পাঁচ জেলার গ্রামীণ চিকিৎসা সেবার চিত্র
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ডাক্তারদের কর্মস্থলে উপস্থিত থাকতে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন। সরকারের কড়া নির্দেশ সত্ত্বেও উপজেলা পর্যায়ে নিয়োজিত ডাক্তারদের ৮০ ভাগ কর্মস্থলে থাকেন না। এরা কর্মস্থলে যোগদান করে শহরে চলে আসেন। দায়িত্ব পালন ভাগাভাগি করে কর্মস্থলে ডাক্তারগণ উপস্থিত থাকেন। সম্প্রতি সাড়ে তিন হাজার ডাক্তারকে এডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্স ও সাব সেন্টারে পাঠানো হয়।
এক্স-রে মেশিন বিকল, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ মেডিক্যাল অফিসারদের পদ বছরের পর বছর শূন্য, পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা নগণ্য, হাসপাতালে বসে প্রাইভেট ব্যবস্থাপত্র দেয়াসহ অন্যান্য অনিয়ম ও চরম অব্যবস্থার মধ্য দিয়ে চলছে গ্রামাঞ্চলের চিকিৎসা সেবা।
সরকারের নীতি নির্ধারক মহল যে নির্দেশনা দেন তা মন্ত্রণালয় কিংবা স্বাস্থ্য অধিদফতর পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। এই নির্দেশনা জেলা সিভিল সার্জন পর্যন্ত গেলে আলোর মুখ দেখে না। এই নির্দেশনার চেয়ে গ্রামাঞ্চলে চিকিৎসা সেবার নামে দাদন ব্যবসার মূল্যায়ন অনেক বেশী। বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশন (বিএমএ) ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) নেতা-কমর্ী কিংবা এমপি, মন্ত্রীর আত্মীয়-স্বজন ও আপনজন বলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে কিংবা ইউনিয়ন পর্যায়ে সাব সেন্টারে ডাক্তাররা যোগদান করে শহরে চলে আসেন। মাসের পর মাস ঐ সব ডাক্তার আর কর্মস্থলে যান না। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার-পরিকল্পনা কর্মকর্তা দেখেও না দেখার ভান করেন। কর্মস্থলে অনুপস্থিত ডাক্তাররা শহরে কিংবা উপজেলা পর্যায়ে বেসরকারি ক্লিনিকে দিনরাত রোগী দেখে যাচ্ছেন। তাদের কাছ থেকে সিভিল সার্জন ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সের প্রধানগণ নিয়মিত মাসোহারা পেয়ে থাকেন। এ কারণে ঐ ডাক্তার কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকলেও কাগজপত্রে উপস্থিত দেখানো হয়। কোন কোন স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে গিয়ে এর সত্যতা পাওয়া যায়।
মোট কথা, গ্রামাঞ্চলের চিকিৎসা সেবা দাদন ব্যবসায় পরিণত হয়ে গেছে। এই ব্যবসায়ীদের কাছে চিকিৎসা সেবা জিম্মি হয়ে পড়ে। ৮০ ভাগ লোক গ্রামাঞ্চলে বসবাস করে। তাদের মধ্যে অশিক্ষিত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যাই বেশী। এরা চিকিৎসা সেবা নিয়ে কিযে দুর্ভোগ, হয়রানি, মানসিক নিপীড়নের শিকার সরেজমিনে গেলে তা দেখা যায়। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে ঘুষ ছাড়া কোন ফাইল নড়ে না। সেখানকার ঘুষখোররা “বড় বাবু” হিসেবে পরিচিত। এই বড় বাবুদের হাতে প্রশাসনও জিম্মি। স্বাস্থ্য মন্ত্রী ডাঃ আফম রুহুল হক বলেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে কর্মস্থলে অনুপস্থিত চিকিৎসক ও নার্সদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। পাশাপাশি সিভিল সার্জন ও উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার-পরিকল্পনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সের সরকারি বাসভবনে ডাক্তারগণ থাকেন না। অনেকে বাসস্থানের সমস্যার কথা বলে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন। অপরদিকে সরকারি বাসায় থাকলে হাউজ রেন্ট ও বেতন থেকে সাত ভাগ কর্তন করায় বেতনের সিংহভাগ থাকে না। কর্তনকৃত টাকার তিন ভাগের এক ভাগ দিয়ে বাইরে ভালভাবে ভাড়া বাসায় থাকা যায়। এই বিষয়টি সরকারকে বিবেচনায় আনা উচিত বলে কয়েক কর্মকর্তা জানান।
গত ২২ নভেম্বর থেকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত নীলফামারী জেলার ডোমার, ডিমলা, সৈয়দপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে, রংপুর জেলার কাউনিয়া, পীরগাছা, বদরগঞ্জ, তারাগঞ্জ ও গঙ্গাচড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্স, পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ ও আটোয়ারি উপজেলা হেলথ কমপেস্নক্স, লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম ও কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্স এবং কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে সরেজমিনে গিয়ে ডাক্তার ও নার্সদের কর্মস্থলে অনুপস্থিত দেখা যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ওয়ার্ডবয় ও আয়ারা চিকিৎসা সেবার দায়িত্ব পালন এবং একশ্রেণীর ডাক্তার হাসপাতালে বসে প্রাইভেট প্র্যাকটিসসহ নানা অব্যবস্থাপনার চিত্র দেখা যায়। আগত রোগীরা চিকিৎসাসেবা নিতে এসে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডাক্তারের দেখা পাননি এবং টাকা দিলে ডাক্তারের দেখা মেলেসহ নিদারুণ দুর্ভোগের কথা জানান। এসব স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে গাইনি, মেডিসিন, সার্জারি ও এনেসথেসিয়া বিষয়ের জুনিয়র কনসালটেন্ট পদ থাকলেও কোনদিন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে এসব পদে নিয়োগ দেয়া হয়নি। ডাক্তার, নার্স ও কর্মচারীসহ অর্ধেক পদ শূন্য। এক্সরে মেশিন বিকল, প্যাথলজী পরীক্ষা-নিরীক্ষা নামেমাত্র, অপারেশন থিয়েটার মাসের পর মাস তালাবদ্ধ থাকে। আগত রোগীদের ছোটখাটো চিকিৎসা কিংবা সিজারিয়ান করার জন্য দালালরা ক্লিনিকে নিয়ে যায়। সম্প্রতি সরকার এডহক ভিত্তিতে সাড়ে তিন হাজার ডাক্তার নিয়োগ দিয়েছেন। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্স ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সাব সেন্টারে তাদের নিয়োগ দেয়া হয়। কর্মস্থলে কমপক্ষে দুই থেকে তিন বছর থাকতে হবে। এর আগে কেউ কর্মস্থল থেকে শহরে বদলি হতে পারবেন না বলে নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু এরা কাজে যোগদান করে শহরে চলে আসেন। তাদের কেউ বিএমএ ও স্বাচিপের নেতা-কমর্ী কিংবা নেতাদের ও এমপি-মন্ত্রীর আত্মীয়-স্বজন। এ কারণে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সের প্রধান ও সিভিল সার্জন তাদের বিরুদ্ধে কোন ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারেন না। এছাড়া কোন কোন ডাক্তার কর্মস্থলে যোগদান করে নানা অজুহাত দেখিয়ে একটি আবেদনপত্র জমা দিয়ে মাসের পর মাস অনুপস্থিত থাকেন। এক শ্রেণীর ডাক্তার মাসে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। ছয়জন কিংবা চারজন ডাক্তার থাকলে একজন অথবা দুইজন স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে এক সপ্তাহ থেকে দায়িত্ব পালন করেন। অন্যরা শহরে চলে যান।
হাসপাতালের অভ্যন্তরীণ অবস্থা নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর। সুস্থ মানুষ এই পরিবেশে কিছু সময় থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বে। কুকুর ও বিড়াল রোগীদের সঙ্গে থাকতে দেখা যায়। বাথরুমগুলো কালেভদ্রে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়। দুর্গন্ধে রোগীদের থাকা দুষ্কর। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সের প্রশাসনে এক শ্রেণীর উপ-প্রধান সহকারী ঘুষ বাণিজ্যের প্রধান হোতা। তাদেরকে উৎকোচ ব্যতীত কোন কর্মচারীর ফাইলও নড়ে না। উপ-প্রধান সহকারী ঘুষখোরদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ‘বড় বাবু’ হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন। তাদেরকে বড় বাবু হিসেবে রোগীরাও চিনেন। কর্মকর্তারা এইসব বিষয়ের সত্যতা স্বীকার করলেও নানা কারণে ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছেন। ব্যবস্থা গ্রহণ করলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সের প্রধানের উপর হামলাসহ নানা ধরনের হয়রানি নেমে আসে। এইসব কারণে কর্মকর্তারা ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন বলে জানান।
বিএমএ’র মহাসচিব অধ্যাপক ডাঃ শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, উপজেলায় নিয়োজিত ডাক্তার কর্মস্থলে উপস্থিত থাকার ব্যাপারে সরকারের কড়া নির্দেশনা রয়েছে। জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা এ সরকারের অঙ্গীকার। কর্মস্থলে অনুপস্থিত ডাক্তারদের বিরুদ্ধে প্রশাসন যে কোন ব্যবস্থা নিলে বিএমএ সহযোগিতা করবে। ঐসব ডাক্তারের সঙ্গে বিএমএ কোন ধরনের আপোষ করবে না বলে তিনি জানান। স্বাচিপের মহাসচিব অধ্যাপক ডাঃ ইকবাল আর্সলান বলেন, বিএমএ ও স্বাচিপের কিংবা এমপি ও মন্ত্রীর নাম ভাঙ্গিয়ে কর্মস্থলে অনুপস্থিত ডাক্তারদের ব্যাপারে স্বাচিপের কোন আপোষ নেই। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান তিনি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ খন্দকার সিফায়েত উলস্নাহ বলেন, কর্মস্থলে অনুপস্থিত ডাক্তারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এই বিষয়ে কোন ধরনের ছাড় দেয়া হবে না বলে তিনি জানান।