শিশুরাও নীরব ঘাতক রোগ ডায়াবেটিসের শিকার হচ্ছে। বয়স্কদের মতো এ রোগে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা দেশে ক্রমেই বাড়ছে। ঢাকার বারডেম হাসপাতালের অধীনে এখন ২ হাজার ৬০০ শিশু রোগী চিকিত্সা নিচ্ছে। গত ছয় থেকে সাত মাসের মধ্যে এ হাসপাতালে শিশু রোগীর সংখ্যা প্রায় দুইগুণ বেড়েছে। যাদের মধ্যে বেশিরভাগেরই বয়স ১০ থেকে ১২ বছরের কম। কিডনি অকেজো, অন্ধ হওয়া ও মস্তিষ্কে সমস্যাসহ নানা রোগের ঝুঁকি নিয়ে এসব শিশুকে বাঁচতে হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী প্রজন্মকে ধ্বংস করতে ডায়াবেটিস আশঙ্কাজনকভাবে এগিয়ে আসছে। এ রোগে আক্রান্ত শিশুরা বয়সের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বেড়ে উঠছে না। নগরায়ন, জনসংখ্যা বাড়তে থাকা, ফাস্টফুডসহ অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, নিয়মিত হাঁটাচলা ও ব্যয়াম না করা আর বাড়তি মানসিক চাপে শিশুরা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে।
প্রখ্যাত শিশু রোগবিশেষজ্ঞ, ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মনজুর হোসেন এ রোগের বিস্তার প্রসঙ্গে বলেন, ‘শিশুরা বংশগত কারণেও এর শিকার হচ্ছে। কোনো দম্পতির প্রথম সন্তান জেনেটিক কারণে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলেও পরের সন্তানটির এ রোগ নাও হতে পারে। মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায় শিশুরা যেন এ রোগে আক্রান্ত না হয়, এ ধরনের চিকিত্সার ব্যবস্থা নেই। তাই বংশগত কারণে এতে আক্রান্ত হওয়া রোধ করা যাচ্ছে না। তবে উন্নত বিশ্বের চিকিত্সা বিজ্ঞানে এ নিয়ে গবেষণা চলছে। শরীরে ইনসুলিনের (এক প্রকার হরমোন) অভাবে অনেক শিশুর ডায়াবেটিস জটিলতা দেখা দিচ্ছে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নবজাতক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক, শিশু রোগবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. খালেদ নূর আমার দেশকে বলেন, ‘অনেক বাবা-মা শিশুকে নানা ধরনের খাবার খাওয়াচ্ছেন। খাবারের তুলনায় শিশুরা ব্যয়াম করছে না। এসব শিশুর ডায়াবেটিস হচ্ছে। প্রিমেচিউরড শিশুরাও রোগটিতে আক্রান্ত হচ্ছে।’ পেটে প্রচণ্ড ব্যথা, খিঁচুনি হওয়া ও অজ্ঞান অবস্থায় বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে অনেক শিশুকে চিকিত্সার জন্য আনা হয় বলে জানান ডা. খালেদ। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তাদের মধ্যে অনেকের ডায়াবেটিস ধরা পড়ছে।
মানসিক রোগবিশেষজ্ঞ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম রাব্বানী বলেন, ‘অতিরিক্ত মানসিক চাপের ফলে অনেক সময় শিশুদের শরীরে হরমোন ঠিকমতো কাজ করে না। বাবা-মায়ের ডায়াবেটিস থাকলে তখন শিশুদেরও তাতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।’
জানা যায়, ছয় থেকে সাত মাস আগে বারডেম হাসপাতালে ডায়াবেটিস আক্রান্ত এক হাজার চারশ’ শিশু চিকিত্সা নেয়। এখন চিকিত্সা নিচ্ছে দুই হাজার ছয়শ’ শিশু। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই শহরের। ঢাকা শিশু হাসপাতালের শিশু এনডোক্রাইন ইউনিটের সহকারী অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান জানান, ওই হাসপাতালে প্রতি মাসে গড়ে তিন থেকে চার শিশু ডায়াবেটিস রোগী আসে। তাদের জরুরি চিকিত্সা দেয়ার পর বারডেম হাসপাতালে রেফার করা হয়। এ রোগে চিকিত্সায় দীর্ঘ সময়ের দরকার হয় বলে রোগীকে রেফার করা হয়। ঢাকা মেডিকেল শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মিটফোর্ড, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল, স্কয়ার, এ্যাপোলোসহ সরকারি-বেসরকারি অন্য হাসপাতালেও এ ধরনের রোগী আসে। দীর্ঘমেয়াদের চিকিত্সা হওয়ায় সেসব হাসপাতাল থেকেও বারডেমে রেফার করা হচ্ছে শিশুদের। বিশেষজ্ঞরা এ রোগকে বলছেন, ‘টাইপ-২ ডায়াবেটিস। এর বৈজ্ঞানিক নাম নন-ইনসুলিন ডিপেনডেন্ট ডায়াবেটিস মিলিটাস।’ অতিরিক্ত মেদ জমা, ওজন ও রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার ফলে শিশুদের শরীরে ইনসুলিন হরমোন কাজ করে না। তাতে তারা এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বলেও বিশেষজ্ঞদের মত। দেশে ডায়াবেটিস আক্রান্ত শিশুর সঠিক পরিসংখ্যান নেই। এর বিস্তারের কারণ সম্পর্কেও গবেষণা নেই। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানেও এ ধরনের কোনো প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের (আইডিএফ) হিসাব মতে, বিশ্বে প্রতি ১০ সেকেন্ডে দু’জন করে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন। প্রতি সেকেন্ডে একজন আর প্রতি মিনিটে ছয়জন মারা যান এ রোগে। ওই হিসাবে সব বয়সের রোগীদের কথা বলা হয়েছে। শিশুদের কথা আলাদা করে উল্লেখ নেই তাতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ভারতের ডায়াবেটিস গবেষণা কেন্দ্রের প্রকাশিত যৌথ প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে পৃথিবীতে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ৩০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। এর মধ্যে শিশু রোগীর সংখ্যাও হবে অনেক। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত ২০০০ সালে দেশে ডায়াবেটিস রোগী ছিল ৩২ লাখ। গত দশ বছরে তা ৬০ লাখেরও বেশি ছাড়িয়ে গেছে। এ হারে বাড়তে থাকলে ২০২৫ সালের মধ্যে রোগীর সংখ্যা কয়েক কোটিতে দাঁড়াবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। ডায়াবেটিস প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ডা. মনজুর হোসেন বলেন, ‘শিশুসহ সব বয়সের মানুষের এ রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখার উপায় চারটি। এগুলো হচ্ছে—ওষুধ সেবন, খাবার নিয়ন্ত্রণ, নিয়মিত ব্যয়াম, খেলাধুলা ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা। এটাও সত্য, শিশুদের খাবার নিয়ন্ত্রণ করানো কঠিন। তবে তাদের শর্করা জাতীয় খাবার একেবারেই কম পরিমাণে খেতে দিতে হবে। তার মতে, ‘শিশুদের শারীরিক পরিশ্রম, মানসিক পরিশ্রমের চেয়ে বেশি হওয়া দরকার। তাদের খাদ্য তালিকা থেকে চিপস, বার্গার, পানীয়ের মতো জাংক ফুডও বাদ দিতে হবে।’