হাতের মাধ্যমে প্রতিদিন হাজারও জীবাণু আমাদের দেহে সংক্রমিত হচ্ছে। আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার ফলে এসব জীবাণুর অধিকাংশই মারা যায়। কিন্তু যখন জীবাণুর পরিমাণ অত্যধিক হয় বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল থাকে তখনই আমরা অসুখে ভুগতে থাকি তৌহিদ সাহেব ৩ মাস ধরে পেটের পীড়ায় ভুগছেন।
এরপর তিনি খাবার মেন্যু পরিবর্তন করলেন। বাইরে খাওয়া তো ছেড়েই দিলেন। অনেক ডাক্তার দেখালেন। টেস্ট করালেন কয়েকবার, ওষুধ খেলেন বিস্তর। ওষুধ খেলে ক’দিন ভালো থাকেন। আবার শুরু হয় ডায়রিয়া। অবশেষে এক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে গেলেন। বিস্তারিত শোনার পর ডাক্তার বুঝতে পারলেন তার কোনো জটিল রোগ হয়নি, খাওয়ার আগে সঠিক নিয়মে হাত না ধোয়ার ফলে তার এ অসুখ। ডাক্তারের পরামর্শমতো যখন তিনি সবক্ষেত্রে সঠিক নিয়মে হাত ধোয়া শুরু করলেন, তার কিছুদিনের মধ্যেই তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলেন। তার সব রোগও গেল উধাও হয়ে।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, হাতের মাধ্যমে প্রতিদিন হাজারও জীবাণু আমাদের দেহে সংক্রমিত হচ্ছে। আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার ফলে এসব জীবাণুর অধিকাংশই মারা যায়। কিন্তু যখন জীবাণুর পরিমাণ অত্যধিক হয় বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল থাকে তখনই আমরা অসুখে ভুগতে থাকি। আর অসুখে ভুগলে শারীরিক ভোগান্তি তো আছেই, তার সঙ্গে মানসিক কষ্ট, ক্লান্তিভাব, অফিস কামাই, কাজে ব্যাঘাত, ডাক্তার দেখানো, ওষুধ খাওয়া, অর্থেরও অপচয়। তার চেয়ে হাত ধোয়ার মতো সহজ অভ্যাসটুকু গড়ে তুললে আমরা সব ভোগান্তি আর রোগবালাই থেকে মুক্ত থাকতে পারি।
হাত ধোয়া কিন্তু শিশুদের জন্য খুবই জরুরি। প্রতি বছর ৫ বছরের নিচের ৩.৫ মিলিয়ন শিশু ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় মারা যায়। শিশুরা যদি হাত ধোয় এবং শিশুদের খাবার তৈরি করতে যদি অভিভাবকরা হাত ধুয়ে নেন, তবে এ মৃত্যু ২৫ শতাংশ কমানো যায়। পাকিস্তানে এক গবেষণায় দেখা গেছে, হাত ধোয়ার ফলে শিশুদের শ্বাসতন্ত্রের রোগ অর্ধেক কমে গেছে। হাত ধোয়ার ফলে সবচেয়ে বেশি উন্নতি হয় ডায়রিয়া পরিস্থিতির। বিশ্বজুড়ে সঠিক নিয়মে হাত ধুলে ডায়রিয়াজনিত শিশুমৃত্যু অর্ধেকে নেমে আসবে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, শুধু হাত ধুলেই শতাব্দীর উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় ২০১৫ সালের মধ্যে শিশুমৃত্যুর হার দুই-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনার যে কথা বলা হচ্ছে তা অনেকখানি অর্জিত হবে। নিয়মিত হাত ধুলে বিভিন্ন কৃমি বিশেষ করে এসকেরিয়াসিস ও ট্রাইচুরিয়াসিসের সংক্রমণ কম হয়। হাত ধুলে চোখের রোগ ট্রাকোমা এবং ত্বকের রোগ ইমপেটিগো কম হয়।
যারা খাদ্য বিক্রি, সরবরাহ ও রান্না করেন তাদের হাত পরিষ্কার রাখা খুবই দরকার। কারণ তাদের মাধ্যমে রোগ ছড়াতে পারে। হাসপাতালের চিকিৎসক ও সেবিকাদেরও হাত ধোয়া জরুরি।
হাত ধোয়া বেশি প্রয়োজন, যখন আমরা খাবার বানাই ও খাই তার আগে। যখন কোনো অসুস্থ মানুষের কাছে যাই, তার পরিচর্যা করি, শিশুদের পরিচর্যা করি, কোনো কাটা অংশের পরিচর্যা করি তার আগে অবশ্যই হাত ধুতে হবে। আবার মলমূত্র ত্যাগের পর, ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার, বাইরে বেড়াতে যাওয়া, অফিস থেকে আসা, হাঁচি-কাশি দেওয়া, অসুস্থ মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আসার পর হাত ধোয়া উচিত। ক্ষত ধোয়া, জীবজন্তু ঘরে পোষা হলেও তাদের ধরার পর হাত ধুতে হবে। বাচ্চাদের মলমূত্র পরিষ্কারের পরও হাত ধোয়া জরুরি।
হাত ধোয়া এত জরুরি জেনেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, প্রয়োজনীয় মুহূর্তে মানুষের হাত ধোয়ার হার শূন্য থেকে চৌত্রিশ শতাংশ। খোদ যুক্তরাষ্ট্রে এটি ৬২ শতাংশ। হাত ধোয়ার কিন্তু কিছু নিয়ম আছে। শুধু পানি দিয়ে হাত ধুলে বাহ্যিকভাবে পরিষ্কার হয় সত্যি, কিন্তু জীবাণুমুক্ত হয় না। জীবাণুর বিরুদ্ধে কার্যকর সাবান, লিকুইড সোপ ও হ্যান্ড রাব বেশি কার্যকর। হাসপাতাল ছাড়া সাধারণ গৃহস্থালি, অফিস-আদালতে হাত জীবাণুমুক্ত রাখার জন্য সাবান বা লিকুইড সোপ দিয়ে হাত ধুলেই চলে। লিকুইড সোপ নিলে প্রতিবার হাত ধোয়ার সময় অন্তত ৩ মিলিলিটার নেওয়া উচিত। প্রথমে বিশুদ্ধ পানি দিয়ে হাত ভিজিয়ে এরপর সাবান বা লিকুইড সোপ হাতের কব্জি পর্যন্ত মাখানো উচিত। এরপর হাতের উভয় পাশে, আঙ্গুলের ফাঁকে, নখের চারপাশে ও ভেতরে অন্তত ১৫ থেকে ৩০ সেকেন্ড ঘষা উচিত। এরপর পানির স্রোতধারায় (জমানো পানির চেয়ে প্রবহমান পানি বেশি কার্যকর) হাত দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে ফেলা উচিত। তারপর পরিষ্কার টাওয়াল দিয়ে হাত আলতো করে মুছতে হবে। মোছার সময় ঘষামাজা না করাই ভালো, এতে ত্বকের ক্ষতি হয়। হাত ধোয়ার সচেতনতামূলক বিভিন্ন পরিকল্পনা বা পদক্ষেপ অনেকেই বাঁকা চোখে দেখেন। তাদের ধারণা, গরিব দেশগুলোর নিরন্ন মানুষের পক্ষে সাবান কেনাটা বিলাসিতা। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, দরিদ্র দেশগুলোর অন্যতম উগান্ডায় শতকরা ৯৫ ভাগ, কেনিয়ায় ৯৭ ভাগ আর পেরুতে ১০০ ভাগ মানুষের ঘরেই সাবান থাকে, তবে তারা গোসল বা থালা-বাসন মাজতেই সাবান ব্যবহার করেন, হাত ধুতে খুব একটা সাবানের ব্যবহার করেন না। আসলে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া হলো সুস্থ থাকার সবচেয়ে সস্তা উপায়। আমরা সুস্থ থাকার জন্য অনেক নিয়ম মানি, অনেক কিছু খাই, চিকিৎসকের কাছে যাই। অথচ সুলভ মূল্যের একটি সাবান কিনলে আর একটু সচেতন হলে আমরা অনেক নীরোগ থাকতে পারি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহারে শিশুদের ডায়রিয়া কমে শতকরা ৩২ ভাগ, স্বাস্থ্য শিক্ষায় ৩২ ভাগ, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে ২৫ ভাগ আর সঠিক নিয়মে হাত ধুলে ৪৪ ভাগ।
আমাদের দেশে হাত ধোয়ার অভ্যাস গ্রামাঞ্চলের লোকজনের মধ্যে অশিক্ষা এবং সেই সূত্রে স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাবে গড়ে ওঠেনি। শহরাঞ্চলের চিত্র যে খুব আশাপ্রদ তা নয়। লাইফবয়ের শহরভিত্তিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, শহরাঞ্চলে শতকরা ৫৭ জন খাবার আগে হাত ধুয়ে থাকেন। শতকরা ১৪ জন সমীক্ষায় সরবরাহকৃত উত্তরপত্রে মলত্যাগের পর হাত ধোয়ার কথা উল্লেখ করেননি। অভিভাবকদের মাঝে দেখা গেছে মাত্র শতকরা ৩৬ ভাগ মলত্যাগের পর এবং শতকরা ৬৮ ভাগ খাবার আগে হাত ধোয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করে থাকেন। যুক্তরাষ্ট্রে এক গবেষণায় দেখা গেছে, ডায়রিয়া কমাতে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা স্থাপন, রোটা ভাইরাস ভ্যাকসিন কার্যক্রম পরিচালনা এবং শিশু ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলে সরকারের যে চিকিৎসা ব্যয় হয়, তার চেয়ে অনেক অর্থ কম খরচ হবে যদি জাতীয়ভাবে হাত ধোয়ার কার্যক্রম ছড়িয়ে দেওয়া যায়। সমাজের সব স্তরের মানুষের উচিত সঠিক নিয়মে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যাপারে নিজে সচেতন হওয়া এবং অন্যদের সচেতন করা।
ডা. ফাহিম আহমেদ রুপম