মাহবুব মেহেদী
পশ্চিম আফ্রিকার দেশ বেনিনে অধিকাংশ মানুষই কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে৷ কিন্তু কৃষি থেকে আসা অল্প আয় দিয়ে পরিবারের ভরণ পোষণ করা সম্ভব হয়না অনেকের পক্ষে ৷ তাই ভেষজ উদ্ভিদ উৎপাদনের দিকেও ঝুঁকেছেন কোনো কোনো কৃষক৷
বেনিনের পাহাড়ঘেষা ছোট্ট গ্রাম টোকোরোতে বসবাস করেন ১৪০০ মানুষ, যাদের বেশিরভাগই কৃষিজীবী৷ অসুখ বিসুখ হলে তাঁরা গ্রামের চিকিৎসকদের কাছেই ছুটে যান৷ টোকোরো গ্রামে ১২ জন চিকিৎসক রয়েছেন, যাঁরা ঐতিহ্যবাহী ভেষজ উদ্ভিদের মাধ্যমে চিকিৎসা করেন৷ বছর তিনেক আগে এক বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে বেনিনে ভেষজ চিকিৎসার ওপর বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে৷ এই সংস্থাটি বন জঙ্গল সুরক্ষার পাশাপাশি প্রায় লুপ্ত হয়ে যাওয়া ভেষজ উদ্ভিদ রক্ষারও ব্যবস্থা করেছে৷ তৈরি করেছে পরিকল্পিত বাগান৷ এ প্রসঙ্গে ভেষজ চিকিৎসক গেরা বুকো জানান, ‘‘সংস্থাটি এই ধরনের উদ্যোগ নেয়ার আগে থেকেই আমরা প্রাচীন পদ্ধতিতে চিকিৎসা করে আসছি৷ তবে এই সংস্থার কল্যাণে আমরা এখন সংঘবদ্ধ হয়ে যে কোনো রোগের চিকিৎসা করতে সক্ষম হচ্ছি৷” ভেষজ উদ্ভিদের বাগানটির আয়তন এক হেক্টরের মত৷ বাগানে লাগানো ৫০ জাতীয় উদ্ভিদ ও গাছগাছালির রয়েছে রোগ উপশমের গুণাগুণ৷ কোনো কোনোটিকে তো বলা যায় রীতিমত দুর্লভ বৃক্ষ৷ ভেষজ চিকিৎসক গেরা বুকো একটি গাছ দেখিয়ে বলেন: ‘‘এটি একটি কাকারা গাছ৷ বহু রোগ ভাল করার গুণ রয়েছে এটির৷ এই গাছের উপাদান হৃদরোগের নিরাময়ে সাহায্য করে, কাজে লাগে চোখের অসুখে, সাহায্য করে মানুষকে চাঙা করতে৷ এর নির্যাস দিয়ে আমি তো বারো ধরনের রোগ ভাল করতে পেরেছি৷”
সুপ্রাচীন কাল থেকে চলে আসা ধারণা ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে ১২ জন আয়ুর্বেদীয় বা ভেষজ চিকিৎসক এই সব রোগ নিরাময়কারী উদ্ভিদের চাষাবাদ করছেন৷ এক্ষেত্রে আধুনিক কৃষিবিদ্যা বা রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয়না তাঁদের৷ এই বাগানে শুধু এই সব চিকিৎসকেরই প্রবেশাধিকার আছে৷ গাছের শেকড়, ছালবাকল, ও লতাপাতা সংগ্রহ করে বিশেষ পদ্ধতিতে তারা নানা রকম ওষুধ প্রস্তুত করেন৷ যে পদ্ধতিটা শুধুমাত্র তাদেরই জানা আছে৷ পিয়ের টোগননের বাবাও ছিলেন একজন ভেষজ চিকিৎসক৷
স্মৃতিচারণ করে বলেন পিয়ের বলেন, ‘‘তিনি আমাকে একটি গাছ দেখিয়ে বলেছিলেন, এই গাছের ৩৬ ধরনের অসুখ ভাল করার ক্ষমতা আছে৷ এই গাছের ছালে এক ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের মত গুণাগুণ আছে, যা সেদ্ধ করে ৫০ লক্ষ জীবাণু ধ্বংসকারী ওষুধ তৈরি করা সম্ভব৷ এর নির্যাস ম্যালেরিয়া ও যকৃতের অসুখে ওষুধ হিসাবে কাজ করে৷” এত গুণাগুণ সত্ত্বেও অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা ক্ষেত্রে কিছুটা সন্দেহের চোখে দেখা হয় ভেষজ চিকিৎসাকে৷ বেনিনের আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসক সমিতির প্রধান আডাম আফো এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘আমাদের উৎপাদন সামগ্রীতে সরকারি স্ট্যাম্পের প্রয়োজন হয়৷ অনেক রকম পরীক্ষা নিরীক্ষার বেড়াজাল পার হতে হয়৷ সরকারি অনুমোদন ছাড়া কোনো কিছুই সম্ভব নয়৷ এই অনুমোদনের জন্য অনেক দিন ধরে লড়াই করতে হচ্ছে আমাদের৷”
বেনিনবাসীদের অনেকেই ঐতিহ্যবাহী ভেষজ চিকিৎসাকে সাদর গ্রহণ করেছেন৷ আশেপাশের এলাকা থেকেও রোগমুক্তির জন্য অনেকে আসছেন টোকোরোর আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসকদের কাছে৷ ১০ কিলোমিটার দূরের এক গ্রাম থেকে এসেছেন মায়মোনা ফোগি৷ তখন তাঁর শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল৷ তিনি জানান,‘‘আমার সর্বাঙ্গ ব্যথা করছিল, পেট, কিডনি, স্নায়ু সবকিছুই৷ এ ছাড়া খুব ক্লান্ত লাগতো আমার৷ নানা হাসপাতাল ঘুরেও কোনো কাজ হয়নি৷ রেডিওতে এই ভেষজ ডাক্তারদের খবর জানতে পেরে ছয় সপ্তাহ আগে টোকোরোতে এসেছি আমি৷ এখন আমি সন্তুষ্ট৷ আমি আবার চলতে পারি, পানি তুলতে পারি৷ ১৫ বছরে ধরে কষ্ট ভোগ করেছি৷ সে জন্য টোকোরোতে আসতে পেরে আমি খুশি৷ এই ধরনের সমস্যা হলে সবাইকে সেখানে যেতে বলব৷”