হৃদরোগ প্রতিরোধ করা যায়, এমনকি প্রতিকারও আছে এর। দশকের পর দশক ধরে চিকিত্সাবিজ্ঞানীরা অস্বীকার করে আসছিলেন যে, হৃদরোগ প্রতিকারযোগ্য। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে, বিকল্প পদ্ধতিতে জীবনধারা ইতিবাচকভাবে বদলে দিতে পারলে সেটা হৃদরোগের ঊর্ধ্বগতি থামিয়ে দেয়। একই সঙ্গে রুদ্ধ ধমনীগুলোও (ব্লকেজ) খুলে যায়।
তাছাড়া হৃদরোগের প্রকৃত কারণ নির্ণয় সম্ভব হলে হৃদরোগ থেকে মুক্তি মেলে। এজন্য আবিষ্কার হয়েছে প্রচলিত বাইপাস সার্জারির বিকল্প চিকিত্সা পদ্ধতি। এরকম একটি চিকিত্সা পদ্ধতির নাম চিলেশন থেরাপি। এই চিকিত্সার পাশাপাশি যোগব্যায়াম এবং শাকসবজি খেয়ে হৃদরোগকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে।
করোনারি আর্টারি ডিজিজ
করোনারি আর্টারি ডিজিজ বা হৃদরোগ এখন বিশ্বব্যাপী আলোচিত ব্যাধি। সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও হৃদরোগে আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক মানুষ এ রোগে মারা যাচ্ছেন। পরিসংখ্যানটি রীতিমত আতঙ্কজনক। হৃদরোগের প্রচলিত চিকিত্সা পদ্ধতিগুলো অত্যন্ত ব্যয়বহুল; তাছাড়া এগুলো কোনো দীর্ঘস্থায়ী সুফলও বয়ে আনে না। তবে আনন্দের সংবাদ হলো, হৃদরোগ প্রতিরোধে চিলেশন থেরাপি প্রয়োগ করলে কোনোরকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই রোগীরা ভালো থাকছেন এবং এতে হার্টের ব্লকেজ সমস্যার সমাধান হয়ে যাচ্ছে।
হৃদরোগের কারণসমূহ
হৃদরোগের নানা কারণ রয়েছে। তবে নিম্নোক্ত কারণে সাধারণত হৃদরোগে মানুষ আক্রান্ত হয়।
— বংশানুক্রমিক ধারা (অর্থাত্ পিতা-মাতার হৃদরোগ থাকলে)
— উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস
— উচ্চ মাত্রার কোলেস্টেরল
— ধূমপান ইত্যাদি।
এছাড়াও ব্যক্তির জীবনযাপন এবং মানসিক অবস্থাও সমভাবে গুরুত্ব বহন করে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপারে। পাশাপাশি প্রতিকূল পরিস্থিতি, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব এবং পরিবার ও কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপ যুবা বয়সে হার্ট অ্যাটাকের প্রধান কারণ।
হৃদরোগে প্রচলিত চিকিত্সা
হৃদরোগ চিকিত্সায় বর্তমানে যে পদ্ধতিটি বহুল ব্যবহৃত সেটি হলো হৃদযন্ত্রের ধমনীকে প্রসারিত করে তার ভেতরে রক্ত সঞ্চালন করা এবং হৃদযন্ত্রের পেশিতে অক্সিজেনবাহিত রক্তের প্রয়োজন হ্রাস করা। সার্জিক্যাল চিকিত্সায় সংকীর্ণ ধমনীতে রক্ত সঞ্চালনের বিকল্প পথ তৈরি যাকে বলে বাইপাস সার্জারি কিংবা বেলুন প্রবেশের মাধ্যমে সেই পথ প্রসারিত করা হয়। এসবই রোগীকে সাময়িক উপশম দেয় বটে কিন্তু এর কোনোটিই হৃদরোগের মূল সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।
তাই প্রয়োজন বিকল্প চিকিত্সা
এটা প্রমাণিত যে, হৃদরোগে বিকল্প চিকিত্সা পদ্ধতি গ্রহণ করলে হৃদরোগীরা ভালো হতে শুরু করে এবং জীবনধারায় পরিবর্তন এনে রোগের মাত্রা থামিয়ে দেয়া যায়। এসব পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে :
— মেদযুক্ত খাদ্য পরিহার করে স্বল্প মেদযুক্ত এবং নিরামিষ আহার গ্রহণ।
— ধূমপান বর্জন।
— মনোদৈহিক চাপ ব্যবস্থাপনা।
— নিয়মিত ব্যায়াম করা এবং মনোসামাজিক সহায়তা দান।
বাইপাস সার্জারি বা এনজিওপ্লাস্টিতেও ঝুঁকি
অনেকেই জানেন না যে, বিরাট খরচ করে ও ঝুঁকি নিয়ে বাইপাস সার্জারি কিংবা এনজিওপ্লাস্টি করা হলেও ৫ বছরের মধ্যে হৃদযন্ত্রের ওইসব ধমনীর শতকরা ৫০ ভাগ পর্যন্ত ব্লকড হয়ে যেতে পারে। এছাড়া এনজিওপ্লাস্টি করা ধমনী ৩০ থেকে ৫০ ভাগ পর্যন্ত আবারও রুদ্ধ হয়ে যায় চার থেকে ছয় মাসের মধ্যে। সেক্ষেত্রে পুনরায় বাইপাস সার্জারি ও এনজিওপ্লাস্টি করা জরুরি হয়ে ওঠে। তাই হৃদরোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারে স্বল্পব্যয়ের এই বিকল্প চিকিত্সাগুলো ভালো ভূমিকা রাখছে।
এই বিকল্প চিকিত্সা পদ্ধতিতে যেসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত তা হলো :
— ডায়েট কাউন্সেলিং বা পরামর্শ অনুযায়ী খাবার গ্রহণ।
— নিয়মিত ব্যায়াম, যেমন প্রতিদিন ৩০-৪০ মিনিট হাঁটা, প্রাণায়াম, যোগ ব্যায়াম প্রভৃতি।
— গভীর প্রশান্তির জন্য চাপ গ্রহণ ও চাপমুক্তির ব্যায়াম।
— মেডিটেশন এবং দৃশ্যমান ইমেজারি।
— অনুভূতি ভাগাভাগির ওপর জোর দিয়ে গ্রুপ আলোচনা।
কখন শুরু করবেন?
জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় যৌবনেই এই সঠিক জীবনধারা গ্রহণ করা সমীচীন। পুরুষের ৩৫ এবং নারীর ৪০ বছর হলেই প্রতি বছর কার্ডিয়াক বা হৃদযন্ত্রের চেকআপ জরুরি। একইসঙ্গে হৃদরোগ প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণও আবশ্যক।
বায়োকেমিক্যাল এনজিওপ্লাস্টি বা
চিলেশন থেরাপি
কোনো কেমিক্যাল ফ্যাক্টরিতে গেলে দেখা যাবে—পাইপের ভেতর দিয়ে কেমিক্যাল যাওয়ার ফলে ওই পাইপের দেয়ালে পুরু পর্দা জমে এবং এক পর্যায়ে পাইপটি রুদ্ধ হয়ে যায়। এর প্রতিকার হিসেবে একই পাইপ দিয়ে ভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল প্রবেশ করালে ওই পর্দাটি দূর হয়ে যায়। বিষয়টি অনেকটা এরকম যে, বাড়ির গৃহিণী রান্নাঘরের পাইপে জমে থাকা পুরু ময়লা অপসারণের জন্য পরিষ্কারক পদার্থ প্রবেশ করান পাইপে। এ থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, বাইরের কোনো পদার্থ কোথাও জমলে সেটা সরানো যায় ভিন্ন কোনো পদার্থের সাহায্য নিয়েই। একইভাবে হৃদযন্ত্রের ধমনীর ব্লক অপসারণ সম্ভব বায়োকেমিক্যাল মিশ্রণের মাধ্যমে। তবে সেটা হতে হবে মানবদেহের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং পরিমিত মাত্রায়। এই কেমিক্যাল মিশ্রণে থাকে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট, ইডিটিএ, ভিটামিন, আইসোটনিক, পিএইচ ভারসাম্যপূর্ণ ওষুধ। এই কেমিক্যাল মিশ্রণটি শিরার মাধ্যমে রোগীর দেহে প্রবেশ করানো হয় আড়াই ঘণ্টা সময় নিয়ে। অনেকটা স্যালাইন দেয়ার মতোই বিষয়টি। এটাই হলো চিলেশন থেরাপি।
রোগীর বয়স ও শরীরের অবস্থা অনুযায়ী এই মিশ্রণ প্রয়োগের মাত্রার রকমফের ঘটে। একজন অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিত্সকই কেবল এই মাত্রার বা ডোজের বিষয়টি সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে পারেন। এই বায়োকেমিক্যাল এনজিওপ্লাস্টি অনেক বেশি কার্যকর হয়ে থাকে যদি রোগীর জীবনধারায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনা হয়।
ডা. গোবিন্দ চন্দ্র দাস
সিনিয়র কনসালটেম্লট
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
চেম্বার: হলিস্টিক হেলথ কেয়ার সেন্টার
৫৭/১৫ পশ্চিম পান্থপথ, ঢাকা।