সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯, এমপক্স, এন্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সসহ জটিল স্বাস্থ্য পরিস্থিতি বিবেচনায় এবারের প্রতিপাদ্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিবেচনা করলে একজন ফার্মাসিস্ট বিভিন্ন বিষয়ে অবদান রাখতে পারে, যার মধ্যে —
ক) ওষুধের ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়াদি দেখভাল করা
খ) কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে রোগীর সেবা প্রদান
গ) জনস্বাস্থ্য উন্নতিকল্পে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ
ঘ) অতিসহজে ও দ্রুত স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ নিশ্চিতকরণ
ঙ) এন্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স রোধকল্পে ভূমিকা রাখা
চ) দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ওষুধনীতির বিষয়ে অবদান রাখা উল্লেখযোগ্য।
সমন্বিত স্বাস্থ্যব্যবস্থায় ফার্মাসিস্টদের অবদানকে স্মরণীয় করার জন্যই এই দিবস যা একসঙ্গে বিশ্বের ১৯৩ দেশে পালিত হয়ে থাকে। প্রসঙ্গত, PHARMACIST শব্দটিকে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করলে দাঁড়ায়— P=Patience (ধৈর্য), H=Honesty (সততা), A=Alertness (সতর্কতা), R=Research (গবেষণা), M=Motivator (প্রেরণাদানকারী), A=Administrator (প্রশাসক), C=Courageous (সাহসী), I=Intelligent (বুদ্ধিমান), S=Studious (পড়ুয়া), T=Thinker (চিন্তাশীল)।
আমেরিকান ফার্মেসি অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, ফার্মাসিস্টরা ওষুধের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে এবং জনস্বাস্থ্যের উন্নতির লক্ষ্যে প্রশিক্ষিত হয়। ফার্মাসিস্টরা স্বাস্থ্যসেবাকাজে অংশগ্রহণ করলে ওষুধের যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত হয়, অতিসহজে ও দ্রুত স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং স্বাস্থ্যসংক্রান্ত ব্যয় কমে আসে। সাম্প্রতিক সময়ে উন্নত বিশ্বে ফার্মেসি অনুশীলন ক্রমবর্ধমানভাবে ডিসপেন্সিং হতে রোগীদের কাউন্সেলিংয়ের দিকে মোড় নিচ্ছে, যা রোগীকেন্দ্রিক সমন্বিত চিকিৎসাব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করে তুলছে।
যাই হোক, এবার আসা যাক বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। বাংলাদেশে ফার্মেসি পেশার ইতিহাস অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল। সমন্বিত স্বাস্থ্যব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশীজন এই পেশাজীবীরা (ফার্মাসিস্ট) সামগ্রিকভাবে বেশ সফল ও অগ্রসরমান মনে হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের এখনো বহুদূর পথ পাড়ি দেওয়ার বাকি। মোটামুটিভাবে বাংলাদেশের ফার্মাসিস্টরা ৬টি মূলধারায় তাদের অবদান রেখে চলছে। এগুলো হলো— ওষুধ প্রস্তুতকরণ, ওষুধ বিপণন, হাসপাতাল ফার্মেসি, কমিউনিটি ফার্মেসি, ওষুধবিষয়ক গবেষণা এবং শিক্ষকতা।
বাংলাদেশে ওষুধ প্রস্তুতকরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ফার্মাসিস্টদের সাফল্য অত্যন্ত দৃশমানের। তাদের কল্যাণে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার শতকরা প্রায় ৯৯ ভাগ ওষুধ স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি করতে সক্ষম, যার দাম অত্যন্ত প্রতিযোগিতাপূর্ণ এবং মান আন্তর্জাতিক আদর্শের। বাংলাদেশে বহুল ব্যবহৃত একটি প্যারাসিটামল ট্যাবলেটের দাম ৮০ পয়সা, যা পার্শ্ববর্তী অনেক দেশের চাইতে ঈষৎ কম এবং আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের প্রায় ১৫ ভাগের একভাগ। হেপাটাইটিস-সি বিরোধী ওষুধ সোফোসবুভির ও ভেলপাটাসভির কম্বিনেশন বাংলাদেশে প্রতি ট্যাবলেট বিক্রয় হয় ১০০০ টাকায়। অন্যদিকে এই একই ট্যাবলেট যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রয় হয় ২০৪২৯ টাকায়। নিঃসন্দেহে এটি একটি দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্য এটি অত্যন্ত ইতিবাচক এবং আশাপ্রদ।
এতদসঙ্গে নতুন নতুন ওষুধ উপস্থাপন, অভ্যন্তরীণ ওষুধের বাজারে প্রতি বছর দুই-সংখ্যার প্রবৃদ্ধি, জ্ঞানভিত্তিক বিপণন, ওষুধের সঠিক তথ্য সরবরাহ, মান বজায় রেখে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত ওষুধের সঠিক সরবরাহ নিশ্চিত করা, বিশ্বের প্রায় ১৫০ দেশে ওষুধ রপ্তানি, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি বছর শতকরা ২০ ভাগের বেশি প্রবৃদ্ধি নিঃসন্দেহে বিপণন সংশ্লিষ্ট ফার্মাসিস্টদের আন্তরিক চেষ্টা ও পরিশ্রমের ফসল।
ফার্মেসি পেশার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো— হাসপাতাল ফার্মেসি, যা সারা বিশ্বে অত্যন্ত স্বীকৃত ও বহুল প্রচলিত। যে কারণেই হোক বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এই সেক্টরটি আশানুরূপভাবে অগ্রসর হতে পারেনি। হাতেগোনা কিছু বড়মানের বেসরকারি হাসপাতাল ছাড়া অন্য কোথাও গ্র্যাজুয়েট হাসপাতাল ফার্মাসিস্টরা কাজ করছে বলে জানা যায় না। যে কারণে রোগীরা ওষুধের সঠিক ডিপেনসিং, কাউন্সেলিং, অনন্য ওষুধের সঙ্গে আন্তক্রিয়া, সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং এ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। রোগীর স্বার্থ বিবেচনায় সরকারিভাবে হাসপাতাল ফার্মেসি চালুর প্রক্রিয়া আরও ত্বরান্বিত করা প্রয়োজন। প্রসঙ্গত এই সেক্টরে দক্ষ জনবল তৈরির সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থাপনা থাকা অত্যাবশ্যক। তা ছাড়া হাসপাতাল ফার্মেসি চালু হলেও রোগীরা কাঙ্ক্ষিত সেবা লাভ থেকে বঞ্চিত হতে পারে।
মানসম্পন্ন সঠিক ওষুধ ক্রয়, যথাযত প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ, ওষুধের যৌক্তিক ব্যবহার, নির্দেশনার বিপরীতে সঠিক ওষুধ প্রাপ্তি নিশ্চিত করা, সুনির্দিষ্ট কাউন্সেলিং প্রভৃতি সেবার জন্য প্রতিটি আদর্শ ওষুধের স্টোরে (ফার্মেসি) একজন গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট থাকা অত্যাবশ্যক যারা কমিউনিটি ফার্মাসিস্ট হিসেবে পরিচিত। সীমিত আকারে বাংলাদেশে কমিউনিটি ফার্মেসি চালু হলেও এখনো তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। সঠিক চাকরিবিধি ও তার প্রকৃত বাস্তবায়ন না থাকার কারণে ফার্মেসি পেশার এ উইংটি এখনো পরিপক্কতা লাভ করেনি। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে দেশে প্রায় ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রচুর পরিমাণে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট তৈরি হচ্ছে। কমিউনিটি ফার্মেসি পূর্ণাঙ্গভাবে চালু না হলে বিপুলসংখ্যক এই ফার্মাসিস্ট বেকার থেকে যাবে, যা হবে অত্যন্ত নেতিবাচক।
এসবের বাইরে ফার্মাসিস্টদের অন্যতম প্রধান কাজ গবেষণা, যার সম্ভাবনা অপার। দুঃখজনক হলেও সত্য দেশের অভ্যন্তরে আমাদের ফার্মাসিস্টদের এখানে অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। সে যাই হোক, ফার্মাসিবিষয়ক গবেষণা বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তিনটি ধারায় বিভক্ত। এগুলো হলো— ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি, ফার্মাসিউটিক্যাল বায়োটেকনোলজি এবং ফার্মেসির প্রতিটি বেসিক উইং এ গবেষণা। অতিশিগগির মুন্সীগঞ্জের গজারিয়াতে ওষুধের কাঁচামাল তৈরির বিশাল একটি পার্ক উৎপাদন শুরু করতে যাচ্ছে। যেখানে প্রচুরসংখ্যক ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট দরকার। তবে এটাই সত্যি যে, আমাদের দেশে এ বিষয়ে অভিজ্ঞ ফার্মাসিস্ট হাতেগোনা দুয়েকজন বা নেই বললেই চলে। তাই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এই বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া জরুরি।
আধুনিক ওষুধশাস্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো— ফার্মাসিউটিক্যাল বায়োটেকনোলজি, দুয়েকটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি এটি নিয়ে কাজ শুরু করলেও এখনো তা আতুড়ঘরে। আমাদের ওষুধশিল্পকে পরবর্তী উন্নততর পর্যায়ে নিতে এ বিষয়ে গবেষণার কোনো বিকল্প নেই।
ব্যক্তিপর্যায়ে কিছু শিক্ষকের স্বতন্ত্র গবেষণা ছাড়া সামগ্রিকভাবে ওষুধশিল্পের অগ্রগতির জন্য আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খুব একটা গবেষণা হয় না বললেই চলে। অথচ এটা শুধু গুরুত্বপূর্ণই নয়, তা এই শিল্পের জন্য অপরিহার্যও বটে। তাই এই বিষয়টির প্রতি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এবং একাডেমিক ফার্মাসিস্টদের একটি সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন, যা বাংলাদেশের ওষুধশিল্পকে দিতে পারে এক ভিন্নমাত্রা।
লেখক: ড. মো. আবু জাফর সাদেক, ফার্মাসিস্ট, ইউনিমেড ইউনিহেলথ ফার্মাসিউটিক্যালস এ কর্মরত রয়েছেন। ই-মেইল: azs_sohel@yahoo.com