বিশ্বে এইচআইভি প্রথম শনাক্ত হয় ১৯৮১ সালে। আমাদের দেশে সংক্রমণ ধরা পড়ে ১৯৮৯ সালে। অথচ সংক্রমণের পর গত ২২ বছরেও এইচআইভি/এইডস নিয়ন্ত্রণে সরকারের গৃহীত কর্মসূচির সুফল সেভাবে পাওয়া যায়নি। সরকারি অর্থায়নে দেশের বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) এইডস শনাক্তকরণ ও এর চিকিৎসা প্রদানে নিয়োজিত। কিন্তু তাদের কার্যক্রমে সন্দেহ প্রকাশ করছেন খোদ বিশেষজ্ঞরা।
২০০৭ সালে পরিচালিত জরিপে জাতীয় এইডস/এসটিডি প্রোগ্রামের তথ্যে দেশে এইচআইভি সংক্রমণের হার এক শতাংশের নিচে দাবি করা হয়। তবে এইচআইভি প্রতিরোধে সরকারের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর প্রতি সরকারের অবহেলায় বিশেষজ্ঞরা এইডস সংক্রমণের ভয়াবহতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশের এইচআইভি সংক্রমিত লোকের সংখ্যা ১২ হাজার। জাতীয় এইডস/এসটিডি প্রোগ্রাম-২০০৯ এর তথ্যে জানা যায়, দেশে সংক্রমিতের সংখ্যা ১ হাজার ৭৪৫ জন। নতুন রোগীর সংখ্যা ১৪৩ জন, ২০০৯ সালে এইডসে মৃত্যু হয়েছে ৩৯ জনের, একই বছর নতুন করে আক্রান্ত হয়েছে ২৫০ জন এবং এদের মধ্যে ২০৪ জন মারা গেছেন। সরকারের ভাষ্যমতে, দেশে এইচআইভির প্রাদুর্ভাব সীমিত পর্যায়ে আছে। এ সংখ্যা ১ শতাংশের নিচে। সেভ দ্যা চিলড্রেন ইউএসএ-এর তথ্যমতে, ঢাকা শহরে সুঁইয়ের মাধ্যমে মাদক ব্যবহারকারীদের মধ্যে এইচআইভির ঘনীভূত মহামারী (৭%) চলছে। তবে ২০০৬ ও ২০০৯ এর জরিপে ওই হার একই মাত্রায় রয়েছে। দেশব্যাপী এইচআইভি/এইডস নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম দেখার জন্য এনজিও ও বিভিন্ন দাতা সংস্থার কাজ পর্যবেক্ষণ করে জাতীয় এইডস বা এসটিডি কর্মসূচি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং অধিদফতরের নিয়ন্ত্রণাধীন এ প্রোগ্রামে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে রক্ত এনে পরীক্ষার জন্য যে নিয়ম রয়েছে তা অনুসরণ করা হচ্ছে না। রক্ত পরীক্ষায় যারা নিয়োজিত তারা যথাযথ পর্যবেক্ষণ না করে ঢাকায় বসে রিপোর্ট তৈরি করে দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। জানা যায়, দেশে বর্তমানে স্বেচ্ছায় রক্ত পরীক্ষা কেন্দ্র আছে মাত্র ৯০টি। দেশের এসটিডি প্রোগ্রাম পরিচালিত হচ্ছে হাতেগোনা জনবল নিয়ে। অন্যদিকে দেশের ১ লাখ ৪৩ হাজার পুরুষ যৌনকর্মীর ব্যাপারে রয়েছে সরকারের চরম অবহেলা। কিছু এনজিও শুধু ফান্ডের টাকার জন্য এ এইচআইভি বিষয়ে দক্ষতা না থাকার পরও ভিসিটিসহ অন্যান্য কাজে জড়িত। দেশে এইচআইভি কার্যক্রমের সর্বমোট অর্থায়নের অর্ধেকই গ্লোবাল ফান্ড থেকে আসে। জেনেভাভিত্তিক গ্লোবাল ফান্ডের অর্থায়নে এ কর্মসূচি ২০১২ সাল পর্যন্ত পরিচালিত হবে। ইউএনএইডসের তথ্যে, ২০০০-১০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সংস্থার অর্থায়নে বাংলাদেশ সরকারকে মোট ১২৭.২৩৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থসাহায্য দেওয়া হয়েছে। এসটিডি প্রোগ্রামের সঙ্গে যুক্ত কিছু এনজিওকর্মীর ভাষ্যমতে, সরকার দেশের এইডসের ঝুঁকির মাত্রা নিরূপণ করতে পারছে না। দেশে পর্যাপ্তসংখ্যক রক্ত পরীক্ষা কেন্দ্র নেই। এআরভি ওষুধের বাজারমূল্য বেশি হওয়ার কারণে অনেকেই ওই ওষুধ পাচ্ছে না।
এইচআইভি নিরাময়ে কোনো ভ্যাকসিন বা টিকা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তবে এইচআইভি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এমন কিছু ওষুধ আছে, যা অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল (এআরভি) ড্রাগস নামে পরিচিত। এর ব্যবহারে একজন এইচআইভি সংক্রমিত মানুষের আয়ু কিছুদিনের জন্য বাড়ানো যায়। সরকারের জাতীয় এইডস/এসটিডি কর্মসূচির তথ্যমতে, দেশের ৪৫২ জন এইডস রোগীকে নিয়মিত এআরভি ওষুধ দিচ্ছে তিনটি প্রতিষ্ঠান।
জাতীয় এসটিডি প্রোগ্রামের ডেপুটি ম্যানেজার ড. হাসান মাহমুদ বলেন, দেশে এইচআইভি আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৭৪৫ জন। যার মধ্যে এইচআইভি পজেটিভ ৬১৯ জন। আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২০৪ জন। সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী দেশে এইচআইভি সংক্রমণের হার ১ শতাংশের নিচে। তবে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। অনেকে আগে রোগের তথ্য প্রকাশ করেনি, তারা এখন স্বীকার করছেন। তবে ওই সংখ্যা নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই। ড. হাসান আরও জানান, তিনি এসটিডি প্রোগ্রামের শতভাগ সফলতা দাবি করছেন না। তবে তিনি আশা করেন, এনজিও ও সরকারের যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশ এইডস প্রতিরোধে নির্দিষ্ট সময়ে সফল হবে। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজের সাবেক উপাচার্য ও বিশিষ্ট ভাইরাস বিশেষজ্ঞ মো. নজরুল ইসলাম বলেন, গত তিন বছর দেশে এইডস সংক্রমণের ওপর কোনো জরিপ হয়নি। এখন পর্যন্ত সরকারি উদ্যোগে এইডস চিকিৎসায় কোনো হাসপাতাল গড়া হয়নি। সরকারের এটি ব্যর্থতা। হাসপতালের ডাক্তার-নার্সরা সংক্রমণের ভয়ে রোগীর চিকিৎসাও করতে চান না। ধর্মীয় সংবেদনশীলতার কারণে সমাজে এ বিষয়ে কার্যক্রম পরিচালনা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সরকার সচেতনতা তৈরিতে প্রচার চালিয়েছে ‘বাঁচতে হলে জানতে হবে’। অথচ ওই প্রচারে অর্থপূর্ণ কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। এসটিডি প্রোগ্রামের কর্মচারীরা বেশিরভাগই গোলটেবিল আলোচনায় ব্যস্ত থাকেন। অথচ মাঠপর্যায়ে কাজ ছাড়া দেশের এইচআইভি পরিস্থিতি সঠিকভাবে জানা যাবে না। দেশের সরকারি মেডিকেল সেন্টারগুলোতে একটি করে এসটিডি ডিপার্টমেন্ট রয়েছে কিন্তু সরকারের এইডস কর্মসূচির সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।