মাহবুবা ইয়াসমিন
দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও স্নাতকোত্তর কলেজগুলোর ছাত্রছাত্রী দ্বারা পরিচালিত বাঁধন সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। জুয়েলের কথার সঙ্গেই যোগ করলেন ঢাবি জোনাল পরিষদের সভাপতি শামীম আহমেদ, এক যুগ আগেও রক্তের অভাবে মারা যেত রোগীরা। বাঁধনের সদস্যদের আপ্রাণ চেষ্টা ও ক্রমাগত উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমেই মানুষ আজ স্বেচ্ছায় রক্তদানে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।
বাঁধনের মূল উদ্দেশ্য হলো স্বেচ্ছায় রক্তদানকে সামাজিক আন্দোলন হিসেবে গড়ে তোলা। বাংলাদেশের জন্য সব আন্দোলনের মতো স্বেচ্ছায় রক্তদানের এই আন্দোলনেরও উদ্ভব হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই।
শামীম ও জুয়েলের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই জানা গেল বাঁধনের শুরুর দিকের কথা। তাঁরা জানান, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাশাপাশি অবস্থিত হওয়ার কারণে একটা সময় এই মেডিকেলের রোগীদের আত্মীয়স্বজন ঢাবির বিভিন্ন হলে আসতেন এক ব্যাগ রক্তের আশায়। কিন্তু সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শতাংশ ছাত্রছাত্রীও নিজেদের রক্তের গ্রুপ জানতেন না। ঠিক এ রকম অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের পুকুরপাড়ে ১৯৯৭ সালের ২৪ অক্টোবর শাহিদুল ইসলামের উদ্যোগে একঝাঁক নিবেদিতপ্রাণ তরুণ বিনা মূল্যে রক্তের গ্রুপ নির্ণয় কর্মসূচির মাধ্যমে এ সংগঠনটির যাত্রা শুরু করে। সেই থেকে দিনবদলের শুরু। ‘একের রক্ত অন্যের জীবন, রক্তই হোক আত্মার বাঁধন’ স্লোগান সামনে রেখে বাঁধনের যাত্রা শুরু হয়েছিল আরও ১২ বছর আগে। পড়াশোনার পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবায় নিঃস্বার্থ ব্রত নিয়ে কিছু উদ্যমী শিক্ষার্থীদের চেষ্টায় যে শিশুসংগঠনটির জন্ম হয়েছিল, তা আজ অনেক দায়িত্বশীল। বর্তমানে বাঁধনের বিস্তৃতি আছে ১০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯টি কলেজসহ মোট ২৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। বাঁধন তিনটি সাংগঠনিক স্তরে তার কার্যক্রম পরিচালনা করে। প্রথমটি ইউনিট কমিটি। এরপর জোনাল পরিষদ এবং তার ওপরে রয়েছে কেন্দ্রীয় পরিষদ। এ ছাড়া ঢাকা শহরের বেশ কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নিজস্ব ব্লাড ডোনার ক্লাব’ গড়ে তুলতে সহযোগিতা করেছে বাঁধন।
গত ১২ বছরে বাঁধন মোট ২ দশমিক ৪২ লাখ ব্যাগেরও বেশি রক্ত সরবরাহ করেছে এবং বিনা মূল্যে রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করা হয়েছে প্রায় ৭ দশমিক ৪৩ লাখ মানুষের। এ তথ্য জানালেন বাঁধন কেন্দ্রীয় পরিষদের সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন।
বাঁধনের কার্যক্রম সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু হলের বাঁধনের কর্মী আরিফ বলেন, ‘বাঁধনের কর্মী হিসেবে আমরা সম্ভাব্য রক্তদাতাদের কাছে রোগীর আবেদন পৌঁছাই, রক্ত দিতে অনুরোধ করি, ভয় পেলে সাহস জোগাই এবং নানাভাবে রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করে থাকি। এ ছাড়া বাঁধনের নিয়মিত কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে কর্মশালা আয়োজন, টেকনিশিয়ান ট্রেনিং প্রোগ্রাম, বিভিন্ন জাতীয় দিবস উদ্যাপন ইত্যাদি।’ ‘তবে এর পাশাপাশি আমরা আরও কিছু কাজ যেমন—স্বাস্থ্য সচেতনতা, স্বল্পমূল্যে টিকাদান ও নানা ধরনের দুর্যোগের সময় সহায়তামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকি।’—যোগ করলেন সরকারি তিতুমীর কলেজের বাঁধন ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক সালমা সুলতানা।
সূর্য সেন হল ইউনিটের সভাপতি তারেক মাহমুদ বাঁধনে কাজ করছেন ২০০৬ সাল থেকে। বাঁধনের আয়ের উৎস সম্পর্কে জানতে চাইলে গর্বের সঙ্গে তিনি জানান, ‘সদস্যদের নিয়মিত মাসিক চাঁদা বাঁধনের আয়ের প্রধান উৎস।’ তবে সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের আর্থিক অনুদানও বাঁধনের আর্থিক জোগানে সহায়তা করে বলে তিনি জানান।
কেন্দ্রীয় পরিষদের সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন জানান বাঁধনের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য ও স্বপ্নের কথা, ‘বাঁধন একদিন নিষ্প্রয়োজন হয়ে যাবে—এটাই আমাদের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য। যেদিন বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষ নিজের রক্তের গ্রুপ জানবেন এবং প্রাপ্তবয়স্ক প্রত্যেকে স্বেচ্ছায় রক্তদানে এগিয়ে আসবেন, সেদিন এ দেশে বাঁধনের মতো কোনো রক্তদাতা সংগঠনের প্রয়োজন হবে না। আর এ লক্ষ্যকে বুকে ধারণ করেই বাঁধন তার আপন গতিতে এগিয়ে চলেছে।’
বাঁধনের এই স্বপ্ন পূরণে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারে আমাদের তরুণ ও যুবসমাজ। বাঁধন আজ একটি স্বপ্নের আলোকবর্তিকা নিয়ে এগিয়ে এসেছে এ দেশের তরুণসমাজের মধ্যে।