রমজান মাসে সবার প্রথমে যা দরকার, তা হলো শারীরিক সুস্থতা। আর এই শারীরিক সুস্থতার জন্য প্রয়োজন সঠিক খাদ্য ও পুষ্টি। বিশেষ করে বিভিন্ন রোগে কারণে যারা ভোগান্তিতে আছেন, তাদের ক্ষেত্রে পূর্বশর্তই হল শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখা।
ডায়াবেটিস রোগীকে আমরা নির্দিষ্ট সময় পরপর বারবার অল্প পরিমাণে খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকি। অন্যদিকে রমজানের সময় দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকতে হয়। সুতরাং শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে রোজার আগেই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ এবং পুষ্টিবিদের পরামর্শ অনুযায়ী রোজার জন্য তৈরি বিশেষ খাদ্যতালিকা মেনে চলা দরকার। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেকাংশেই কমে আসে।
রোজায় ডায়াবেটিস রোগীরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকার কারণে বেশির ভাগ রোগী হাইপোগ্লাইসেমিয়া বা রক্তের গ্লুকোজ কমে গিয়ে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েন। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে একসঙ্গে অনেক বেশি খাবার খাওয়ায় রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে গিয়ে হাইপারগ্লাইসেমিয়াও দেখা দিতে পারে।
তাহলে কেমন হতে পারে সাধারণ ডায়াবেটিস রোগীর রোজার খাদ্যাভ্যাস? আসুন, সেটিই এবার জেনে নেওয়া যাক।
সাহরী
আমাদের মধ্যে অনেকেই সাহরীতে খান না। ডায়াবেটিক রোগীর ক্ষেত্রে কোনোভাবেই সাহরীতে না খেয়ে রোজা রাখা যাবে না। এমনকি সাহরীর খাবার হবে পর্যাপ্ত পরিমাণে, যা সাধারণ সময়ের দুপুরের খাবারের সমান। সাহরীর খাবারে পর্যাপ্ত পরিমাণে আমিষ রাখা প্রয়োজন। তাছাড়া সাহরী শেষ সময়ে খাওয়া ভালো। এতে সারাদিনে রক্তের চিনি কমে গিয়ে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে কম থাকবে। সাহরীতে অনেকেই দুধ, কলা দিয়ে ভাত খেতে পছন্দ করেন। যা ডায়াবেটিস রোগীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। সে ক্ষেত্রে শুধু দুধ–ভাত অথবা শুধু দুধ–কলা খাওয়া যেতে পারে।
তাছাড়া সাহরীর আগে, সাহরী খাওয়ার দুই ঘণ্টা পরে, মধ্য দুপুরে এবং ইফতারের দুই ঘণ্টা আগে মাঝে মাঝে ডায়াবেটিস মেপে দেখতে হবে। আবার শরীর খারাপ লাগলেও ডায়াবেটিস মেপে দেখতে হবে। যদি রক্তের গ্লুকোজ ৩.৯ মিলি মোল পার লিটার এর নিচে অথবা ১৬.৭ মিলি মোল পার লিটারের উপরে থাকে তাহলে রোজা ভাঙতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ইফতার
ইফতারের খাবার হতে হবে স্বাভাবিক সময়ের রাতের খাবারের সমান। সারা দিন রোজা রাখার ফলে শরীরের বিপাক ক্রিয়া ঠিক রাখার জন্য এবং পানিস্বল্পতা রোধের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি বা পানিজাতীয় খাবার ইফতারে গ্রহণ করতে হবে। তবে সকল প্রকার কোমল পানীয় বা আর্টিফিশিয়াল জুস বাদ দেওয়া ভালো। কোমল পানীয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডিহাইড্রেশনের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। শরবত হিসাবে লেবু পানি, টকফলের শরবত, কম মিষ্টি ফলের শরবত, কাঁচা আম, বেলের শরবত, কচি ডাবের পানি ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে।
কিন্তু শরবতে চিনি, গুড়, মধু, মিষ্টি যোগ করা যাবে না। প্রয়োজনে বিকল্প চিনি যোগ করা যেতে পারে। এসব শরবতের সঙ্গে প্রয়োজনে ইসুবগুলের ভুসি, তোকমা দানা, চিয়া সিড ইত্যাদি যোগ করে পুষ্টিগুণ আরো বৃদ্ধি করা যায়।
ইফতারিতে প্রতিদিন ভাজাপোড়া, ফাস্টফুড, ডিপ ফ্রাইড খাবার, অতিরিক্ত তেল মসলাযুক্ত খাবার না খেয়ে বরং সুপ, সালাদ, স্টিম করা খাবার, খুব অল্প তেলে ফ্রাই করা খাবার যোগ করে খাবারে বৈচিত্র্য আনা যেতে পারে। তবে যে কোন ফল অথবা সবজি জুস করে খাবার থেকে গোটা খেলে বেশি পুষ্টিগুণ পাওয়া যায়।
আবার এক শ্রেণীর মানুষ প্রচুর পরিমাণে ইফতার খেয়ে, পরে সন্ধ্যা–রাতের খাবার বাদ দেন। কিন্তু ডায়াবেটিস রোগীর জন্য অনেক বেশি পরিমাণে ইফতার খাওয়া বা সন্ধ্যা–রাতের খাবার বাদ দেওয়া—দুইটিই ঝুঁকিপূর্ণ। সুতরাং সন্ধ্যা–রাতের খাবারটি হবে স্বাভাবিক সময়ের সকালের খাবারের সমপরিমাণ।
অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি রোজার সময় প্রতিদিন খাদ্য তালিকায় দুধ অথবা টক দই রাখা ভালো। মূল কথা, ডায়াবেটিস রোগীদের রোজার সময় খাবার হতে হবে স্বাস্থ্যসম্মত পরিমিত ও পুষ্টিকর।
লেখক: নিউট্রিশন অফিসার, ন্যাশনাল হেলথকেয়ার নেটওয়ার্ক, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি