রোজার কারণে রোগী দেখার সময়সূচী কিছুটা পরিবর্তিত ও সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। তাছাড়া রোগীদের সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকেরও যে বয়স বৃদ্ধি পাচ্ছে তার নজির বিভিন্ন উপায়ে ধরা পড়ছে। সরকারী অচিকিৎসক চাকুরেরা সপ্তাহে দু’দিন ছুটি উপভোগ করেন। আর চিকিৎসকরা সপ্তাহের প্রতিদিনই কোন না কোন দুর্ভোগ পোহান। রোজার কারণে তাই সন্ধ্যার পর একটু বিরতি নিতে পারায় স্বস্তি বোধ করছি। কিন্তু রোগ তো আর বাধা মানে না। তাই পূর্ব নির্ধারিত অ্যাপয়েন্টমেন্ট না থাকলেও অনেক রোগী সরাসরি চেম্বারে এসে সাক্ষাৎ পাবার আশায় ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করেন।
তেমনই একজন হলেন সুফিয়া খাতুন। পঞ্চাশোর্ধ সনাতন বাঙালি মধ্যবিত্ত । দু’টি সন্তানের জননী। সকাল ১১ টা থেকে চার ঘণ্টা ধরে চেম্বারের সামনে অপেক্ষা করছেন। আমরা যারা হৃদরোগ চিকিৎসক তাদের পেশার ধরণ অন্যান্য বিষয়ের চিকিৎসকদের থেকে আলাদা। আমাদেরকে প্রায় প্রতিদিনই একাধিক রোগীর অ্যানজিওগ্রাম এবং অ্যানজিওপ্লাস্টি (রিং লাগানো) সম্পন্ন করতে হয়। একদিকে চেম্বারের রোগী, অন্যদিকে ক্যাথল্যাবের ( অ্যানজিওগ্রাম করার ওটি) কাজ করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়। ফলে চেম্বারের রোগীদেরকে অনেক সময় দীর্ঘ অপেক্ষায় থাকতে হয়। আবার আমাদের দেশে রেফারেল ব্যবস্থা না থাকায় সাধারণ সর্দি কাশি নিয়েও রোগীরা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের শরণাপন্ন হল। তাতে সত্যিকার জটিল রোগীরা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা থেকে বঞ্চিত হন।
সে যাই হোক। সুফিয়া খাতুন এখন আমার সম্মুখে বসে আছেন। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস আর বাত ব্যথার রোগী তিনি। এ ছাড়া মাসিক বন্ধ হয়ে হরমোনাল ভারসাম্য না থাকায় নানান উপসর্গ দেখা দিয়েছে।
-ডাক্তার সাব ঘাড়ে পিঠে ব্যথা। হাঁটতে গেলে ব্যথা। রাতে ঘুম নাই।
যাঁদের উচ্চ রক্তচাপ আর ডায়াবেটিস আছে তাঁরা যদি বুকে ব্যথার কথা বলেন তখন আমরা সতর্ক হয়ে যাই। হৃদপিণ্ডের ধমনীতে ব্লক হলো কিনা। সুফিয়া খাতুনের বুকে ব্যথার কথা শুনে একটু নড়েচড়ে বসলাম। জিগ্যেস করলাম-
-বুকের ব্যথা কি হাঁটাচলা বা পরিশ্রম করলে বাড়ে?
-কখনো বাড়ে, আবার কখনো শুয়ে বসে নড়াচড়া করলেও লাগে ।
হার্টে ব্লক হলে সাধারণত পরিশ্রম করলে বা ভারী বস্তু উত্তোলন করলে বুকে ব্যথা বা চাপ অনুভূত হয়। কিন্তু সুফিয়া খাতুনের ব্যথাটা সেরকম মনে হচ্ছে না।
রোগ নির্ণয়ে শুরু শারীরিক সমস্যা জানলেই চলে না। রোগীর অতীত, পরিবার, আর্থসামাজিক পরিপ্রেক্ষিত এবং মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কেও একটি পরিষ্কার ধারণা নেয়া আবশ্যক। এর পরের ধাপ হলো প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা। তারপর চিকিৎসা।
সুফিয়া খাতুনের এক ছেলে, এক মেয়ে। মেয়েকে গ্র্যাজুয়েশন করার পরপরই বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। একমাত্র ছেলে বিবিএ করে একটি কর্পোরেট সংস্থায় চাকরি করে। ছেলে প্রেম করে বিয়ে করেছে। দু’বছরের একটি ফুটফুটে নাতি আছে। পুত্রবধূ কর্মজীবী হওয়ায় নাতির আদর যত্ন দেখভাল সুফিয়া খাতুন নিজেই করেন। তিনি অবশ্য তাতে অনাবিল আনন্দ লাভ করেন। নাতির নিষ্পাপ হাসিতে তাঁর জীবনের অনেক কষ্ট লাঘব হয়। নাতির বেড়ে ওঠার ভেতর তিনি তাঁর অনাগত পৃথিবীর অস্তিত্ব অনুভব করেন। সংসারের সব কাজ তিনিই সামলান। অসুস্থ স্বামীর যত্নও তিনি করেন। বাড়ির বাজার সদাই তিনিই করেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা শূন্যতা রয়ে যায়। সবার জন্য এত কিছু করেও সবার মন পেতে ব্যর্থ তিনি। রান্নায় সামান্য হেরফের হলে সবাই মিলে গালমন্দ করে। এত আদরের ছেলেকে আজ দূরের কেউ মনে হয়। জীবনভর স্বামীর সেবা করেও তার মন পেলেন না।
সাংসারিক কলহ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, একই ছাদের নীচে বসবাস করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। ছেলের আচরণে পুত্রবধূ উৎসাহিত হয়ে শাশুড়ির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। পুতুলের মত নাতিটার মায়াভরা মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি সব সহ্য করছিলেন। কিন্তু আর পারা গেল না। বাবার দেয়া একটি ছোট জমির মালিক সুফিয়া খাতুন। ছেলে চায় সেই জমি বিক্রি করে টাকাটা তার হাতে তুলে দিতে। সে একটা ব্যবসা দাঁড় করাবে। কিন্তু সুফিয়া খাতুন তার শেষ সম্বল হাতছাড়া করতে রাজি নন। এই নিয়ে মা ছেলের দ্বদ্ধ চরমে।
ব্যস্ত পেশাগত জীবনে এত ব্যক্তিগত ইতিহাস শোনার সময় কোথায়! আমি তাই তাঁকে শারীরিক পরীক্ষা করার জন্য উদ্যোগ নিলাম। রক্তচাপ, হার্টবিট ইত্যাদি দেখলাম। বুক এবং কাঁধের সন্ধিস্থলে স্টেথোস্কোপ বসাতেই তিনি আঁৎকে উঠলেন।
-উফ্ অনেক ব্যথা ডাক্তার সাব!
কিন্তু এই ব্যথার ধরণ অন্যরকম মনে হলো। আমি পরিধেয় কাপড় সরাতেই দেখলাম একাধিক আঘাতের চিহ্ন। ছোপ ছোপ রক্তজমাট।
-এটা কি করে হলো? পড়ে গিয়ে আঘাত পেয়েছিলেন?
-যাকে আমি পেটে ধরেছিলাম সেই আদরের ছেলে লাঠি দিয়ে আমাকে পিটিয়ে প্রতিদান দিয়েছে!
এই কথা বলে হুহু করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন সুফিয়া খাতুন!
হার্টে ব্লক খুঁজতে গিয়ে আমি এ কোন্ ব্লক আবিষ্কার করলাম?
লেখক: ডা. মাহবুবর রহমান, সিনিয়র কনসালটেন্ট ও সিসিইউ ইন-চার্জ
ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল