॥ ই-হেলথ২৪ রিপোর্ট ॥ প্রায় ২৬ বছর আগে রেলওয়ের সবাইকে সেবা দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল। হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠার ২৬ বছর পরও সঠিকভাবে চলছে না এর কার্যক্রম। সঠিক সেবা না পাওয়ায় এখানে রোগীর সংখ্যা একেবারেই কম। রোগীদের অভিযোগ, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চিকিৎসকদের দেখা মেলে না বললেই চলে। সন্ধ্যা নামলেই এখানে বসে মাদকের আসর। হাসপাতাল-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পাহাড় পরিমাণ অভিযোগ থাকলেও কোনো প্রতিকার মিলছে না।
রাজধানীর শাহজাহানপুরে ১৯৮৬ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ইনডোর-আউটডোর সুবিধা রেখে ৭৫ শয্যার এ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন।
দ্বিতীয় তলার ২ নম্বর কেবিনে ভর্তি ফরিদ আলম অনেকটা ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, ‘এ হাসপাতাল শুধু সর্দি ও জ্বরের জন্য। পাঁচ-সাত টাকার ওপরে ওষুধের প্রয়োজন হলেই বাইরে থেকে আনতে হয়। আর জটিল কোনো রোগ হলে নিজের বাঁচার তাগিদেই অন্যত্র চলে যেতে হয়।’
শাহজাহানপুর রেলওয়ে স্টাফ কোয়ার্টারের মোহাম্মদ ইসহাক আহম্মেদ বুলেটের বাবা রেলের কর্মচারী ছিলেন। মা, ভাইবোন নিয়ে তাঁদের চারজনের সংসার। চিকিৎসা পাওয়ার আশায় প্রায়ই শাহজাহানপুর রেলওয়ে হাসপাতালে যান তাঁরা। কিন্তু এ হাসপাতালে চিকিৎসা বলে কিছু নেই মন্তব্য করে বুলেট বলেন, ‘কয়েক মাস আগে আমার বড় বোন জটিল রোগে আক্রান্ত হন। এ ব্যাপারে রেলওয়ে হাসপাতালে গেলে তারা অপারগতা প্রকাশ করে। তারপর শাহজাহানপুর ইসলামী হাসপাতালে বেশ কিছু টাকা নেওয়া হলেও কোনো উপকার হয়নি। পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি (বিএসএমএমইউ) হাসপাতাল থেকে আরোগ্য লাভ করেন। অথচ রেলওয়ে হাসপাতালে যদি চিকিৎসাসেবা পাওয়া যেত, তাহলে আমাদের আর ভোগান্তি পোহাতে হতো না।’
এ ধরনের একাধিক ব্যক্তির অভিযোগ রয়েছে হাসপাতালটির বিরুদ্ধে। সরকারি অর্থে পরিচালিত এ হাসপাতালের সার্বিক কাজকর্মে রয়েছে চরম অব্যবস্থাপনা। ডাক্তাররা সময়সূচি না মেনে নিজেদের ইচ্ছামতো কাজ করছেন। হাসপাতালের নিয়ম অনুসারে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত বহির্বিভাগ চালু থাকার কথা।
কিন্তু নির্ধারিত সময়ের আগেই বহির্বিভাগ বন্ধ পাওয়া যায়। নামমাত্র বহির্বিভাগ চালু থাকলেও সুবিধা পাচ্ছে না সাধারণ রোগীরা। গতকাল সোমবার জরুরি বিভাগে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও কোনো ডাক্তারের দেখা মেলেনি। এ সময় জরুরি বিভাগের সহকারী সার্জন ডা. এস আই আবদুল আহাদের কক্ষটি তালাবদ্ধ অবস্থায় ছিল।
হাসপাতালের এক কর্মচারী জানান, রোগীর সংখ্যা কম থাকায় ডাক্তাররা নির্দিষ্ট কক্ষে বসেন না। রোগী এলে তাঁরা ফোন করে ডাক্তার ডেকে আনেন। তাঁর দাবি, ডাক্তারদের অনুপস্থিতি নিয়ে এ পর্যন্ত তেমন কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি।
হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায় হাসপাতালের অধিকাংশ কক্ষে তালা ঝুলানো। স্যাটেলাইট ক্লিনিক ও রেডিওলজি বিভাগের তালার ওপর মরিচা পড়ে গেছে। ১৫৪ নম্বর কক্ষ রোগীদের ওষুধ দেওয়ার জন্য সংরক্ষিত। অথচ সকাল থেকে দুপুর ২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষা করে বহির্বিভাগ চালু থাকলেও কক্ষটি খুলতে দেখা যায়নি। রোগীদের অভিযোগ, বহির্বিভাগে কখনো কোনো রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হলেও হাসপাতাল থেকে ওষুধ দেওয়া হয় না।
এ হাসপাতালের বহির্বিভাগের পাশাপাশি ইনডোর সেবাও রয়েছে। কিন্তু এ ইনডোর ব্যবস্থায়ও রয়েছে চরম অব্যবস্থাপনা। হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় রয়েছে ইনডোর ব্যবস্থা। এখানে ৭৫টি শয্যার বিপরীতে রোগী আছে মাত্র দুজন। তাদেরও অভাব-অভিযোগের শেষ নেই। ইনডোর বিভাগ ঘুরে দেখা যায়, এ শাখায় দুটি কক্ষ রয়েছে। এর একটি কক্ষ বেশ কয়েক বছর ধরেই পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। অন্য কক্ষে গিয়ে কথা বলে জানা যায় কর্তৃপক্ষের অবহেলার ফিরিস্তি।
ফয়েজ আহম্মদ নামের একজন রেলওয়ের স্টাফ তাঁর স্ত্রী নাজমা বেগমকে এখানে ভর্তি করান। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘সকাল থেকে অপেক্ষা করে দুপুরে ভর্তি করানো সম্ভব হয়েছে। কিন্তু তিন-চার ঘণ্টা ব্যবধানেও ডাক্তারের দেখা পাওয়া যায়নি। বেশ কয়েকবার ডাক্তারকে সন্ধানের পর একজন নার্স এসে কোনো কিছু যাচাই-বাছাই না করেই একটি স্যালাইন দিয়ে চলে যান। পরে এ নার্সেরও দেখা মেলেনি আর। এ ব্যাপারে অভিযোগ করতে গিয়ে আরো উল্টো ধমকের শিকার হয়েছি।’
এ হাসপাতালের মহিলা ওয়ার্ডের ১০ নম্বর বিছানার রোগী জাহানারা আক্তার অভিযোগ করে বলেন, ‘দেশের যেকোনো সরকারি হাসপাতালের তুলনায় এর অবস্থা খারাপ। আমি এখানে ভর্তি হওয়ার পর আমার সঙ্গে কেউ থাকতে পারে না। কারণ এখানে হাসপাতালের টয়লেটের অবস্থা এতটাই খারাপ যে কেউ ভেতরে ঢুকলেই অসুস্থ হয়ে পড়বে। এ ছাড়া বিদ্যুতের লাইনে সমস্যা, মেঝে স্যাঁতসেঁতে, ডাক্তার ও নার্সদের দেখা মেলে না সারা দিনেও। খালি কক্ষে পড়ে কোনো রোগী মারা গেলেও দেখার কেউ থাকবে না।’
ডাক্তার, নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবহেলায় এ হাসপাতাল এখন মৃতপ্রায়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, রোগী নেই বলে কাজ চলে ঢিলেঢালাভাবে। কিন্তু রোগীরা বলছে, সেবার নূ্যনতম চাহিদা পূরণ না হওয়ায় এ হাসপাতাল বিমুখ হচ্ছে তারা। এ ছাড়া বিশাল আয়তনের এ হাসপাতালে সন্ধ্যা নামলেই বসে মাদকসেবীদের আড্ডা। হাসপাতালের পাশের রেলওয়ে কলোনির বাসিন্দা আকমল হোসেন বলেন, ‘নিরাপত্তাব্যবস্থা দুর্বলের কারণে ভাসমান মাদকসেবীরা প্রতিদিনই উৎপাত করে। অনেক সময় স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও ধূমপানের নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে হাসপাতালকে বেছে নেয়।’
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতালের ডিভিশনাল মেডিক্যাল অফিসার ডা. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘হাসপাতালের পক্ষ থেকে আমাদের সাধ্যমতো চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। তবে কিছু সীমাবদ্ধতার জন্য হয়তো শতভাগ সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। এখনো কেবিনসহ ১৬ জন রোগী ভর্তি রয়েছে। তাদের চিকিৎসার জন্য প্রতিনিয়ত ডাক্তারও আছেন। আর জনবল সংকটে আমরা সাময়িক সমস্যায় আছি_এ কথা সত্য। আশা করছি, খুব শিগগির এ সমস্যার সমাধান হবে।’ রাতে হাসপাতালে মাদকের বিচরণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এত বড় হাসপাতালে মাত্র একজন নিরাপত্তাকর্মী রয়েছেন। এ কারণে বহিরাগতরা নানা সমস্যার সৃষ্টি করে থাকে।’