উপমহাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় সেক্স একটি ট্যাবু । এই সমাজে সেক্স মানে ভাবা হয় অশ্লীল কিছু । আর তাই সেক্স নিয়ে আছে অসংখ্য মিথ । অথচ প্রতিটি মানুষের জন্ম উৎস দুটি মানব-মানবী । শরীরকে ঘিরেই তৈরি হয় পরিবারের সূচনা ।
সেক্স ব্যাপারটিকে ট্যাবু করা মানেই নিজেদের শেকড়টাকেই ব্যঙ্গ করা । তাই, সেক্স কখনোই ট্যাবু নয়, ট্যাবু হওয়া উচিত নয় ।
কালচারাল পার্থক্যের কারণে কোনো কোনো সমাজে সেক্সচুয়াল এক্সপ্রেশনের পার্থক্য থাকতে পারে কিংবা থাকবে, কিন্তু তার সম্পর্কে সামাজিক অন্ধ নিয়মের ঘেরাটোপ সেক্সকে অজ্ঞানতায় নিয়ে যায় । আর অজ্ঞানতা থেকে অস্থিরতা এবং অস্থিরতা থেকে অপরাধে রূপান্তরিত করে সেই অনুভূতি । স্বর্গীয় স্বাদকে আমরা ভুল করে নরকের উৎপাত করে ফেলি ।
সেক্স নিয়ে আমাদের মতো কনজারভেটিভ সোসাইটিতে আছে অসংখ্য মিথ । আবার সেই মিথগুলোর ধরন নারী পুরুষে পার্থক্য করে । এ নিয়ে দশটি মিথের সংক্ষিপ্ত আলোচনা।
এক. সমাজে চালু যে – সব পুরুষ তো পুরুষই, কারণ তার সেক্স ডিজায়ার বেশি । নারীর সেক্স ডিজায়ার কম । কিন্তু এটি ভুল । পুরুষের তুলনায় নারীর সেক্স ডিজায়ার এন্ড ডিমান্ড দুটোই অনেক বেশি । কারণ, পুরুষের শরীরে সেনসুয়াল পার্ট নারীর চারভাগের এক ভাগ মাত্র । পুরুষের সেক্স ডিজায়ারটি প্রকাশ পেয়ে যায় বলে দেখতে বেশি মনে হয় । নারীর ডিজায়ার চার গুন্ বেশি হওয়ার পরেও নারী সেগুলো লুকিয়ে রাখে বলে কম মনে হয় । নারীর এরকম ডিসায়ার অ্যান্ড ডিমান্ড বেশি থাকার মানে নয় আবার পুরুষরা তাদের সহজে উৎপাত করা উচিত। কোন পুরুষকে পছন্দ না হলে নারীরা সহজে তাদের সেই ডিসায়ারের প্যানডোরা বাক্সটি খুলে না।
দুই. মনে রাখবেন – পুরুষ শরীর দিয়ে সেক্স এনজয় করে, নারী মাথা দিয়ে সেক্স উপভোগ করে। সেক্সের ক্ষেত্রে পুরুষ তার মাথাকে বেশিক্ষণ ব্যবহার করতে পারে না। নারী মাথা দিয়ে গোটা সেক্স অ্যান্ড দা সিটির একটি এপিসোড বানিয়ে ফেলতে পারেন।
তিন. মিথ আছে যে পুরুষ সেক্সের ক্ষেত্রে প্রতারণা করে, নারী সেক্সের ক্ষেত্রে সবসময় লয়াল। ধারনাটি ভুল। পুরুষ প্রেমের ক্ষেত্রে প্রতারণা করে বেশি। আর নারী সেক্সের ক্ষেত্রে প্রতারণা করে বেশি। শুনতে ও মেনে নিতে কষ্ট হয় কিংবা হবে হয়তো। কারণ মিথ অনেক সময় ভুল জিনিসের উপরে দাঁড় করানো থাকে। রিয়েলিটাকে জানলে সত্য উপলব্ধিটা সহজ হয়।
চার. মানুষের ধারনা এবং মেয়েরাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দাবি করেন যে- মেয়েরা ছেলেদের সাথে কানেক্ট করতে না পারলে সেক্স উপভোগ করে না। কিন্তু গবেষণা এবং পরীক্ষায় দেখা গেছে উল্টো। ছেলেরা যখন কোনো মেয়ের সাথে ইন্টিমেট হয়, তখন লয়াল থাকে, মেয়েটির কাছে প্রশংসা শুনতে পছন্দ করে, কেয়ারিং ভেলু করে, তাতে ছেলেটির সেক্স ইন্টিমেসি বেড়ে যায় । কিন্তু যে সম্পর্কের মধ্যে ইন্টিমেসি যত কম থাকে মেয়েরা তত বেশি সেক্স এনজয় করে। মনে রাখবেন একটা সময় পর ইন্টিমেসি মেয়েদের সেক্স ড্রাইভ কমিয়ে দেয়। মেন্টালি ডিপেন্ডেন্ট পার্টনারকে মেয়েটি কেয়ার করে, কিন্তু শরীরে তার জন্যে সেক্স ডিজায়ার ফিল করে না । সম্পর্ক ধরে রাখতে মেয়েরা বাধ্য হয়ে ঠিক তার উল্টোটি করে এবং দেখায় । তখন মেয়েটি সেক্স করে কেবল, কিন্তু সেক্সটি উপভোগ করে না । রুটিন করে নিয়মের জন্যে বাধ্য হয়ে একটা কিছু করা এবং উপভোগ করা, দুটো ভিন্ন জিনিস । তাই বলা হয় – মেয়েরা সবচেয়ে বেশি এনজয় করে No-strings Sex।
পাঁচ. মেয়েরা যৌন উপভোগের সময় চিৎকার করলে ছেলেরা খুশি হয় এবং নিজের পুরুষ বীরত্ব অনুভব করে এই ভেবে যে – সে তার পার্টনারকে আনন্দ দিতে পারছে । এই জন্যে অনেক মেয়েরা পুরুষকে খুশি করতে ফেইক সাউন্ড করে অনেক সময় । মেয়েদের অর্গাজম দেখলে পুরুষের সেক্স ডিজায়ার বেড়ে যায় । কিন্তু বিছানায় মেয়েরা চায় ছেলেটি উপভোগের সময় যত বেশি ডার্টি হতে পারে । এটি মেয়েদের সেক্স ডিজায়ার বাড়িয়ে দেয় ।
ছয়. সমাজে কমন মিথ যে – ছেলেরা সেক্সের ক্ষেত্রে পলিগামী বা অনেক পার্টনারের সাথে যায় । আর মেয়েদের ক্ষেত্রে বলা হয় মেয়েরা যৌনতায় মনোগামী বা একজনের সাথেই লয়াল থাকে । গবেষণায় দেখা গেছে এটি ভুল । ছেলেরা যখন সত্যিকার ভালোবাসে এবং ইন্টিমেট হয় – তারা মনোগ্যামি হয় বেশি । কিন্তু মেয়েরা সেক্সের ক্ষেত্রে পলিগ্যামি । ছেলেদেরকে যৌনতার ক্ষেত্রে যতটা চিটার বলা হয়, ছেলেরা চিটার নয় । বরং মেয়েরা অনেক বেশি চিট করে সেক্সের ক্ষেত্রে । কিন্তু সমাজে তাহলে এমন মিথ হলো কেন । কারণ হলো – ছেলেদের সেক্স এক্সপ্লোরেশনটি খুব একটা চাপা থাকে না, ছেলেরা চেপে রাখতে পারে না, বেরিয়ে আসে ব্যাপারটি । কিন্তু মেয়েদের সেক্স এপ্লোরেশনের সিংহভাগ গোপনে হয়, গোপন রাখে এবং গোপনে করে বেশি । যে কারণে ঠিক তার বিপরীত চিত্র সমাজে স্টাব্লিস্ট হয়ে যায় । ঘরে পার্টনার থাকার পরেও পুরুষ সেক্স এক্সপ্লোরেশনে অন্য নারীর কাছে যায় শরীরের কারণে নয়, বরং যার সাথে ঘরে সেক্স করছে তার কাছ থেকে অথবা তার সাথে ইন্টিমেট কানেকশনটি তৈরী হয় না বা করতে পারে না বলে সে ঘরের বাহিরে নিজের সে সেটিসফেকশনটি অজান্তে খুঁজে । কিন্তু নারীর সেক্স সেটিসফেকশন আসে যত কম ইন্টিমেসি এবং যত বেশি বৈচিত্রতা যেখানে সে পায় । সেটার আয়োজন এবং প্রয়োজনে নারীকে গোপনে কাজটি করতে হয় ।
সাত. সমাজে প্রচলিত যে – পুরুষ সেক্সের ক্ষেত্রে প্রতারক, নারী ভালোবাসার ক্ষেত্রে প্রতারণা করে। বরং আসলটি তার উল্টো। পুরুষ সেক্সের ক্ষেত্রে প্রতারক নয়, এক্সপোসড। নারী সেক্সের ক্ষেত্রে প্রতারণা করে, কারণ ওটা হাইড। পুরুষ ভালোবাসলে উম্মাদের মতো ভালোবাসে, তাই দেখা যায় ভালোবাসার ক্ষেত্রে প্রতারণার শিকার হলে পুরুষ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। সমাজে মজনু পাগল বেশি, লাইলী পাগলী দেখা যায় না। কারণ ভালোবাসায় নারী সবসময় আধা আধি। এই জন্যে ধাক্কা খেলেও নারীরা সময়ে ঠিকই ফিরে আসতে পারে।
আট. ভালোবাসায় মেয়েরা সেক্স সেটিসফেকশন বেশি খুঁজে, কিন্তু সেটা আড়ালে রাখে । ছেলেরা সেক্স এনজয় করার জন্যে ভালোবাসায় তেমন গভীরে না গিয়েও সেটিসফাইড হতে পারে। এই জন্যে পুরুষ পতিতালয় গিয়েই যৌনতা উপভোগ করতে পারে । পুরুষ ভালোবাসার মধ্যে সেক্সের চেয়ে কানেকশন, ইন্টিমেসি, শেল্টার এবং সাপোর্ট খুঁজে।
নয়. ছেলেরা পর্ন বেশি দেখে, কারণ, ছেলেরা ভিজুয়ালি স্টিমুলেটেড হয় বেশি। মেয়েরা কল্পনা করেই স্টিমুলেটেড হয়ে যায় আরো বেশি। এই জন্যে বলা হয় – ছেলেরা পর্ন দেখে, মেয়েরা মাথা দিয়ে পর্ন বানায়।
দশ. সমাজে মিথ আছে যে – মাস্টারবেশন সেক্স ড্রাইভ কমিয়ে দেয়, সেক্স অর্গানের ক্ষতি করে । এটি সম্পূর্ণ ভুল । মাস্টারবেশনের সাথে সেক্স ড্রাইভ বেড়ে যাওয়া কিংবা কমে যাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই । মাস্টারবেশনে পেনিস কিংবা ভেজাইনার কোনো ক্ষতি হয় না । বরং গবেষণায় দেখা গেছে ক্ষতি হওয়া তো দূরের কথা, মাস্টারবেশন শরীর এবং মন, দু দিক থেকেই অনেক ভাবেই উপকারী । মিথ আছে, মাস্টারবেশন শুধু সিঙ্গেল, নারী পুরুষ করেন ! এটিও ভুল । বিবাহিত হোক এবং যে কোনো বয়সেই হোক, শরীরের প্রয়োজনে নারী এবং পুরুষের মাস্টারবেশন শারীরিক এবং মানসিক ভাবে উপকারী । আরেক গবেষণায় দেখা গেছে 64% মেয়েরা পুরুষের সাথে পিনারট্রেটিভ সেক্স এনজয় করেন না । ভেজাইনাল পিনারট্রেটিভ সেক্স পুরুষ উপভোগ করে বেশি । কিন্তু অধিকাংশ নারী ক্লিটোরাল সেক্স উপভোগ করেন । তাই নারী মাস্টারবেশন করে ক্লিটোরাল অর্গাজম যে পরিমাণ উপভোগ করতে পারে, পুরুষ নারীকে ইন্টারকোর্সে তার এক তৃতীয়াংশ আনন্দ দিতে পারে । যদিও নারীদেরকে পুরুষ শাসিত সমাজে পুরুষকে স্যাটিসফাই করতে নিজেদেরকে বঞ্চিত করেই এই এক তৃতীয়াংশ স্বাদে পরিপূর্ণতার অভিনয় করে যেতে হয় ।
একটি সমাজে মিথের জন্ম হয় অজ্ঞতা থেকে । জ্ঞাত হলে মিথ সরে গিয়ে ফুটে উঠে বাস্তবতা । বাস্তবতা মানুষকে অপরাধী করার চেয়ে অন্যের অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তুলে । নিজের জন্যে বাস্তবতার অনুভব অন্যের প্রতি সহমর্মিতার হাত বাড়ায় । সেক্স তখন ট্যাবু না থেকে দুটো মানুষের সুস্থ একটি বন্ধনে পরিণত হয়।
চিন্তা শুদ্ধ হয়ে উঠলে শরীরও শুদ্ধ হয়ে ওঠে।
© অপূর্ব চৌধুরী। চিকিৎসক, কথাসাহিত্যিক ও বিজ্ঞান লেখক । জন্ম বাংলাদেশ, বসবাস ইংল্যান্ড । গ্রন্থ ৮ । উল্লেখযোগ্য বই : অনুকথা, জীবন গদ্য, ভাইরাস ও শরীর ।