বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিসের ক্রমবর্ধমান প্রাদুর্ভাব এবং এর ক্ষতিকারক প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বেড়েছে। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস হূদরোগ, স্ট্রোক, কিডনিবৈকল্য, অন্ধত্বসহ নানা মারাত্মক পরিণতির প্রধানতম কারণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে Pandemic হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং আমাদের দেশে প্রায় আট শতাংশ মানুষ এতে আক্রান্ত।
ডায়াবেটিস-সম্পর্কিত বিবরণ তিন হাজার বছর আগে মিসরীয় সভ্যতায় পাওয়া গেলেও ১৯২১ সালে ইনসুলিন আবিষ্কারের পরই মূলত এর কার্যকর চিকিৎসা সম্ভব হয়। বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত গবেষণার মাধ্যমে উন্নত চিকিৎসাপদ্ধতি আবিষ্কার করছেন, যার অল্প কয়েকটি নিয়েই আজকের আলোচনা।
আধুনিক ইনসুলিন
বর্তমানে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে ইনসুলিন গঠনের পরিবর্তন করে ‘ইনসুলিন এনালগ’ তৈরি করা হয়েছে। যাঁরা সুগার নিয়ন্ত্রণে আরও অধিক দক্ষ, বিটা কোষ থেকে নিঃসৃত ইনসুলিনের মতো তাঁরা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ করতে সক্ষম। আমাদের শরীরে দুই পর্যায়ে ইনসুলিন নিঃসৃত হয়—অভুক্ত অবস্থায় এবং খাদ্য গ্রহণের সঙ্গে।
দীর্ঘস্থায়ী ইনসুলিন এনালগ গ্লারজিন ও ডেটেমির। এ ছাড়া স্বল্পমেয়াদি এসপার্ট ও গ্লুলাইসিন অভুক্ত ও খাদ্য গ্রহণের অব্যবহিত পরের শর্করা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে অধিক উপযোগী। খাদ্য গ্রহণের নির্দিষ্ট সময়ের আগে প্রচলিত ইনসুলিন গ্রহণের যে বাধ্যবাধকতা, আধুনিক ইনসুলিন এনালগ তা থেকে মুক্ত এবং রক্তে সুগারকে অতিমাত্রায় কমিয়ে দেওয়ার আশঙ্কা এদের ক্ষেত্রে কম।
ইনসুলিন পেন
সব টাইপ ওয়ান ও টাইপ টু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর একটি বড় অংশকে দিনে একাধিকবার ইনসুলিন গ্রহণ করতে হয়। আশির দশক থেকে যে ‘পেন’ ও অতি সূক্ষ্ম সুচ ব্যবহার করা হয়, তা এই ইনজেকশনের জটিলতাকে অনেক কমিয়ে দিয়েছে। এগুলো সহজে গ্রহণযোগ্য। ভায়াল থেকে প্রতিবার সিরিঞ্জে ইনসুলিন তোলার ঝামেলা থেকে মুক্ত এবং ব্যথার পরিমাণও নগণ্য। এর মাধ্যমে সঠিক মাত্রার ওষুধ প্রয়োগও নিশ্চিত হয়। আমাদের দেশে এগুলো বর্তমানে সহজলভ্য।
মুখে খাওয়ার কার্যকর ওষুধ
বিজ্ঞানীরা সম্প্র্রতি ইনক্রেটিন নামক বিশেষ আন্ত্রিক হরমোন আবিষ্কার করেছেন, যা ক্ষুধার অনুভূতি কমিয়ে দেয়, ওজন বৃদ্ধি প্রতিহত করে, খাদ্যকে পাকস্থলী ও অন্ত্রে অধিক সময় অবস্থান করায়, ইনসুলিনের নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয় এবং লিভার থেকে গ্লুকোজের নিঃসরণ প্রতিহত করে। এমনকি পরীক্ষায় দেখা গেছে, অগ্ন্যাশয়ের বিটা সেলকে ক্রমান্বিত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে এদের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে থাকে। ইনক্রেটিনের কার্যক্রম বৃদ্ধিকারী মুখে খাওয়ার ওষুধের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভিলডাগ্লিপাটিন ও সিটগ্লিপাটিন আমাদের দেশে বর্তমানে সহজলভ্য। লিরাগ্লুটাইড নামের ইনক্রেটিন-জাতীয় হরমোন ইনজেকশনের মাধ্যমে গ্রহণ করা যায়।
রক্তের অতিরিক্ত সুগারকে কিডনি মারফত শরীর থেকে বের করে দেওয়ার প্রক্রিয়াকে বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখছেন। কিডনির যে রিসিপ্টর গ্লুকোজকে শরীরে পুনরায় প্রবেশ করায়, ডাপাগ্লিফলোজিন ও রেনিগ্লিফলোজিন নামক দুটো ওষুধের মাধ্যমে তাদের নিষ্ক্রিয় করা সম্ভব। বিষয়টি গবেষণার শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
ইনসুলিন পাম্প
এটি একটি সহজে বহনযোগ্য, সাধারণ মুঠোফোন আকৃতির যন্ত্র, যেটা একটি সূক্ষ্ম পাইপ ও সুচের মাধ্যমে সার্বক্ষণিকভাবে শরীরে ইনসুলিন সরবরাহ করে থাকে। শরীরের চাহিদা, সুগারের মাত্রা ও খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ অনুযায়ী অভুক্ত অবস্থা ও খাদ্য গ্রহণের পরবর্তী প্রয়োজনীয় ইনসুলিন সহজে এই পাম্পের মাধ্যমে সরবরাহ করা যায়।
মুখে খাওয়ার উপযোগী ইনসুলিন
ইনসুলিন প্রোটিন-জাতীয় হরমোন হওয়ায় পাকস্থলী ও অন্ত্রের উৎসেচকের মাধ্যমে এরা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। অন্ত্রে এদের শোষণের হারও নগণ্য এবং খাদ্যের উপস্থিতিতে তা ব্যবহূত হয়। এ কারণে ইনসুলিন মুখে গ্রহণ করা যায় না। কিছু ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে অনেক অগ্রসর হয়েছে বলে ঘোষণা করেছে। যেমন—বায়োকন ফার্মাসিউটিক্যালের ‘ইনসুলিন পিল (IN 105) ও নভোনরডিস্কের NN1952। বস্তুত, এ বিষয়ে আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
অন্যান্য বিকল্প পথে ইনসুলিন গ্রহণ
ইনহেলারের মাধ্যমে ইনসুলিনকে বাষ্পীয় আকারে শ্বাসতন্ত্রে প্রয়োগ করে ইনজেকশনের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
মুখগহ্বরের আবরণে স্প্রের মাধ্যমে ইনসুলিন প্রয়োগ করে রক্তে শোষণের উপযোগী করা যায়। ইনসুলিন স্প্রে ২০০৯ সাল থেকে সীমিত আকারে কিছু দেশে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
বিটাসেল প্রতিস্থাপন
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর ধ্বংসপ্রাপ্ত বিটাকোষগুলোকে সুস্থ কোষের মাধ্যমে প্রতিস্থাপনের চেষ্টা চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বেশ কিছুদিন যাবৎ করছেন। ষাটের দশকে শুরু হলেও নব্বইয়ের দশকে এ বিষয়ে সফলতা পাওয়া যায়। এই পদ্ধতিতে রোগী অনেক ক্ষেত্রে ইনসুলিন ছাড়াই জীবন যাপন করতে পারে। উচ্চপ্রযুক্তির প্রয়োজনীয়তা ডোনারের স্বল্পতা এবং প্রতিস্থাপনকৃত কোষকে শরীরের অভ্যন্তরীণ পরিবেশে রক্ষা করতে প্রয়োজনীয় ওষুধের ব্যবহারের কারণে এই পদ্ধতি পৃথিবীর উন্নত কয়েকটি কেন্দ্রে সীমাবদ্ধ রয়েছে। STEM CELL-এর বৈশিষ্ট্য হলো, এগুলো পরিবর্তিত ও পরিণত হয়ে যেকোনো অঙ্গের কার্যকর কোষে পরিণত হতে পারে। STEM CELL থেকে নতুন বিটা সেল তৈরি করার সম্ভাবনা পরীক্ষাগারে
ইঁদুর ও অন্যান্য প্রাণীর ওপর প্রয়োগ করা হচ্ছে।
ডায়াবেটিস সম্পূর্ণভাবে নিরাময় না হলেও একে নিয়ন্ত্রণ করে জটিলতাগুলো এড়িয়ে চলা সম্ভব। খাদ্যনিয়ন্ত্রণ ও পরিমিত শারীরিক পরিশ্রমের পাশাপাশি বিজ্ঞানের এসব অবদান ভবিষ্যতে ডায়াবেটিসের চিকিৎসাকে আরও কার্যকর ও সহজ করে তুলবে।
আহসানুল হক আমিন
ডায়াবেটেলিজিস্ট ও হরমোন বিশেষজ্ঞ
সহকারী অধ্যাপক, বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা