আরিফুন নেছা সুখী
বয়ঃসন্ধি শব্দের আভিধানিক অর্থ শৈশবের শেষ ও যৌবনের আরম্ভ। বয়ঃসন্ধিকাল হচ্ছে শৈশব ও প্রাপ্ত বয়সের মাঝামাঝি সময় অর্থাত্ শৈশব ও যৌবনের মিলনস্থল। এ সময়ে শরীর ও মনে আসে নানান পরিবর্তন। ছেলেদের ক্ষেত্রে এ পরিবর্তন শুরু হয় ৯ থেকে ১৪ বছর বয়সের মধ্যে আর মেয়েদের বেলায় ৮ থেকে ১৩ বছর বয়সের মধ্যে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সীরাই কিশোর-কিশোরী। এ বয়স অঙ্কুরিত, প্রস্ফুটিত ও বিকশিত হওয়ার।
চোখে-মুখে থাকে সজীবতার ঝিলিক। ওরা হাসে-কাঁদে, কারণে বা অকারণে। চোখের সামনে যা দেখে তাই ওদের ভালো লাগে। দেহমনে জাগে দুরন্তপনা। কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় ‘থাকবো না কো বদ্ধ ঘরে/দেখবো এবার জগত্টাকে।’ দুরন্ত কিশোর বিশ্ব সংসার দেখার নেশায় মাতে আর কিশোরী ঠাঁই নেয় অন্দর মহলে। দেহমনে আসে লজ্জা, ভয় ও শঙ্কা।
আগেই বলা হয়েছে বয়ঃসন্ধি হলো দুই বয়সসীমার মিলনস্থল। এখানে শৈশব পেরিয়ে যৌবন আসে। কখনও কখনও আবার কারও বেলায় বোঝা যায় না, সে ঠিক কিশোর বা কিশোরী, নাকি প্রাপ্ত বয়স্ক। তাই এ ক্ষেত্রে সন্ধির চেয়ে দুই বয়সসীমার দ্বন্দ্ব লেগে যায় বেশি।
অরণ্য অতিন্দ্রিলা সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী। সে জানায়, তার কথা শুনলে তার মা কখনও বলেন ‘ছোট মুখে বড় কথা বলবে না’ আবার কখনও বলেন ‘তুমি এখন আর বাচ্চা মেয়েটি নেই, বড় হয়েছ।’ অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী ঋন্তি রশিদও জানালো তার ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটে। আবার নবম শ্রেণীর ছাত্র শিহাব শাহরিয়ারও বলে বাবা-মা তাকে কখনও ছোট মনে করেন কখনও আবার মনে করেন বেশ বড়। আমার পছন্দের কোনো বিষয়ই তাদের পছন্দ হয় না।
দ্বিধান্বিত এসব কিশোর-কিশোরী তাদের পদযাত্রায় ভাবতে থাকে কী জানি কী হয়! শারীরিক ও মানসিকভাবে ভীষণ রকম এক পরিবর্তনের মাঝে এসে দাঁড়ায় তারা। পারিবারিক ও সামাজিক বিধিনিষেধে জীবনের গতি হয়ে যায় পরিবর্তিত।
কিশোরীদের গতির দিক পরিবর্তন করে তাকে বেঁধে ফেলা হয় একটি সংকীর্ণ গণ্ডির ভেতরে। আর কিশোররা হতে চায় বাধা-বন্ধনহীন। কৈশোরের শুরুতে ভালোবাসার প্রকাশ যেমন দাবানলের মতো জ্বলে উঠতে পারে আবার রাগ প্রকাশেও চলে আসে উগ্রতা। তীব্র আনন্দ অথবা তীব্র বেদনায় ওরা কাতর হয়ে ওঠে।
বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিকও এই কৈশোর বয়স নিয়ে সাহিত্য রচনা করেছেন। তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পের ফটিক চরিত্রটি। কবির ভাষায়—
‘বিশেষত, তের-চৌদ্দ বছরের ছেলের মত পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই। শোভাও নাই, কোন কাজেও লাগে না। স্নেহও উদ্রেক করে না, তাহার সঙ্গসুখও বিশেষ প্রার্থনীয় নহে। তাহার মুখে আধো-আধো কথাও ন্যাকামি, পাকা কথাও জ্যাঠামি এবং কথা মাত্রই প্রগলভতা। হঠাত্ কাপড়চোপড়ের পরিমাণ রক্ষা না করিয়া বেমানান রূপে বাড়িয়া উঠে; লোকে সেটা তাহার একটা কুশ্রী স্পর্ধা স্বরূপ জ্ঞান করে। তাহার শৈশবের লালিত্য এবং কণ্ঠস্বরের মিষ্টতা সহসা চলিয়া যায়, লোকে সে জন্য তাহাকে মনে মনে অপরাধ না দিয়া থাকিতে পারেন না। শৈশব ও যৌবনের অনেক দোষ মাপ করা যায়, কিন্তু এই সময়ের কোন স্বাভাবিক ত্রুটিও যেন অসহ্য বোধ হয়।’
কিশোর-কিশোরীরা পড়ে যায় দ্বন্দ্বের ভেতরে। তাদের ঠিক কি করা উচিত তা তারা বুঝতে পারে না। তাই তাদের লজ্জা, ভয়, কুসংস্কার ও গোপনীয়তাকে সরিয়ে ফেলে নিজেকে ভালোভাবে জানতে হবে। জানতে হবে পরিবার ও সমাজ। ভয় বা লজ্জা না পেয়ে বড়দের সাহায্য নিতে হবে। আড়ালে আবডালে নিজের সমস্যা লুকিয়ে না রেখে খুব কাছের কোনো একজনকে বলতে হবে। বুঝতে হবে সেও এমন সময় পার করেছে, তাই তার অভিজ্ঞতা কাজে লাগবে। বোকামি করে কখনই কাজের মানুষ বা অশিক্ষিত কোনো ব্যক্তির সাহায্য নেবে না। তারা ভুল ধারণা দিয়ে একটা ভীতির সৃষ্টি করতে পারে। তাই মা-বাবা, ভাই-বোন বা খুব কাছের মানুষের কাছে নিজের সমস্যা খুলে বলতে হবে।
বড়দেরও এ সময় একটু বেশি সচেতন থাকতে হবে—বললেন কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর থানার স্বাস্থ্য সহকারী রুবী রহমান। তার মতে, বড়রা যদি একটু খোলামেলাভাবে বয়ঃসন্ধির বিষয়গুলো বুঝিয়ে দেন, তাহলে তাদের মধ্যে আর কোনো জড়তা থাকবে না। স্বাভাবিক নিয়ম বলেই মেনে নেবেন। স্বাস্থ্য সহকারী, শিক্ষক-শিক্ষিকা সবারই উচিত বয়ঃসন্ধি বিষয়ে কিশোর-কিশোরীদের ধারণা দেয়া। তবে সবচেয়ে বড় সমর্থন থাকতে হবে পরিবারের। নিজের শৈশবকে মনে করার চেষ্টা করুন, দেখবেন আপনিও এদের চেয়ে কম দুরন্ত ছিলেন না। কিংবা আপনিও নিশ্চয় সব সময় রবীন্দ্রসঙ্গীত বা নরম সুরের গান পছন্দ করতেন না। কখনও মনের অজান্তেই আপনিও শুনেছেন রক মিউজিক। তাই তাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে না গিয়ে নিজেদের মধ্যে সন্ধি করুন। খারাপ দিকগুলো পরিহার তো অবশ্যই করতে হবে। তবে সব ব্যাপারেই খারাপ খুঁজবেন না। সন্দেহ না করে খোলামেলা আলোচনা করুন। তাদের মতের মূল্য দিন।
তাদেরকে বোঝান ভালো মন্দের পার্থক্য। মনে মনে তাদের দোষগুলো ঢেকে রেখে দুরত্ব সৃষ্টি করবেন না। কাছে ডেকে বুঝিয়ে বলুন। ‘আমার ছেলে খারাপ হয়ে গেছে, মেয়েটা কথা শুনছে না’- এভাবে হায় হুতাশ না করে ছেলে বা মেয়ের সমস্যাগুলো নিয়ে খোলামেলা কথা বলুন। তারা কোন কোন জায়গায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে এটা খেয়াল করুন। তাদের বোঝান, তারা যা করছে তা ঠিক না। দেখবেন ওরা বুঝবে। অযথা হায় হুতাশ বা রাগারাগি না করে সন্ধি করুন। নিজেদের সমস্যা নিজেরা মিটিয়ে নিন। ছেলে মেয়ের সঙ্গে রাগ করে তাদের সঙ্গে দুরত্ব সৃষ্টি করবেন না। কাছে ডেকে ভালোবেসে তাদের বোঝান আপনারা তাদেরকে কতটা ভালোবাসেন। তাই বয়ঃসন্ধিতে দ্বন্দ্ব না করে ফেলুন সন্ধি।