পৃথিবীর বর্তমান জনগোষ্ঠীতে যেসব সংক্রামক রোগ বিরাজমান তার মধ্যে ভয়াবহতম হচ্ছে এইডস (AIDS)। এইচআইভি (HIV) এ রোগের জীবাণু। উন্নত-অনুন্নত সবদেশেই যথেষ্ট আতঙ্কজনক সংখ্যার এইডসের রোগী পাওয়া যাচ্ছে। ১৯৮১ সালে এইডস-এর জীবাণু এইচআইভি শনাক্ত করা হয়। ১৯৮৫ সালে আফ্রিকাতে প্রথমবারের মতো এইডস রোগী পাওয়া যায়। এরপর থেকে যতই দিন যেতে থাকে, চারদিক থেকে ততই এইডস রোগী ধরা পড়ার খবর আসতে থাকে।
শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের মতো কিছু দেশেই শুধু এইডস-এর সন্ধান পাওয়া গেলেও এখন পৃথিবীর এমন কোনো দেশ নেই- যেখানে এইচআইভি/এইডসের রোগী নেই। এর থেকে এইডস বিস্তারের ভয়াবহতা সম্পর্কে আমরা ধারণা পেতে পারি। আফ্রিকার দেশসমূহে এইডস মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে বতসোয়ানা (৪০% এর বেশি প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ এইডস রোগী), দক্ষিণ আফ্রিকার (পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি এইডস রোগীর দেশও জিম্বাবুয়ে)। এখনকার শিশু-কিশোরদের মধ্যে এইডস মহামারী আকারে দেখা দিয়েছে। সাহারার দেশসমূহের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০% এইডস রোগী। হু হু করে বাড়ছে এইডস রোগী। বাংলাদেশেও নতুন নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছে। পৃথিবীর সবদেশেই মেয়েরা এইডসের বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছে। মহিলা যৌন সঙ্গী এইডস আক্রান্ত হলে পুরুষ সঙ্গীর এইডস হওয়ার সম্ভাবনা যতটা, পুরুষ যৌন সঙ্গীর এইডস হলে মহিলা সঙ্গী আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি। বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া যেসব মেয়ে বাইরে থেকে এইচআইভি শরীর নিয়ে দেশে ফিরছে তারাও ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশে ১৯৮৯ সালে একজন বিদেশির রক্তে প্রথম এইচআইভি শনাক্ত করা হয়। তারপর থেকে খুবই ধীরগতিতে এ ব্যাপারে কাজ চলছে। ২০০৩ সালে ৩৬৩ জন লোকের দেহে এইচআইভি পাওয়া গেছে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এদের ভেতর পুরুষের সংখ্যা মহিলাদের চেয়ে ছয়গুণ এবং ১১৫ জন নতুন রোগী। ২০০৯ সালে বাংলাদেশে ১০৯ জন এইচআইভি/এইডস এ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। আর এ বছর সরকার বাংলাদেশে ১৩ হাজার এইডস রোগী আছে বলে তথ্য প্রকাশ করেছে। যদিও এনজিও কেয়ার সরকারের এরূপ তথ্যের সঙ্গে একমত পোষণ করছে না। বাংলাদেশে আরও বেশি সংখ্যায়, আরও ভয়ঙ্করভাবে এইডস বিরাজমান বলে তাদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এইডস রোগীদের অনেকে সামাজিক ও ধর্মীয় সমস্যার কারণে প্রকাশ্যে কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাচ্ছে না। গোপনে লুকিয়ে লুকিয়ে অনেকে চিকিৎসা নিচ্ছে। সরকার আগের একটি স্বীকৃত এইচআইভি পরীক্ষাগারের সঙ্গে ২ বছরে আরও ৪টিকে যুক্ত করেছে। সরকারের উপাত্তসমূহ এসব প্রতিষ্ঠান থেকেই পাওয়া। কিন্তু বাস্তবে আরও বেশকিছু ল্যাবরেটরি বা প্রতিষ্ঠানে এইচআইভি-এর পরীক্ষা ও চিকিৎসা হচ্ছে। যে দেশে এখনো প্রতি বছর অনেক শিশু ডায়রিয়া বা নিউমোনিয়ায় মারা যায়; উত্তরাঞ্চলীয় জেলাসমূহে বেশকিছু লোক না খেতে পেয়ে মারা যায়; তাদের পক্ষে এইডসের মতো বিধ্বস্ত ও ব্যাপক মহামারী সামলানো অসম্ভব। তাই এ ব্যাপারে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরির মাধ্যমে জনগণকে স্বাস্থ্য সমসা সমাধানে অংশগ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি শ্রমিক, ছাত্র বা ভ্রমণকারী হিসেবে বিদেশে যাচ্ছে। আমাদের সমুদ্রবন্দর এলাকায় অহরহ বিদেশি নাবিক বা নাগরিকরা আসছে এবং যৌন পল্লীর অতিথি হচ্ছে। এরা যে কেউ যদি এইচআইভি বহন করে নিয়ে এসে থাকে তবে তা বহুসংখ্যক লোককে এইডসের হুমকিতে ফেলবে। এইডস আক্রান্ত মায়ের প্লাসেন্টা বা ফুল, প্রজনন নালা বা স্তন্য পানের মাধ্যমে নবজাতকও এইডসে আক্রান্ত হবে। শুধু তাই নয়, এ নবজাতক আরও বহু লোকের এইডসের কারণ হতে পারে পরবর্তীতে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও মিয়ানমারে ব্যাপক সংখ্যায় এইডস রোগী আছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো, আমাদের দেশেও এইচআইভি সংক্রমণের অন্যতম পদ্ধতি হলো শিরায় জীবাণু আক্রান্ত সিরিঞ্জের সাহায্য মাদকদ্রব্য গ্রহণ। এছাড়াও এইচআইভি আছে এমন রক্ত ও রক্ত উপাদান গ্রহণ। দেশের প্রতিটি রক্ত দান কেন্দ্রেই এইচআইভি জীবাণুটির স্কিনিং পরীক্ষা করার পরিকল্পনা আছে। কোনো রাগীকে যদি রক্ত সরবরাহ করার আগে রক্তদাতার রক্তের পরীক্ষা করা যায় তবে হেপাটাইটিস বি বা হেপাটাইটিস সি-এর মতো এইডস সংক্রমণের হার কমানো সম্ভব হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বড় কয়েকটা স্বাস্থ্য কেন্দ্র বাদে বাকিগুলোর মান নিয়ে সন্দেহ আছে। এইডসের জীবাণু এইচআইভি সাধারণত যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে ছড়ায়। তবে আক্রান্ত লোকের দেহের যে কোনো নিঃস্বরণের মাধ্যমেই এটি ছড়াতে পারে। অনেক শিশু মায়ের পেট থেকেই জীবাণু নিয়ে আসে। স্বাস্থ্যকর্মীরা এইডস রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়েও কোনো কোনো ক্ষেত্রে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে এ সম্ভাবনা হেপাটাইটিস বি ও হেপাটাইটিস সি’র বেলায় আরও বেশি।
এইচআইভি আক্রান্ত লোকের দেহে জীবাণু প্রবেশের ২-৪ সপ্তাহের মধ্যে লক্ষণ দেখা দেয়। প্রথমত জ্বর, বুকে বা পিঠে লালচে দানা, দুর্বলতা, গলার লসিকা গ্রন্থি ফুলে যাওয়া, মাথা ব্যথা, মাংসপেশি ব্যথা, অক্ষিকোটরের পেছনে ব্যথা, গাঁটে গাঁটে ব্যথা ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে যৌনাঙ্গে ঘা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়। ৪-৮ সপ্তাহের মধ্যে এ অবস্থা চরম আকার ধারণ করে। তারপর ধীরে ধীরে লক্ষণসমূহ দূর হতে থাকে। রোগী বা ঘনিষ্ঠজনরা ভাবতে থাকেন রোগ বুঝি সেরে গেল। এ অবস্থা ৮-১০ বছর বা ১২ বছর চলতে পারে। এর মাঝে শুধুমাত্র লসিকা গ্রন্থি ফুলে বা দুই-একটা সুযোগ সন্ধানী জীবাণুর সংক্রমণ হতে পারে যা চিকিৎসায় সারে। তারপর কারোর ক্ষেত্রে জীবাণুর সংক্রমণ ঘন ঘন হতে থাকে বা সারা শরীরের লসিকা গ্রন্থি ফুলে উঠতে থাকে। কেউ কেউ আপাতত সুস্থ থাকতে পারেন। কিন্তু মারাত্মক উপসর্গ দেখা দিতে থাকলে তারপর? এ সময় দীর্ঘদিনের জ্বর, অনেক দিন স্থায়ী ডায়রিয়া, স্নায়ুবিক সমস্যা ও স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়। টিবি, ফাঙ্গাস সংক্রমণ (বিশেষ করে মূত্র, স্ত্রীজনন নালী, ত্বক ইত্যাদিতে), নিউমোনিয়া, ইত্যাদি সংক্রমণ খুব ঘন ঘন হতে থাকবে। এইডস-এর তেমন কোনো কার্যকরী চিকিৎসা এখন শুরু হয়ে উঠেনি। কিন্তু ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে। এতে সামান্য কাজ হয়। তাই জীবাণুর সংক্রমণ প্রতিরোধ করাই সবচেয়ে ভালো। আবার ফলপ্রসূ কোনো টিকা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তাই ব্যক্তিগত ও সামাজিক সচেতনতার মাধ্যমে জীবাণুর বিস্তার প্রতিরোধ সম্ভব।
ডা. শাহজাদা সেলিম, বারডেম একাডেমী, শাহবাগ, ঢাকা