॥ ই-হেলথ২৪ রিপোর্ট ॥ গত ১৭ মে ২০১২ ইউএনএফপিএ ও দ্য ডেইলি স্টার-এর যৌথ উদ্যোগে ‘নিরাপদ মাতৃত্ব: অর্জন ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও নীতিনির্ধারকেরা এ আলোচনায় অংশ নেন।
শাহেদুল আনাম খান
নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য আমরা আসলে কী করছি, তেমন কিছুই না। আমাদের সুস্থ ও সবল মা প্রয়োজন। মায়ের স্বাস্থ্য নিশ্চিত হলে শিশুর স্বাস্থ্যের নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে। স্বাস্থ্যবান শিশু স্বাস্থ্যবান নাগরিক হয় এবং স্বাস্থ্যবান নাগরিক স্বাস্থ্যবান জাতি গঠন করে। আজ এই আলোচনায় যাঁরা উপস্থিত, তাঁরা সবাই নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য কাজ করেন।
কেউ গণমাধ্যমে জড়িত এবং কেউ ইউএনএফপিএ যা করার চেষ্টা করছে তা বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত। সরকারের প্রতিনিধিরাও এখানে উপস্থিত রয়েছেন। আশা করি, এ আলোচনা নীতিনির্ধারকদেরও সহায়ক হবে। আমি ডেইলি স্টার-এর পক্ষ থেকে এই আয়োজনে জড়িত থাকতে পেরে মহিমান্বিত বোধ করছি।
আমাদের দায়িত্ব হলো সরকারকে জানানো এবং নীতিনির্ধারকদের কাজে সহায়তা করা। একদিনের সেমিনার বা পত্রিকার বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ এ ব্যাপারে যথেষ্ট নয়। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়ার অংশ। আমি আবারও সবাইকে স্বাগত জানাই এবং আশা করি সবাই তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা করবেন।
আর্থার এরকেন
সবাইকে স্বাগত। এই গোলটেবিল অনুষ্ঠানে আপনাদের গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণের জন্য অভিনন্দন জানাই। নারীরা প্রসবকালে কী অবস্থার মধ্যে দিয়ে যান, পুরুষ হিসেবে আমার জন্য তা অনুধাবন করা কঠিন। আমার স্ত্রী যখন প্রথমবার অন্তসত্ত্বা হন তখন আমরা তাঞ্জানিয়ায় ছিলাম। প্রসবের পাঁচ সপ্তাহ আগে আমরা হল্যান্ডে চলে আসি। তার অন্তসত্ত্বাকাল খুবই স্বাভাবিক ছিল, কোনো সমস্যাই দেখা যায়নি।
কিন্তু প্রসববেদনা দীর্ঘ সময় চলেছিল। হল্যান্ডে থাকায় পর্যবেক্ষণ এবং হাসপাতালের সেবায় কোনো ঘাটতি হয়নি। দুইদিন পরে সুস্থ ও সবল একটি কন্যাশিশু জন্মালো। কিন্তু আমরা যদি তাঞ্জানিয়ায় থাকতাম তাহলে গল্পটা সম্পূর্ণ অন্যরকম হতো। তাঞ্জানিয়ায় গ্রামীণ নারীদের প্রলম্বিত প্রসববেদনা জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে থাকে।
এই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার কারণে বিষয়টির প্রতি আমার সত্যিকার একটা দায়বদ্ধতা জন্মেছে। এটা কেবল আমার পেশাগত নিষ্ঠা নয়। কারণ আমি জানি, প্রসবকালে নারীদের দক্ষ স্বাস্থ্যসেবা এবং যত্ন পাওয়া কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আমার স্ত্রী অন্তসন্তাকালে ও প্রসবকালে যথাযথ সেবা পেয়েছেন এবং এটা সব নারীরই পাওয়ার অধিকার রয়েছে।
তাই আমাদের এমন এক ব্যবস্থা তৈরি রাখতে হবে, যা প্রত্যেক নারীরই যত্ন নেবে। শুভ সংবাদ যে বাংলাদেশ প্রসবকালীন মাতৃমৃত্যুর হার যথেষ্ট পরিমাণে কমিয়ে আনতে পেরেছে। কিন্তু এখনো অনেক নারীর মৃত্যু দুঃসংবাদই বটে। যে সময়টায় এই গোলটেবিল বৈঠক শেষ হবে, ততক্ষণে বাংলাদেশে অন্তত আরও দুজন নারী প্রসবের সময় মারা যাবেন। আমরা কি বছরে সাত হাজারেরও বেশি মায়ের মৃত্যু বন্ধ করতে পারছি? অথচ এই মৃত্যুর ৯০ শতাংশই ঠেকানো যেত। এই মৃত্যু ঠেকানোর কর্মসূচিই আসল কর্মসূচি।
প্রসূতি নারীরা যেসব রোগে মারা যান, সেগুলোর চিকিৎসা আমরা করতে পারি না, তা নয়। তাঁরা মারা যায়, কারণ তাঁদের জন্য আমরা নিয়মিত সেবা ও পরিচর্যা নিশ্চিত করতে পারিনি বা তা করাকে আমাদের প্রধান অগ্রাধিকারে পরিণত করিনি। যতক্ষণ না আমরা মাতৃস্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিনিয়োগ করছি, মাতৃস্বাস্থ্যের বিভিন্ন দিককে গুরুত্বপূর্ণ করে ভাবছি, ততক্ষণ পর্যন্ত এ সমস্যা টিকেই থাকবে।
মাতৃমৃত্যুর হার কমিয়ে আনার সঙ্গে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যেহেতু প্রতিটি গর্ভই ঝুঁকিপূর্ণ, তাই নারীরা যত কম সন্তান নেবেন, প্রসূতি অবস্থায় তত কম মারা যাবেন। তাই নারীদের জন্য স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা প্রস্তুত রাখতে হবে, যাতে তাঁরা নিরাপদে সন্তানের জন্ম দিতে পারেন। এটাই আজকের মূল বার্তা। আলোচনা দীর্ঘায়িত না করে আমি আজকের গোলটেবিল আলোচনার সূচনা ঘোষণা করছি। এখন ড. হাসিনা আমাদের সামনে মূল আলোচনার প্রতিবেদন পেশ করবেন।
ড. হাসিনা বেগম
ধন্যবাদ। আমি বাংলাদেশে মাতৃস্বাস্থ্যের বাস্তব অবস্থা, অর্জন, চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ করণীয়ের ওপর আলোকপাত করব। গত নয় বছরে মাতৃমৃত্যুর হার (এমএমআর) কমেছে ৪০ শতাংশ। মৃত্যুঝুঁকিও প্রতি ৫০০ জনে একজনে নেমে এসেছে। দুটো ক্ষেত্রেই আমরা সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) পূরণের পথেই আছি।
তাহলেও এখনো দক্ষ প্রসবকালীন স্বাস্থ্যকর্মীর অনুপাত খুবই কম। বর্তমানে এই হার ৩২ শতাংশ (ডিএইচএস ২০১১)। এখনো অন্তত একবার প্রসবপূর্ব সেবাদানের বিস্তার ৬৮ শতাংশ। একাধিকবার প্রসবপূর্ব সেবা নিশ্চিত করায় আমাদের সাফল্য মাত্র ২৬ শতাংশ। অনেক অর্জন থাকা সত্ত্বেও এমন কয়েকটি ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি।
এমএমআর কমানোয় আমাদের সফলতার মূল উপাদান দুটি: এক. আচরণের পরিবর্তনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা বাড়া, অর্থাৎ টেকসইভাবে সেবাসুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা এবং দুই. প্রসবের সময় দক্ষ সহকারীর উপস্থিতি এবং সমস্যা হলে চিকিৎসার চাহিদা সৃষ্টি। স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুবিধা এবং জরুরি অবস্থায় সেবা সুবিধা (ইওসি) দেওয়ার কেন্দ্রের সংখ্যা না বাড়ালে এটা সম্ভব হতো না।
তরুণীদের মধ্যে উচ্চশিক্ষিতের হার বাড়াও অগগতির আরেকটা কারণ। বিএমএমএসের সমীক্ষা দেখাচ্ছে, মার্তৃস্বাস্থ্যবিষয়ক সচেতনতা অশিক্ষিত নারীদের মধ্যেও বেড়েছে। ২০০৪ থেকে ২০১১ সালে সেবাসুবিধা যথেষ্ট প্রসারিত হয়েছে। বেসরকারি খাতে এই হার বেড়েছে চার গুণ। সেবার চাহিদামূলক আচরণ বেড়েছে ২৮ শতাংশ। মেয়েরা এখন গৃহে ও বাইরে দুইখানেই সেবা প্রত্যাশা করে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার হারও দারুণভাবে বাড়ায় মাতৃমৃত্যুর হার অনেক কমেছে। হেমোরেজ ও অ্যাকলামসিয়ার মতো মাতৃমৃত্যুর প্রত্যক্ষ কারণগুলোও উল্লেখযোগ্য মাত্রায় হ্রাস পেয়েছে।
আমাদের সামনে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ। প্রতিদিন ২০ জন প্রসূতি নারীর মৃত্যু হওয়া খুবই উদ্বেগজনক। নিম্নমাত্রার টিএফআর আর এখন এমএমআর কমাতে সাহায্য না করাও আরেকটি চ্যালেঞ্জ। প্রসব-পরবর্তী সময়ে অনেক নারীর মৃত্যু প্রসবের পরে সেবাপ্রাপ্তির ঘাটতিকে চিহ্নিত করে।
সিজারিয়ান অপারেশনও গত নয় বছরে পাঁচ গুণ বেড়েছে। বেসরকারি পর্যায়ে এই বৃদ্ধির হার মারাত্মক। সরকারি পর্যায়ে যেখানে মোট প্রসবের ৩৫ শতাংশ সিজারিয়ান, সেখানে বেসরকারি পর্যায়ে এই হার ৭১ শতাংশ, আর এনজিওতে এটা ৩০ শতাংশ। ২০১৫ সালের মধ্যে এমডিজি লক্ষ্য পূরণে আমরা দৌড়ের শেষ মাইল পার করছি। আমাদের এখন পরিবার পরিকল্পনার প্রসার, দক্ষ প্রসবকর্মীর সংখ্যা বাড়ানো এবং দরিদ্র নারীদের সেবা প্রদান বাড়াতেই হবে।
আর্থার এরকেন
ধন্যবাদ। আমাদের অনেকেই হয়তো এ বিষয়গুলোর সঙ্গে কমবেশি পরিচিত। তার পরও প্রায়োগিক ক্ষেত্রে কী করা উচিত তার জন্য এই আলোচনা কাজে দেবে। এমডিজি লক্ষ্যসীমায় পৌঁছতে হলে এখনো আমাদের মাতৃমৃত্যুর হার তিন থেকে চার বছরের মধ্যে ২৫ শতাংশ কমাতে হবে। তার পরও এখানকার নারীদের অবস্থা পশ্চিমা বিশ্বের নারীদের থেকে ২০ গুণ কম সুবিধাজনকই থাকবে। তাই এমডিজির পাঁচটি টার্গেটে পৌাঁছানোয় অনেক কিছু করার আছে।
ড. আহমেদ আল কবীর
আমাদের জনসংখ্যার বড় একটি অংশই তরুণ। ৩৪ শতাংশ মানুষ ১৪ বছরের কম বয়সী। ৬৫ শতাংশ জনসংখ্যা ৩০ বছরের কম বয়সী। ৮০+ শতাংশ ৪০ বছরের কম বয়সী। ১৫-৪৫ বছরের নারীদের প্রজননক্ষম ধরলে জনসংখ্যার ৪০+ শতাংশেরও বেশি সেই বয়সসীমার মধ্যে পড়ে। এই তরুণ জনসংখ্যা আমাদের সমাজ-অর্থনীতির জন্য সুবিধাজনক হতে পারে, যাকে বলা হয় পুপুলেশন ডিভিডেন্ট। কিন্তু তার জন্য তাদের স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে হবে এবং কর্মরত রাখতে হবে।
স্বাস্থ্য খাতে আমাদের তিনটি ক্ষেত্রে নজর দিতে হবে- বেসিক কেয়ার, সেকেন্ডারি কেয়ার, টার্শিয়ারি কেয়ার। তৃতীয় পর্যায়টি নিয়ে অনেকেই কাজ করছে, অনেক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতাল এবং অন্যান্য সুবিধা রয়েছে। সেকেন্ডারি কেয়ার পর্যায়ে উপজেলা স্তরে অবকাঠামোগত পরিস্থিতি খুব ভালো। তাহলেও নিরাপদ প্রসবের জন্য দ্বিতীয় পর্যায়ে গাইনোকলজিস্ট, চিকিৎসক, দক্ষ নার্স এবং অ্যানেসথেসিস্টের অভাব রয়ে গেছে।
এই পুরো প্রক্রিয়ার সমর্থনে বেসিক কেয়ার পর্যায়ে ভালো নার্স ও ভালো মিডওয়াইফ প্রয়োজন। সব ক্ষেত্রেই গাইনোকলজিস্ট ও অ্যানেসথেসিস্টের একটি দল থাকা জরুরি। এ সমস্যাটির দিকে আমাদের দৃষ্টি ফেরাতে হবে। নেপাল অ্যানেসথেসিস্ট তৈরির জন্য ছয় মাসের কোর্স চালু করেছে এবং সুফল পাচ্ছে।
জাতিসংঘে আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছিলেন যে তিন হাজার মিডওয়াইফ প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। দুই বছর পরে আমরা মাত্র ২০০ জন পেয়েছি। সরকারকে অবশ্যই পাবলিক ও প্রাইভেট এবং এনজিওদের নিয়ে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। রিসোর্স প্রধান সমস্যা নয়। মন্ত্রণালয়ের দিক থেকে অঙ্গীকার থাকলেও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ঘাটতিই সমস্যা।
ড. বুশরা আহমেদ
মাতৃস্বাস্থ্য বিষয়ের কিছু দিক আছে, যা মেডিকেল বিষয়। আর কিছু আছে, যা সামাজিক-অর্থনৈতিক নির্ধারক। প্রথমেই আমাদের বলতে হবে শিক্ষার সুযোগের কথা। এ বিষয়ে সত্যিই বাংলাদেশের অবস্থা ভালো। প্রাথমিক পর্যায়ে ছেলে-মেয়ের সংখ্যার অনুপাতে ভারসাম্য অর্জন করা গেছে।
মাধ্যমিক পর্যায়ে বৃত্তিপ্রদান কর্মসূচির ফলে সেকেন্ডারি স্কুল ও কলেজে মেয়েদের পড়ালেখা ধরে রাখায় সাহায্য হচ্ছে। ফলে তাদের বিয়ের বয়স পিছিয়ে যায় এবং শিক্ষিত হওয়ায় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বাড়ে। এটা বিয়ের বয়স এবং প্রথম সন্তান গ্রহণের বয়সের ওপরও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। মেডিকেল ইস্যুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে এ দিকেও কাজ করে যেতে হবে।
গড় আয়ু এবং গড় আয়—দুটোরই বৃদ্ধি সাধারণভাবে মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নতিতে বাস্তব প্রভাব ফেলে। শ্রমশক্তিতে বিশেষ করে পোশাকশিল্পে নারীদের বিপুল অংশগ্রহণে তাদের আর্থিক সক্ষমতা বেড়েছে। নারীরা অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম হয়ে ওঠা মানে সংসারে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বাড়া। এ থেকে তাদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তাও সৃষ্টি হয়। তাই নারীদের অর্থনৈতিক উন্নতির গতি এবং মজুরি-বৈষম্য দূর করার দিকে নজর দেওয়া জরুরি।
সিডও সনদ সাক্ষরকারী দেশগুলোর অন্যতম হয়েও আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিরাট ব্যবধান রয়েছে আমাদের। এখনো ৪০ শতাংশ নারী গার্হস্থ্য সহিংসতার শিকার। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী নেত্রী উভয়ই নারী। কেবল শীর্ষ রাজনৈতিক পদ পেলেই চলবে না, নারীদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় আরও বেশি করে জড়িত করতে হবে। নেপালে যেখানে নারীরা বেশি রাজনৈতিক ক্ষমতা অথবা প্রশাসনিক দায়িত্ব পেয়েছেন, সেখানে বন সংরক্ষণে সফলতা বেড়েছে। নারীর অবস্থানের উন্নতি সত্যিকারভাবে মাতৃস্বাস্থ্যের সুরক্ষাও বাড়ায়।
মেডিকেল ইস্যুর মধ্যে প্রসবকালে এসবিএর উপস্থিতির বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কেবল মিডওয়াফই নয়, সব রকম দক্ষ প্রসবকর্মীর সংখ্যা বাড়াতে হবে। এটা তৈরি করতে তিন থেকে চার বছরের প্রশিক্ষণ লাগবে। এই মধ্যবর্তী সময়ে কী করা হবে? তাই এফডব্লিউভির দিকেও নজর দিতে হবে। স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা উভয় দিকেই গুরুত্ব দিতে হবে।
বাংলাদেশে বিরাট এনজিও খাত সক্রিয়। স্বাস্থ্য সুবিধার বেলায়ও তাদের চমৎকার অবকাঠামো রয়েছে। তারা এ বিষয়ে আরও ভালোভাবে কাজ করতে পারে। আমাদের সেবা সুবিধাকেন্দ্রের অভাব রয়েছে। বাংলাদেশে সম্পদের সমস্যা একটা বড় সমস্যা। উন্নত দেশের সঙ্গে আমাদের তুলনা চলে না।
উপজেলা পর্যায়ে ১৩২টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে। একটি জেলার সব কটি উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সেই জরুরি প্রসূতি সেবার ব্যবস্থা থাকার দরকার নেই। জেলার দুটিতে সব রকম সুবিধা নিশ্চিত করলেই চলবে এবং এলাকার সব মানুষ যাতে এর সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকে।
এ দুটিতে চিকিৎসকের পাশাপাশি একজন অ্যানেসথেসিস্ট ও একজন ধাত্রীবিদ্যাবিশারদ এবং কয়েকজন দক্ষ নার্স/সিএসবিএ/মিডওয়াইফ থাকতে হবে। ১৩২টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ৮০ শতাংশ সব সময় কার্যকর রাখায় বিশ্ব ব্যাংকের তরফে আমরা উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি।
যোগাযোগব্যবস্থার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। কিছু এলাকা খুবই দুর্গম। এসব এলাকায় চিকিৎসক, অ্যানেসথেসিস্টসহ সবারই উপস্থিত থাকা গুরুত্বপূর্ণ। অ্যানেসথেসিস্টের অভাব মেটানোর জন্য চিকিৎসকদের একটা অংশকে ছয় মাসের প্রশিক্ষণ দিয়ে ওই সব এলাকায় এলাকায় নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।
ড. এ. কে. এম. নূর-উন-নবী
আমাদের যুবজনসংখ্যা কাঠামোর জন্য বেশিসংখ্যক নারী প্রজননের স্তরে প্রবেশ করছে। এমএমআর ২৫ শতাংশ কমছে টিএফআর হ্রাস পাওয়ার জন্য। টিএফআর হ্রাসের হার ধরে রাখতে চাইলে একদিকে বয়ঃসন্ধিতে সন্তান গ্রহণের হার, অন্যদিকে কিশোরী উর্বরতার হার কমাতে হবে। টিএফআরে পুনরুৎপাদনের বয়সে থাকা নারীদের সংখ্যাও কমাতে হবে।
এ জন্য পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির প্রভাবশীল উপাদানের দিকেও তাকাতে হবে। সেবা দিতে পারলে এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী সরবরাহ করতে পারলে বাচ্চা হবে না এবং সন্তান ধারণের ইচ্ছার মধ্যে বিরতি ও পরিসর তৈরি করা যাবে। তাই নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে নারীদের জন্য, বিশেষ করে কম সুবিধাপ্রাপ্ত এবং আওতার বাইরের এলাকার নারীদের কাছে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী সুলভ করতে হবে।
এখানে দুই-তিনটি উপাদানের বিষয়ে খেয়াল রাখা উচিত, একটি হচ্ছে মিশ্রপদ্ধতি। আমরা বিভিন্ন সমীক্ষা বা অন্যান্য ক্ষেত্রে মেথড-মিক্স পাই। নারীর জীবনচক্রের সঙ্গে মেথড-মিক্সের পরিকল্পনা থেকে কর্মসূচির নকশা করলে ভালো হয়। কর্মসূচির পরিকল্পনার সময় এগুলোর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। কার্যকরভাবে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হলে তাদের মধ্যেসেবার চাহিদা সৃষ্টি করতে হবে। এ জন্য ঝুঁকিপূর্ণ সামাজিক রীতিনীতি সম্পর্কে শক্তিশালী প্রচারণা চালাতে হবে।
বাল্যবিবাহ একটি ঝুঁকিপূর্ণ চর্চা, বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়াও ঝুঁকিপূর্ণ চর্চা। সামাজিক মূল্যবোধ পরিবর্তনের মাধ্যমে এগুলো কমানো যায়। এ জন্য ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত নেটওয়ার্ক তৈরি করা দরকার। নীতি বা পদ্ধতি তৈরির সময় আমরা দীর্ঘস্থায়ী কমিউনিটিভিত্তিক অংশগ্রহণমূলক কর্মসূচির কথা বলি না কেন?।
ড. মোর্শেদা চৌধুরী
আমাদের সেবাসুবিধা এবং অবকাঠামো ভালো হলেও সেগুলোর শতভাগ ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি। তার জন্য কমিউনিটির মধ্যে এসবের চাহিদা সৃষ্টি করতে হবে এবং তারা জানবে—কখন, কীভাবে এগুলো ব্যবহার করা যাবে। বাইরে থেকে নয়, কমিউনিটির ভেতরের কেউ পুরো প্রক্রিয়াটা বুঝলে তবে সফলতা আসবে। উত্তরের কিছু জেলায় এই পদ্ধতি আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি। ২০১১ সালে এক লাখ ৮০ হাজার নারী সেসব সেবাকেন্দ্রে এসেছেন। তাঁদের টাকা দেওয়া হয়নি বরং তাঁরা নিজেরাই টাকা খরচ করে এসেছেন।
ওই বছরে নীলফামারীতে মাতৃমৃত্যুর হার ছিল হাজারে ১৫৪। এটা খুবই ভালো অর্জন। পরিবার পরিকল্পনার আধুনিক পদ্ধতি গৃহীত হওয়ার হার ৫২ শতাংশ, অন্যদিকে স্বল্পমেয়াদি পদ্ধতি তথা পিল আর কনডম গ্রহণের হার ৮৬ শতাংশ। তবে পরিবার পরিকল্পনার সাফল্য থাকলেও এর ব্যবহার স্থায়ী করা যায়নি। ব্র্যাকের ৯২ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন। তাই সরকার ও এনজিওকে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করা দরকার। তৃণমূল পর্যায়ে এই সমন্বয় প্রয়োজন।
ড. মোমেনা খাতুন
ড. হাসিনা শেষ ধাপ অতিক্রম অর্থাৎ মাতৃমৃত্যুর হার আরও ২৫ শতাংশ কমানোর কথা বলেছেন। এর জন্য জরুরি হলো প্রসবকালীন দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর উপস্থিতি নিশ্চিত করা। হয় সিএসবিএ অথবা মিডওয়াইফ কাউকে না কাউকে থাকতেই হবে। আমরা প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি, কিন্তু প্রশিক্ষণ-পরবর্তী তদারকি ঠিকভাবে করি না।
স্বাস্থ্যকর্মীদের কারিগরি তদারকি ও সহযোগিতা কী করেছি? আমরা কমিউনিটিকেও সেবা গ্রহণের বিষয়টি ভালোভাবে বোঝাতে পারিনি। তৃতীয় বিষয় হলো, আমরা কি কর্মীদের ধারাবাহিকভাবে ওয়াকিবহাল রাখার চেষ্টা করে গেছি? মাতৃমৃত্যুর সমীক্ষা বলছে, প্রত্যক্ষ কারণে মৃত্যুর হার ৪০ শতাংশ, কিন্তু পরোক্ষ কারণে মৃত্যু হয় ৩১ শতাংশ। এ বিষয়ে তথ্য ও পরিসংখ্যান নেই। পরোক্ষ কারণগুলো জানা দরকার।
কাওসার আফসানা
২০১৫ সালের পর আমাদের নীতিগত দিকনির্দেশনা কী হবে, সেটা এখনই ভাবা দরকার। মাতৃমৃত্যুর হার কমলেও এখনো ৩০ শতাংশ মৃত্যু হয়। আমরা দেখেছি, জন্ডিস, হাইপার টেনশন ও ডায়াবেটিসের কারণে অধিকাংশ মৃত্যু হয়। এসব বিষয়ে আমরা কেউই কাজ করি না।
প্রসূতিরা হাসপাতালে ভর্তি হলেও বাড়ি ফিরে যান, কারণ বাংলাদেশে এ রকম অবস্থার কোনো চিকিৎসা নেই। এবং তাঁরা বাড়ি গিয়ে অন্যদের বলেন, হাসপাতালে গিয়ে লাভ নেই। গরিব মানুষ হাসপাতালে গিয়ে মানুষের সম্মানটা পর্যন্ত পায় না। তাই চিকিৎসা শিক্ষা, নার্সিং শিক্ষার মধ্যে সেবামানসিকতা আনবার চিন্তা থাকা দরকার। আমরা জানি না হেলথ প্রভাইডারদের সবাইকে কত দিনের মধ্যে প্রশিক্ষণ দেওয়া যাবে। পোস্টমর্টাম হেমারেজ, অ্যাকলামসিয়ার মোকাবিলা করতে হবে। হেমারেজের বেলায় রক্তদানের প্রয়োজন হবে।
কিন্তু এখনো জাতীয় পরিচয়পত্রে রক্তের গ্রুপ চিহ্নিত করার ব্যবস্থা হয়নি। প্রয়োজনের সময় রক্তের সহজলভ্যতা থাকতে হবে। নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদেরও এসব ব্যাপারে দক্ষ হতে হবে, কারণ তাঁরাই বেশির ভাগ সময় রোগীর হাতের কাছে থাকেন, চিকিৎসকেরা থাকেন না। প্রশিক্ষিত মিডওয়াইফদের সহায়ক-ব্যবস্থা না দিলে এবং তাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত না করলে তাদের পক্ষে কার্যকর সহযোগিতা করা সম্ভব হবে না।
ড. মোহাম্মদ শরিফ
গত জানুয়ারি থেকে আমরা এফডব্লিউসিগুলোতে স্বাভাবিক প্রসবের কাজ শুরু করেছি। ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেবা দেওয়ার বিষয়ে আমরা বেশি জোর দিচ্ছি। ৩৭২৫ এফডব্লিউসির মধ্যে এক হাজার ৫০০টি স্বাভাবিক প্রসবের উপযোগী করে উন্নত করা হয়েছে। সেখানে প্রসব কক্ষ, অক্সিজেন সিলিন্ডারসহ অন্যান্য সুবিধা রয়েছে। এসব কেন্দ্রের তদারকি ও নজরদারি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসকের পদ এক হাজার ৪০০ হলেও বর্তমানে মাত্র ৫৫০ জন কর্মরত আছেন। দ্রুত পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ করা জরুরি।
ড. এ কে এম মাহবুবুর রহমান
কোন বয়স গ্রুপের মায়েরা বেশি মারা যাচ্ছেন, সেটা আলোচনায় আসেনি। বাল্যবিবাহ এবং তরুণী মাতা সমস্যার প্রতি এখন আমাদের জোর দিতে হবে। স্বাস্থ্যসুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে সমাজকে জড়িত করায় আমরা কাজ করছি এবং সাফল্যও পেয়েছি। এ বিষয়ে আমাদের বেশ কিছু কর্মসূচি রয়েছে, বিশেষ করে দরিদ্র অংশের প্রতি নজর দেওয়া হচ্ছে।
কেবল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সবকিছু করতে পারবে না, অন্যদেরও এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের কাছে তথ্য নেই যে কত জন মাতা ইতিমধ্যে রেজিস্ট্রেশন করেছেন। পোস্টমর্টাম হেমারেজ ও অ্যাকলামসিয়া মোকাবিলার মতো পর্যাপ্ত মাঠকর্মী নেই। অথচ ৩০ শতাংশ মা এই সমস্যায় মারা যান। পোস্টমর্টাম জন্মনিরোধক বিষয়ে আমরা সিলেট, ঢাকা, চট্টগ্রাম বিভাগে কাজ করছি। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহার অনিয়মিতকরণ বা বন্ধ করে দেওয়াও বিরাট সমস্যা।
তানিয়া সুলতানা
অনেক মানুষ সেবাকেন্দ্রে গিয়ে সেবা নেওয়ার প্রত্যাশাই করেন না। গ্রাম এলাকায় পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরা অনেক সময় তাঁদের সেবাকেন্দ্রে যেতে নিরুৎসাহিত করেন। শিক্ষিত ও সচ্ছল পরিবারেও অনেক সময় এ সমস্যা দেখা যায়। যতক্ষণ না তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে, ততক্ষণ পরিস্থিতি বদলাবে না। তাই সমাজ সচেতনতা তৈরি করতে হবে, পাশাপাশি সেবাগ্রহণের পরিবেশও সৃষ্টি করতে হবে। আর এটা করতে হবে সমন্বিতভাবে।
আর্থার এরকেন
বাংলাদেশের নারীরা পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের নারীদের মতোই চৌকস ও বাস্তববাদী। বলা হয়, বাংলাদেশের নারীরা নাকি বাড়িতেই প্রসবে আগ্রহী। বাড়িতে অন্তত তাঁরা সেবাযত্নটা পান। কিন্তু সরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে যেতে তাঁরা ভয় পান, কারণ সেখানে অবহেলা হয়। আপনি আজ সেবার মান উন্নত করুন, সবাই তখন সেবাকেন্দ্রে আসবেন। দরিদ্র তরুণী মায়েরা বেশি মারা যান। বিয়ের বয়স বাড়ালে মাতৃমৃত্যু কমে যাবে।
ড. ওবায়দুর রব
প্রতিবছর ৩০ লাখ শিশু জন্মায়। প্রতি জেলায় জন্মে ৬০ হাজার, প্রতি উপজেলায় চয় হাজার, প্রতি ইউনিয়নে ৬০০। বছরে মাতৃমৃত্যু হয় সাত হাজার, নামিয়ে আনতে হবে চার হাজারে। আমাদের তাই লক্ষ্যভিত্তিক কর্মসূচি নিতে হবে। আমাদের এখনই উচ্চঝুঁকিতে থাকা মায়েদের লক্ষ্য করে কাজ করতে হবে।
আমাদের যা সামর্থ্য রয়েছে, তা বণ্টন করে নিতে হবে। পরিবার পরিকল্পনা খাতে এনজিওগুলো কাজ করছে ৪০ বছর ধরে। এখনো জন্মনিয়ন্ত্রণে তাদের অবদান মাত্র ৫ শতাংশ। তাই সরকারের সেবাব্যবস্থা ও নেটাওয়ার্কও বাড়াতে হবে। সাধারণ বাংলাদেশি নারী সাধারণত ২৫-২৬ বছরের মধ্যেই সন্তান যা নেওয়ার নিয়ে নেন। এর পরের সময়টায় তাঁদের জন্মনিয়ন্ত্রণের আওতায় রাখতে পারাটা গুরুত্বপূর্ণ।
কেবল প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রসবের দিকে জোর দিলেই চলবে না। মাধ্যমিকে পড়ালেখা করালেই তরুণী মাতৃত্ব কমবে না, শিক্ষার সীমা আরও ওপরে তুলতে হবে। বাল্যবিবাহ বন্ধ হলেই বছরে ১০ লাখ জন্ম কমবে, কমবে মাতৃমৃত্যুও। পাঁচ থেকে ১০টি জেলাকে টার্গেট করে কাজ করলে কয়েক বছরের মধ্যেই সাফল্য পাব।
ড. মোহাম্মদ হোসাইন চৌধুরী
আমাদের প্রধান সমস্যা হলো, ঝুঁকিপূর্ণ মাকে চিহ্নিত করা। পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে প্রচার বাড়ানো সাফল্যের সূত্র। প্রসূতিদের সেবাকেন্দ্রে আসতে উৎসাহিত করতে পারলে মাতৃমৃত্যু কমবে। তাঁদের জানাতে হবে যে সেবাকেন্দ্রে এলে মা এবং সন্তানের জীবনের নিরাপত্তা বাড়বে। একই সঙ্গে সেবার মানও বাড়াতে হবে।
ড. তেকেন্দ্র কার্কি
ডব্লিউএইচও মিডওয়াইফদের প্রশিক্ষণে কাজ করে। আমরা তিন বছরের ডিপ্লোমা মিডওয়াইফ প্রশিক্ষণের পাঠ্যসূচি চালিয়ে থাকি। আমরা বয়ঃসন্ধিকালীন স্বাস্থ্য নিয়েও কাজ করি। এখানে প্রধান সমস্যা হলো মানবসম্পদের ঘাটতি, যেমন অ্যানেসথেসিস্ট এবং চিকিৎসক কম। নেপালে অ্যানেসথেসিস্টদের আড়াই গুণ বেশি বেতন দেওয়া হয়, যাতে তাঁরা গ্রামে কাজ করতে রাজি থাকেন।
নেপালে সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা চিকিৎসকদের দুই বছরের জন্য গ্রামে কাজ করতে পাঠানো হয়। নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের ছয় মাসের প্রশিক্ষণ দিলেও তাঁরা অ্যানেসথেসিস্টের ঘাটতি পূরণ করতে পারেন। এসব নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন কেবল সরকারই করতে পারে।
ড. এস এম আশরাফুল ইসলাম
এমডিজি ৪ ও ৫-এ যেভাবে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে, তা অর্জন করাই স্বাস্থ্য ও পরিবারপরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। এ উদ্দেশ্যে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে শক্তিশালী করাই আমাদের কৌশল। প্রসূতি ও নবজাতকের জন্য আমাদের আট হাজার সেবাকেন্দ্র রয়েছে। বাস্তবতা হলো, মেয়েদের পক্ষে এসব সেবাকেন্দ্রে যাওয়ার স্বাধীনতা থাকে না। শিক্ষাই এ সমস্যার উত্তর।
আমাদের এখন স্বাস্থ্যব্যবস্থা শক্তিশালী করার পাশাপাশি মানবসম্পদের ঘাটতি মেটানোর প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। এখানে গুরুতর লোকবলের অভাব রয়েছে। স্বাস্থ্য ক্যাডারে মাত্র ১৩০ জন অ্যানেসথেসিস্ট রয়েছেন, ৪০০-এর বেশি পদ খালি পড়ে আছে। কেউ অ্যানেসথেসিস্ট হতে চান না। নার্স, এফডব্লিউভি, এফডব্লিউএ, মিডওয়াইফ সবাই গ্রামীণ এলাকায় কাজ করেন, কিন্তু চিকিৎসকেরা সেখানে যেতে চান না।
তাই আমরা মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্য বিষয়ে স্বতন্ত্র ক্যাডার সার্ভিস চালু করছি। আমরা তিন হাজার মিডওয়াইফ প্রশিক্ষণ দেওয়ার আশা রাখি। প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে প্রুতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা বাংলাদেশ নার্সিং কাউন্সিল অ্যাক্টকে বদলে বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইভস কাউন্সিল করেছি। আমরা সরকারি খাতে নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি রেগুলেশনের খসড়া তৈরি করছি, নীতি তৈরি করছি। সিএসবিএ বিষয়েও আমরা কাজ করছি।
যাঁরা মা ও নবজাতকদের সেবা করবেন, তাঁদের অবশ্যই দক্ষ হতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে নার্সদের উপেক্ষা করা হয়েছে। নার্সিং পেশার গুরুত্ব ও মর্যাদা বাড়ানোয় সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। নার্স কলেজ ও ইনস্টিটিউটে এখন অভূতপূর্বভাবে ভর্তির আবেদন জমা পড়ে। আমরা সারা দেশের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে হাজার হাজার কোটি টাকা জোগান দিচ্ছি। কিন্তু কিছুই হবে না যদি না মানবসম্পদ তৈরি হয়।
দক্ষ কর্মী তৈরির সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য আমরা প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপকেও প্রসারিত করছি। মাঠপর্যায়ে ঘাটতি মেটাতে আমরা এনজিওগুলোকেও এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা এখন দুই বছরের নার্স প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালুর চিন্তা করছি। আমরা স্বাস্থ্য খাতের কর্মশক্তির সংখ্যা, অবয়ব ও কাঠামোর যৌক্তিকীকরণের দিকে যাচ্ছি।
মাঠপর্যায়ে সমন্বিত সেবা দেওয়ার দিকেও মনোযোগী হচ্ছি, কমিউনিটিকেও জড়িত করতে চাইছি। কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রসারের উদ্দেশ্যও তা-ই। শহরগুলোর বড় বড় হাসপাতাল স্বাস্থ্য খাতের লোকবলের বড় অংশই নিয়ে নিচ্ছে। এ জন্য আমরা কিছু পদ তৈরি করছি, যার নিয়োগ হবে আঞ্চলিক ভিত্তিতে। মিডিয়া হলো তৃতীয় চক্ষু, আপনারা আমাদের বুঝতে ও সমস্যা ধরিয়ে দিতে সাহায্য করবেন।
আর্থার এরকেন
মাতৃমৃত্যুর ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি হলেও মোটেও তা সন্তোষজনক নয়। এখনো বছরে সাত হাজার নারী প্রসবের সময় মারা যান। আগামী তিন-চার বছরে এই হার ২৫-৩০ শতাংশ কমাতে না পারলে ২০১৫ সালের এমডিজি লক্ষ্য পূরণ করা যাবে না। মাতৃমৃত্যুর হার কমাতে হলে সেবাকেন্দ্রগুলোকে কেবল যন্ত্রপাতিসজ্জিত করলেই হবে না, সেগুলোকে মানবসম্পদের পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করতে হবে। সেবাকর্মীর বিপুল ঘাটতি রয়ে গেছে বাংলাদেশে।
সিএসবিএ থেকে চিকিৎসক পর্যন্ত বিস্তৃত পরিসরজুড়ে দক্ষ মানবসম্পদের প্রয়োজনে আমাদের যৌথভাবে কাজ করে যেতে হবে। এখানেই রেফারেল সিস্টেমের বিষয়টি জড়িত। ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মী যদি কোনো সেবাদানে অপারগ হলে তারা রোগীকে উপজেলা পর্যায়ে পাঠাবে। উপজেলা হাসপাতাল না পারলে জেলা পর্যায়ে যাবে। এটা করাই আমাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশে অনেক চিকিৎসক, অনেক চিকিৎসা ক্যাডার ও পর্যাপ্ত অর্থ সরবরাহ রয়েছে। এই তিনটি উপাদানকে সমন্বিতভাবে কাজে লাগানোই আসল কাজ। চিকিৎসা খাতে বছরে আট বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়, যা বিশ্বের মধ্যে অন্যতম বৃহৎ। আমাদের দরকার অঞ্চলভিত্তিক টার্গেট এবং লক্ষ্যভিত্তিক হস্তক্ষেপ। নাজুক অঞ্চলের দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। এসব এলাকার মানুষজনকে সেবাপ্রাপ্তির বিদ্যমান ব্যবস্থাগুলো জানাতে হবে, যাতে তারা দরকারের সময় সঠিক জায়গায় গিয়ে সেবা চাইতে পারে। নারীরা যে অনেক সময় হাসপাতালে যেতে চান না, এটা তাঁদের সমস্যা নয়। এটা স্বাস্থ্যব্যবস্থার সমস্যা।
মাতৃমৃত্যুর পরোক্ষ কারণগুলোর দিকেও তাকাতে হবে। হতে পারে এটা গর্ভপাত, অপুষ্টি এবং অন্যান্য কারণ। সেগুলো চিহ্নিত করা জরুরি। এ ব্যাপারে যথেষ্ট গবেষণার ঘাটতি রয়েছে। অন্যদিকে আইনত বিয়ের বয়স ১৮ হলেও আমাদের অর্ধেক নারীর বিয়ে হয় এর থেকেও কম বয়সে। এই বয়সের একটি মেয়ে কার্যত যৌনতা, দাম্পত্য ও পরিবারপরিকল্পনা সম্পর্কে কিছুই জানে না। তাই বিয়ের বয়স নিয়ে আইন বাস্তবায়নের পথ বের করতেই হবে। নারী শিক্ষার বেলায় মাধ্যমিক বা সেকেন্ডারি পর্যায় পেরিয়ে আমাদের এখন অধিকতর উচ্চশিক্ষা পর্যায় নিয়ে কাজ শুরু করা উচিত। বাংলাদেশের সব সামাজিক সূচকে অগ্রগতি হলেও বিয়ের বয়স এবং নারী স্বাস্থ্যের বেলায় পরিস্থিতিটা সন্তোষজনক নয়।
জোগান ও চাহিদা দুই দিকেই সচেষ্ট হলে ২০১৫ সালের মধ্যে এমডিজি অর্জন করা সম্ভব হতে পারে। কিন্তু সেটাই যথেষ্ট নয়, হাজারের মধ্যে ১৪৩টি মাতৃমৃত্যু পর্যায়ে পৌঁছানোর পরও তা ইউরোপীয় মানের থেকে ২০ গুণ বেশিই থাকবে। বাংলাদেশের সব নারীরই সন্তান ধারণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ার অধিকার যেমন রয়েছে, তেমনি নিরাপদ প্রসব এবং বেঁচে থাকারও অধিকার রয়েছে।
মাহ্ফুজ আনাম
ইউএনএফপিএর সঙ্গে আমাদের অংশীদারির ইতিহাস দীর্ঘদিনের। আপনাদের সঙ্গে প্রতিটি গোলটেবিল বৈঠকের পরে আমি আরও সজ্ঞান হই এবং আমাদের কর্তব্য সম্পর্কেও সজাগ হই। চমৎকার একটি কথা আছে, কোনো মাকেই যেন জীবন দেওয়ার সময় জীবন হারাতে না হয়।
পরিবারে একটা সুন্দর ঘটনা ঘটছে, অথচ মাকে যেখানে জীবনের ঝুঁকি নিতে হচ্ছে, সেখানে তাঁর জীবনসঙ্গী হয়তো সে বিষয়ে সচেতনই নন? এখানে জেন্ডার প্রশ্নটাও আসে। পুরুষ হিসেবে আমাদের তাই ব্যক্তিগত ও সামাজিক স্তরে আরও সচেতন হওয়ার আছে। যিনি জীবন দিচ্ছেন, তাঁর জন্য সমাজকে এটা করতেই হবে।
এটা শুনে আমি তো চমকে গিয়েছি যে একমাত্র বিয়ের বয়স ছাড়া আর সব সামাজিক ক্ষেত্রে আমরা সঠিক লক্ষ্যেই এগোচ্ছি। ডেইলি স্টার-এর পক্ষ থেকে এ বিষয়ে মনোযোগ নিবদ্ধ করা এবং যতটা সম্ভব সামাজিক আন্দোলন তৈরির ব্যাপারে আমরা দায়বদ্ধ।
এ বিষয়ে আমরা আপনাদের সহযোগিতা চাই এবং আমাদের সহযোগিতারও প্রস্তাব দিচ্ছি। আইনত নারীদের বিয়ের বয়স ১৮ থাকা সত্ত্বেও এখনো ৫০ শতাংশ নারীর বিয়ে হয় ১৬ বছরের নিচে। প্রথমত এটা আইনেরও লঙ্ঘন। আইন ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে জন্ম নিবন্ধন না থাকার জন্য, সে কারণে বয়স বাড়িয়ে দেখানো সম্ভব হচ্ছে। আইন প্রয়োগের সমস্যাও কম জরুরি নয়।
ইংরেজি পত্রিকার পাঠক নারীরা নিশ্চয়ই প্রসবের সময় মারা যান কম। কিন্তু সংবাদপত্র হিসেবে আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক স্তরে সচেতনতা তৈরি করতে পারি। নীতিনির্ধারক, চিকিৎসক সমাজ এবং সরকারের মধ্যেও আমরা তাগাদা তৈরি করতে পারি।
আর্থার বলেছেন, বাংলাদেশে বার্ষিক পাঁচ বিলিয়ন ডলার স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হয় এবং এটা বিশ্বের মধ্যে বৃহত্তম। বিস্ময়কর! এর ৭০ শতাংশই যেখানে সরকার দিয়ে থাকে, সেখানে আমাদের কাজ হচ্ছে এর সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা। আপনারা আমাদের এ বিষয়ে পরামর্শ দেবেন, চাপ দেবেন। এ বিষয়ে আমাদের হূদয় সংবেদনশীল এবং দায়বদ্ধতা অকৃত্রিম। মাতৃস্বাস্থ্যের সুরক্ষার বিষয়ে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁরা আমাদের পাশে পাবেন। আমাদের সংগ্রাম এবং যাত্রা শেষ পর্যন্ত চলমান থাকুক।
সূত্র-প্রথম আলো