ফুসফুস আমাদের শরীরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রত্যঙ্গ। অথচ প্রতিদিনকার দূষণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের ফুসফুস। এ করোনাকালীন সময়ে ফুসফুসের যত্ন নিতে হবে বিশেষভাবে। কারণ কোভিট ১৯ পজিটিভ হলে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয় সবথেকে বেশি। আমাদের শরীরে শ্বাস-প্রশ্বাসে নিয়ন্ত্রণ রাখার একমাত্র অঙ্গ হচ্ছে ফুসফুস। ফুসফুসের সাহায্যে আমরা অক্সিজেন গ্রহণ করি এবং ক্ষতিকর কার্বন-ডাই-অক্সাইড শরীর থেকে বের করে দেই। তাই ফুসফুস যদি সুস্থ না থাকে তাহলে এক শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়া টির ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। ফলে আমরা সহজে অসুস্থ হয়ে পড়ি এমনকি মৃত্যুর ঝুঁকিও বেড়ে যেতে পারে। তাই ফুসফুসকে সুস্থ ও কর্মক্ষম রাখতে বিশেষ ভাবে প্রয়োজন রয়েছে।
ফুসফুসের বিশেষ ভাবে যত্ন নিতে হলে খাবারের প্রতি সঠিক খেয়াল রাখতে হবে। অর্থাৎ খাবার নির্বাচন এমনভাবে করতে হবে যাতে ফুসফুসের জন্য উপকারী খাদ্য উপাদান গুলো যেন পর্যাপ্ত পরিমাণে দৈনিক খাদ্য তালিকায় থাকে। যেমন বিভিন্ন ধরনের মাছ, তাজা শাক সবজি, আদা, রসুন, পেঁয়াজ, কাঁচা হলুদ, ভিটামিন সি যুক্ত মৌসুমী ফল ইত্যাদি পুষ্টিকর উপাদান গুলো গঠনমূলক কাজে সহায়তা করে।
পানি
ফুসফুসের যত্নের প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি পান করা। দিনে দুই থেকে তিন লিটার বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে প্রয়োজনবোধে এর বেশিও হতে পারে। পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পানে ফুসফুসের রক্ত সঞ্চালন সঠিক থাকে এবং শ্লেষ্মা পাতলা হয়। পরে ফুসফুস আগে থেকে বেশ সুস্থ থাকে।
তাজা সবুজ শাকসবজি
ফুসফুসকে সুস্থ ও কর্মক্ষম রাখতে সতেজ সবুজ শাক সবজির বিকল্প নেই। ফুসফুসের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে, প্রদাহ কমাতে ও নানান ধরনের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে সবুজ শাক সবজির ভূমিকা অপরিহার্য। সবুজ শাকসবজির ক্লোরোফিল ফুসফুসের রক্ত প্রবাহ সঠিকভাবে সচল রাখতে সাহায্য করে। সবুজ শাকসবজিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে কোষের ক্ষতি হওয়া থেকে রক্ষা করে। সবুজ রং এর ব্রোকলি তে সালফোরেন নামক উপাদান রয়েছে যা ফুসফুসের প্রদাহ জনিত সমস্যা থেকে রক্ষা করতে পারে।
ভিটামিন সি যুক্ত ফলঃ
ভিটামিন সি যুক্ত ফল যেমন মালটা, কমলা, আমলকি, পেয়ারা, আপেল, বাতাবি লেবু, লেবু,সফেদা, লটকন, কালোজাম, আনারস, জামরুল ইত্যাদি নানান ধরনের ফলে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন সি এর পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ফ্লাভোনয়েডস রয়েছে যার যার ফলে এই সব ফল গ্রহণে ফুসফুসের প্রদাহ জনিত যেকোনো সমস্যা রোধে ও শ্বাসনালী জীবাণু ধ্বংস সাহায্য করে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ হওয়ার কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ফলে এই করোনাকালীন সময়ে ফুসফুস সহজে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে না। তাই প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় অন্ততপক্ষে দুটি ভিটামিন সি যুক্ত ফল রাখা উচিত।
হলুদ
হলুদকে “মিরাকল হারব” বা “অলৌকিক ভেষজ” বলা হয়। কারন সেই প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন ধরনের ঘরোয়া চিকিৎসায় হলুদ ব্যবহার করা হয়ে আসছে। তাই হলুদ আমাদের কাছে অতি পরিচিত একটি ভেষজ। প্রতিদিনের রান্নায় যেমন ব্যবহার করা হয় হলুদের গুঁড়া তেমনি সৌন্দর্য রক্ষায় ব্যবহার করা হয় কাঁচা হলুদ হিসেবে সে আদি যুগ থেকেই। হলুদের কারকিউমিন ফুসফুসের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে হলুদে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট অ্যান্টিভাইরাস অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদানসমূহ রয়েছে। যেসব উপাদান ভেতর থেকে রোগ মুক্ত করে স্বাস্থ্য রক্ষায় সাহায্য করে। এ করোনাকালীন সময়ে ফুসফুসকে সুস্থ রাখতে হলে প্রতিদিন ১ গ্লাস কুসুম গরম পানিতে অন্তত ১ চা চামচ হলুদের রস ১ চা চামচ মধু খাওয়ার অভ্যাস টি গড়ে তুলতে পারেন, এতে করে ফুসফুস সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকবে।
আদা
আদাকুচি নিয়মিত খেলে ফুসফুস সুস্থ থাকে। ঠান্ডা ও কাশির ঘরোয়া সমাধান হচ্ছে আদার রস বা আদার চা। আদায় প্রদাহরোধী উপাদান থাকে যা শ্বাস থেকে বিষাক্ত উপাদান দূর করে শ্বাস যন্ত্র কে সুস্থ রাখে।আদায় রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন ও নানান ধরনের মিনারেল যেমন পটাসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম,বিটা ক্যারোটিন ও জিংক। যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে পরিমিত পরিমাণে আদা খেলে ফুসফুসের ক্যান্সারের কোষ দূর করতে সাহায্য করে। তাই এই করনা কালীন সময়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ঠান্ডা কাশি ও সংক্রমণ প্রতিহত করার জন্য আদার রস বিশেষ উপকারী। তাই ফুসফুসকে সুস্থ রাখতে হলে প্রতিদিন অন্তত দুই কাপ আদার চা, আদা লেবু চা বা আদা কুচি মধু দিয়ে খেতে পারেন। এতে করে ফুসফুসের প্রদাহ জনিত সমস্যা দূর হয়ে ফুসফুস সুস্থ ও কর্মক্ষম থাকবে।
রসুন
রসুনে রয়েছে অ্যালিসিন নামক শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক যা শ্বাস প্রশ্বাসের সংক্রমন কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করে এবং ফুসফুসের শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যা দূর করে। এছাড়া রসুন ফুসফুসের প্রদাহ কমায় এবং হাঁপানি ও ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। তাই ফুসফুসকে সুস্থ রাখতে হলে প্রতিদিন অন্তত এক কোয়া করে কাঁচা রসুন অথবা রসুনের আচার কিংবা তরকারিতে রসুনের পরিমাণটা বাড়িয়ে দিতে পারেন।
পেয়াজ
পেঁয়াজ ছাড়া বাঙালি রান্না অসম্ভব। সেই পিয়াজের ক্রয়মূল্য আকাশচুম্বী হলেও পেঁয়াজ ছাড়া বাঙালি মুখরোচক রান্না চলবেনা একদিনও। পেঁয়াজে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি ভাইরাস উপাদানসমূহ থাকার কারণে ফুসফুসের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে ফুসফুসকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। তাই প্রতিদিনের রান্নায় পরিমিতভাবে পেঁয়াজের ব্যবহার করা স্বাস্থ্যকর।
মধু
মুখেতে আমরা কে না ভালোবাসি। আর এই মধু যদি হয় পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ তাহলে পরিমিত ভাবে গ্রহণ করতে বাধা কোথায়?! মধুতে আছে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট, anti-microbial ও প্রদাহনাশক গুণাবলী। যা ফুসফুসকে পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। পরিষ্কার ফুসফুস দেহের দূষিত কার্বন-ডাই-অক্সাইড বের করে দিয়ে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ করে দেহকে সুস্থ ও কর্মক্ষম রাখতে সাহায্য করে। তাই এই করনা কালীন সময়ে ফুসফুসকে সুস্থ রাখতে চাইলে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে এক চা-চামচ মধু আদার রস কিংবা কাঁচা হলুদ রসের সাথে মিশিয়ে খাওয়ার অভ্যাস করতে পারি আমরা সকলেই। এতে করে ফুসফুস সুস্থ থাকবে এবং কোভিড ১৯ পজিটিভ হলেও সহজে ফুসফুস আক্রান্ত হয়ে যাবে না।
গ্রীন টি
শ্বাসযন্ত্র সুস্থ রাখতে গ্রীন টি বেশ কার্যকর। গ্রিন টি উপকারী এন্টিঅক্সিডেন্ট পলিফেনোলস সমৃদ্ধ হোওয়ায় এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এছাড়াও গ্রীন টি তে অবস্থিত প্রদাহনাশক উপাদান সমূহ ফুসফুসের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। শ্বাসযন্ত্রের নানা সমস্যার মধ্যে এন্টি ব্রংকাইটিস ও এম্ফোসিমা অন্যতম। এতে মারাত্নক ভাবে শ্বাস প্রশ্বাসের সমস্যা দেখা দিতে পারে, এমন কি ফুসফুস মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। ফুসফুসের এই ধরনের সমস্যা সমাধানে গ্রীন টি র ভুমিকা অন্যতম। তাই এই সময়ে দুধ চা যতই স্বাদ এর হোক না কেন দুধ চা এর পরিবর্তে গ্রীন টি খাওয়ার সু অভ্যাস টি গড়ে তুলুন।
প্রোটিন
ভিটামিন ডি এর উৎকৃষ্ট উৎস হচ্ছে First class প্রোটিন। ডিম, দুধ, দই, মাছ বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ, ডাল, বাদাম, মাংস ইত্যাদি খাবার গুলো হচ্ছে First class protien. এই জাতীয় খাবার পরিমিতভাবে খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি শ্বাসযন্ত্রের পেশী বা ফুসফুসের পেশীর কার্যকারিতা ও সুস্থতা বজায় থাকবে খুউব সহজেই।তাই প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় অন্ততপক্ষে একটি করে ডিম, এক কাপ দুধ অথবা টক দই, এক টুকরো মাছ, ৬০ গ্রাম বাদাম বা ডাল খাদ্যতালিকায় রাখতে হবে। তবে শারীরিক অবস্থা ও বয়স ভেদে কম বেশি হতে পারে।
স্বাস্থ্যকর ফ্যাট
সব ফ্যাটই খারাপ বা সব কোলেস্টেরলই যে খারাপ, তা কিন্তু ঠিক নয়। কিছু ফ্যাট শরীরে উপকারী ভুমিকা রাখে। তাই প্রতিদিন এর খাদ্যতালিকায় অন্তত ২/৩ চা চামচ অলিভ অয়েল রাখলে ফুসফুসের প্রদাহজনিত সমস্যা দূর করে ফুসফুস কে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও এজমার সমস্যার সমাধানেও অলিভ অয়েল অনেক কার্যকরী ভূমিকা রাখে।
ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড
সিয়া সিড,তোকমা কুমড়ার বীজ সামুদ্রিক মাছ মাশরুম আখরোট বাদাম ইত্যাদি ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ খাবার যা খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায় এবং ভালো কোলেস্টেরল এর মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে। এসব খাবার গ্রহণে ফুসফুস সুস্থ ও কর্মক্ষম থাকবে।
কার্বোহাইড্রেট
ইদানীংকালের হাল ফ্যাশন হচ্ছে কার্বোহাইড্রেট ছাড়া ডায়েট চার্ট। সুষম খাদ্য তালিকা কখনোই কার্বোহাইড্রেট ছাড়া সম্ভব না। সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য সুষম খাদ্য তালিকার বিকল্প নাই। কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবারে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স রয়েছে যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। করনা কালীন সময়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হলে আমাদের অবশ্যই পরিমিতভাবে কার্বোহাইড্রেট অর্থাৎ পরিমিতভাবে ভাত, রুটি, চিড়া, মুড়ি, ওটস, বার্লি,সাগু ইত্যাদি খাবার খেতে হবে। তবে যাদের ডায়াবেটিস আছে কিংবা ওজনাধিক্য তে ভুগছেন তাদের জন্য সরল শর্করা কমিয়ে দিয়ে জটিল শর্করা জাতীয় খাবার বাড়িয়ে দিতে হবে। যেমন লাল চালের, ভাত লাল আটার রুটি, ওটস,ওটস খিচুরী, বার্লি, চিড়া, মুড়ি পরিমিত ভাবে প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় রাখতে হবে। এই সব খাবারে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্যআঁশ পাওয়া যায় যা ফুসফুসের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে ফুসফুস কে সুস্থ রাখতে কার্যকরী ভূমিকা রাখে।
তাই এই করনা কালীন সময়ে সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে হলে ফুসফুসের যত্নে সুষম খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
প্রতিদিন অন্তত পক্ষে 40 মিনিট হাঁটার অভ্যাস এবং 10 মিনিট ফুসফুসের ব্রিদিং এক্সারসাইজ করতে হবে। এতে করে করোনাসহ বিভিন্ন সমস্যা কার্যকর প্রতিরোধ সম্ভব হবে।
সামসুন নাহার স্মৃতি
ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনিষ্ট এন্ড ডায়েটিশিয়ান
উত্তরা ক্রিসেন্ট হসপিটাল, উত্তরা, ঢাকা