে।
প্রতিরোধযোগ্য রোগ সমূহঃ যক্ষ্মা, ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, ধনুষ্টংকার, হেপাটাইটিস বি, ইনফ্লুয়েঞ্জা বি, পোলিও, হাম, রুবেলা। এর মধ্যে হেপাটাইটিস ও ইনফ্লুয়েঞ্জা টিকা নতুনভাবে সংযুক্ত এবং বর্তমানে শিশু মৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত নিউমোনিয়া রোগ প্রতিরোধে নতুন টিকা (পিসিভি) খুব শীঘ্রই টিকাদান কর্মসূচিতে যুক্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রতিরোধযোগ্য রোগ সমূহের ভয়াবহতাঃ
১. যক্ষ্মা – শিশু মৃত্যুর কারণ ও ফুসফুস ক্যান্সার এর অন্যতম কারণ।
২. ডিপথেরিয়া – হৃৎপিণ্ড ও স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রান্ত করে এবং শিশুর মৃত্যু ও ঘটতে পারে।
৩. হুপিং কাশি – নিউমোনিয়া, চোখে রক্ত জমাট বাঁধা ও মস্তিষ্কের ক্ষতি করে থাকে।
৪. ধনুষ্টংকার – শিশু মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। এটি মাতৃমৃত্যুরও অন্যতম কারণ।
৫. হেপাটাইটিস বি – লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সার এর কারণ।
৬. ইনফ্লুয়েঞ্জা বি – শ্বাসকষ্ট ও শিশু মৃত্যুর কারণ।
৭. পোলিও – পঙ্গুত্ব ও মৃত্যুর কারণ।
৮. হাম – নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, অন্ধত্ব এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।
৯. রুবেলা – মা আক্রান্ত হলে শিশু বিভিন্ন জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্ম নেয়।
টিকাদান কর্মসূচির লক্ষ্যঃ
– শিশুমৃত্যুর হার ও পঙ্গুত্বের হার কমানো।
– মাতৃমৃত্যুর হার কমানো।
উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠীঃ
০ থেকে ১১ মাস বয়সী সকল শিশু
১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী সকল সন্তান ধারণক্ষম মহিলা
নিয়মিত টিকাদানের সময়সূচীঃ
০ থেকে ১১ মাস বয়সী শিশু
১. জন্মের সাথে সাথে – বিসিজি (যক্ষ্মার টিকা) + ওপিভি
২. ৬ সপ্তাহ বয়সে – পেনটাভেলেনট (ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, ধনুষ্টংকার, হেপাটাইটিস- বি, ইনফ্লুয়েঞ্জা) + ওপিভি (পোলিও) + পি সি ভি ( নিওমোকক্কাল নিওমোনিয়া)
৩. ১০ সপ্তাহ বয়সে – পেনটাভেলেনট + ওপিভি + পি সি ভি ( নিওমোকক্কাল নিওমোনিয়া)
৪. ১৪ সপ্তাহ বয়সে – পেনটাভেলেনট + ওপিভি + পি সি ভি ( নিওমোকক্কাল নিওমোনিয়া)
৫. ৯ মাসের শেষে – এম আর (হাম, রুবেলা) + ওপিভি + ভিটামিন এ ক্যাপসুল
৬. ১৫ মাসের শেষে- এম আর (হাম, রুবেলা)/ এম ( হাম)
১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী সন্তান ধারণক্ষম মহিলা
১. এম আর (হাম, রুবেলা)- ১৫ বছর বয়স হলেই ( টি টি- ১ এর সাথে)
২. টিটি ১ – ১৫ বছর বয়স হলেই
৩. টিটি ২ – টিটি ১ এর কমপক্ষে ২৮ দিন পরে
৪. টিটি ৩ – টিটি ২ এর কমপক্ষে ৬ মাস পরে
৫. টিটি ৪ – টিটি ৩ এর কমপক্ষে ১ বছর পরে
৬. টিটি ৫ – টিটি ৪ এর কমপক্ষে ১ বছর পরে
কিছু বিষয়াবলী-
১. ন্যূনতম বিরতির আগে টিকা প্রদান করলে সে টিকা অকার্যকর হয়ে পরে। তাই অবশ্যই সঠিক সময়সূচী অনুসরণ করে টিকা দিতে হবে।
২. নির্দিষ্ট টিকাদান কার্ড অনুসরণ করতে হবে।
৩. টিকার স্থানে ফোঁড়া হলেও পরবর্তী টিকা দিতে হবে।
৪. সামান্য অসুস্থতায় টিকা দেয়া যায় তবে খুব বেশি অসুস্থ হলে বা টিকাদানের পর খিঁচুনি/অজ্ঞান হলে অবশ্যই ডাক্তারকে জানাতে হবে।
৫. কোনরকম হাতের সংস্পর্শ ছাড়া টিকাদান কার্যক্রম হতে হবে (নন টাচ টেকনিক)।
৬. যে কোন টিকা দেয়ার পর সাধারণত হালকা জ্বর বা জ্বর ভাব আসতে পারে, এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
৭. কোন টিকাদানের সময় পার হয়ে গেলে, নিকটস্থ টিকাদান কেন্দ্রে যোগাযোগ করতে হবে।
সুত্রঃ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, মেডিভয়েস, সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি, বাংলাদেশ।