দেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভুগলেও কোনো ধরনের চিকিৎসা নেন না। দেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ গ্যাস্ট্রিক, রক্তচাপ, বাতজ্বর, হাঁপানি ও ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভুগলেও তাদের মধ্যে ৮০ ভাগের বেশি রোগী কোনো ধরনের চিকিৎসা নেন না। এসব রোগ সম্পর্কে অজ্ঞতা এর একটি বড় কারণ। তবে চিকিৎসা ব্যয় বেশি হওয়ায়ও অনেকে রোগ বয়ে বেড়ান। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ খানা আয় ও ব্যয় জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রোগ যত কঠিনই হোক, এসব রোগীর ৮২ শতাংশই কোনো ধরনের চিকিৎসা নেন না। কারণ হিসেবে সমস্যাকে গুরুতর নয় মনে করেন ৮২ শতাংশ রোগী। আর প্রায় ১১ শতাংশ রোগী মনে করেন, চিকিৎসা ব্যয় অত্যন্ত বেশি। যারা চিকিৎসা নেন, তাদেরও প্রায় ৫৪ শতাংশ ফার্মেসি থেকে নিজের মতো ওষুধ কিনে থাকেন। চিকিৎসাসেবা গ্রহীতাদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৩ শতাংশ ডিগ্রিবিহীন চিকিৎসকের কাছে যান এবং ৯ শতাংশ যান বেসরকারি ক্লিনিকে।
চিকিৎসার এই হাল সম্পর্কে জানতে চাইলে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, তথ্য সঠিক। কারণ, সর্বত্র দুর্নীতি। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যয় কম, প্রায় বিনামূল্যে কিছু ওষুধও পাওয়া যায়। তবে সিরিয়াল দিতেই দিন পার হয়ে যায়। ওই দিন রুজি-রোজগার বন্ধ। আগে সিরিয়াল পেতে অসাধুদের টাকা দিতে হয়। আসা-যাওয়ার ব্যয় তো আছেই। সেসব হিসাব করলে শেষ পর্যন্ত চিকিৎসা ব্যয় দাঁড়ায় অনেক টাকা। অর্থাৎ, মূল চিকিৎসার চেয়ে চিকিৎসাবহির্ভূত ব্যয়ই বেশি।
চিকিৎসাসেবা পাওয়া মানুষের মৌলিক অধিকার হলেও বিবিএসের এ জরিপে দেখা যায়, দেশের সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে মানুষ মোট ওষুধের মাত্র ১.৬২ শতাংশ পেয়ে থাকে। অন্যদিকে, ফার্মেসি থেকে কিনতে হয় ৯৬.৪৬ শতাংশ ওষুধ।
জরিপে বলা হয়, দীর্ঘস্থায়ী বিভিন্ন রোগের মধ্যে গ্যাস্টিকের সমস্যায় ভুগে থাকেন দেশের বেশি মানুষ। এ রোগে ভুগছেন প্রায় ২১ শতাংশ মানুষ। পুরুষদের মধ্যে ২১.৩৮ শতাংশ এবং ২০.৩১ শতাংশ নারী গ্যাস্টিক-আলসারে ভুগছেন। আবার শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষ এ সমস্যায় বেশি ভুগে থাকেন। গ্রামে এ হার প্রায় ২২ শতাংশ, শহরে ১৯ শতাংশেরও কম।
দীর্ঘমেয়াদি রোগের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হচ্ছে রক্তচাপ। রক্তচাপে ভোগেন ১৩.২৩ শতাংশ মানুষ। তৃতীয় সর্বোচ্চ বাতজ্বরে ভুগে থাকেন ১২.১৬ শতাংশ। হাঁপানিতে ভুগে থাকেন ৮.৪৫ শতাংশ এবং ডায়াবেটিসে ভুগছেন ৮.২৪ শতাংশ মানুষ।
গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশ থেকে খানা আয়-ব্যয় জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ৭২০টি নমুনা এলাকায় দৈবচয়নের ভিত্তিতে ২০টি করে মোট ১৪ হাজার ৪০০ খানা থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন প্রশিক্ষিত কর্মীরা। জরিপের চূড়ান্ত প্রতিবেদন গত বুধবার প্রকাশ করা হয়।
এ বিষয়ে ডা. মুশতাক বলেন, মানুষের জীবনযাত্রায় নানা উদ্বেগ এবং অনিশ্চয়তায় মানসিক অস্থিরতা গ্যাস্ট্রিক রোগের প্রধান কারণ। এসব কারণেই দেহঘড়ির ছন্দপতন ঘটে। শারীরবৃত্তীয় শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়। এতে গ্যাস্ট্রিকের মতো রোগের সৃষ্টি হয়। আবার খাদ্যে ভেজাল, অতিরিক্ত ঝাল মসলা, বিশেষ করে শুকনো মরিচ গ্যাস্ট্রিক বাড়িয়ে তোলে। জীবনযাত্রায় যতটা সম্ভব শৃঙ্খলায় ফিরলে গ্যাস্ট্রিক কেন, প্রায় সব ধরনের রোগবালাই থেকেই মুক্তি মেলে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, পুরুষের প্রধান তিনটি দীর্ঘমেয়াদি রোগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২১.৩৮ শতাংশ গ্যাস্টিক ও আলসার, ১১.৪৬ শতাংশ উচ্চ-নিম্ন রক্তচাপ ও ১০.১৪ শতাংশ পুরুষ হাঁপানিতে ভুগছেন। অন্যদিকে, নারীদের ক্ষেত্রে দীর্ঘ মেয়াদের প্রধান তিনটি রোগের মধ্যে গ্যাস্ট্রিক ও আলসারে ২০.৩১ শতাংশ, রক্তচাপে ১৪.৬৯ শতাংশ এবং হাঁপানিতে ১৪.৩ শতাংশ নারী ভুগে থাকেন।
ডায়াবেটিস রোগে পুরুষের চেয়ে নারীরা বেশি ভুগে থাকেন। এ রোগটি গ্রামের চেয়ে দ্বিগুণ শহরে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, গ্রামে ডায়াবেটিস ৬.৩৪ শতাংশ যা শহরে ১২. ৭৫ শতাংশ। শহরে এ ধরনের রোগে ভোগে ১২ দশমিক ৭ শতাংশ পুরুষ এবং ১২ দশমিক ৭৯ শতাংশ নারী। গ্রামেও ডায়াবেটিস পুরুষের চেয়ে নারীদের মধ্যে বেশি লক্ষ্য করা গেছে। গ্রামে পুরুষের ৮ দশমিক ৩১ এবং ৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ নারী ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।
জনস্বাস্থ্যের গুরুত্ব বিবেচনায় সবার জন্য চিকিৎসা সহজলভ্য করতে কার্যকর কর্মসূচি নেওয়ার পরামর্শ দেন ডা. মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, জাতীয় উন্নয়নে জন্য যে কোনো মূল্যেই চিকিৎসা সুলভ এবং সহজলভ্য করতে হবে।