তুই একটা বান্দর বা বানব। ছোটবেলায় এই গালি মা-বাবা, ভাই-বোন বা বড়দের কাছ থেকে খাননি এমন কাউকে পাওয়া যাবে বলে আমার মনে হয় না। মানুষ আর বানরের মধ্যে প্রধান দৃশ্যমান পার্থক্য হলো বানরের লেজ আছে আর মানুষের লেজ নেই। মানুষের কেন লেজ নেই এনিয়ে সমাজে অনেক তর্ক বিতর্ক আছে। লেজ না থাকার ধর্মীয় ব্যাখ্যাও আছে। এই লেখা ধর্মীয় না মানুষের লেজ না থাকার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নিয়ে।
কমবেশি আপনারা সবাই বিবর্তন শব্দটির সাথে পরিচিত। বিবর্তনবাদ নিয়ে যারা গবেষণা বা কাজ করেন, তাদের মতে বানরের মতো প্রাণী ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে এগিয়ে গিয়ে লম্বা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। আর এই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া জীবই হলাম আমরা, মানবজাতি। বিবর্তনবাদীদের মতে আমাদের পূর্বপুরুষদের তো একটি করে লেজ ছিল। যাকিনা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হয়েছে। হাফ বিলিয়ন বছরেরও বেশি সময় ধরে লেজ বেশিরভাগ মেরুদণ্ডী প্রাণীর বৈশিষ্ট্য ছিল। উল্লেখ্য, বেশিরভাগ মেরুদণ্ডী প্রাণীর জন্য লেজ গতিবিধি (Locomotions) নির্নয় করতে সাহায্য করে – মাছ এবং তিমি যেমন এর সাহায্যেই প্রতিরক্ষা করে। কারো কারো মতে, আমাদের পূর্বপুরুষরা গাছ থেকে মাটিতে নামার কারণে লেজ হারিয়েছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, লেজের অবশেষ অংশ মানুষের মধ্যে থেকে গিয়েছে। মেরুদণ্ডের গোড়ায় একটি হাড় রয়েছে, যাকে বলা হয় কোকিক্স বা টেইলবোন। লেজের অবশিষ্টাংশ থেকে গঠিত হয় এই হাড়টি। কিন্তু মানুষের নেজ না থাকার আসল কারণ কী এবং লেজবিহীন অবস্থার পিছনে জেনেটিক প্রক্রিয়া কী হতে পারে। এই অজানা বিষয়টির বৈজ্ঞানিক কারন জানার জন্য আমাদের সহকর্মি নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি ল্যাঙ্গোন হেলথের জিনতত্ত্ববিদ এবং সিস্টেম বায়োলজিস্ট ইতাই ইয়ানাই-এর নেতৃত্বে একদল গবেষক কাজ শুরু করেন। গবেষকরা বানর এবং মানুষ বা বনমানুষদের ডিএনএ তুলনা করে দেখেছেন। বানর- যাদের লেজ রয়েছে এবং মানুষ এবং বনমানুষ- যাদের লেজ নেই তাদের ডিএনএ-তে কোন জিনগত পার্থক্য আছে কিনা। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি সহকর্মি বিজ্ঞানীরা টিবিএক্সটি (TBXT) নামক একটি জিনে মিউটেশন খুঁজে পেয়েছেন যা মানুষ এবং বনমানুষের মধ্যে আছে কিন্তু বানরের মধ্যে নেই। এই জেনেটিক মিউটেশনের প্রভাব পরীক্ষা করার জন্য, গবেষকরা ল্যাবরেটরিতে ইঁদুরের শরীরে টিবিএক্সটি (TBXT) নন-মিউটেটেড (পূর্ণ-দৈর্ঘ্যের জিন) এবং মিউটেটেড (পরিবর্তিত জিন) জিন অন্তর্ভুক্ত করেন।
সেখানেই দেখা যায় যে, টিবিএক্সটি (TBXT) মিউটেটেড (পরিবর্তিত জিন) জিনের ইঁদুরগুলো তাদের লেজ সম্পূর্ণ হারিয়েছে, বা কিছু ইঁদুরের খুব ছোট লেজ দেখা গেছে যা কিনা মানুষের কোকিক্স বা টেইলবোনের মত, আর কিছু ইঁদুর মারা গেছে। গবেষকরা আরো দেখতে পেয়েছেন যে, টিবিএক্সটি (TBXT) মিউটেটেড (পরিবর্তিত জিন) জিনের ইঁদুরগুলো নিউরাল টিউব ত্রুটিতে (Neural Tuble Defects) ভুগছিল। নিউরাল টিউব ত্রুটি একটি ধরনে জন্মগত সমস্যা। এটা এমন একটি অবস্থা যা ১০০০ নবজাতক মানুষের মধ্যে প্রায় ১ জনকে প্রভাবিত করে।
নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি ল্যাঙ্গোন হেলথ সহকর্মি গবেষকরা ইতাই ইয়ানাই-এর নেতৃত্বে মানুষের লেজ না থাকার জেনেটিক কারন বিখ্যাত জার্নাল নেচারে (Nature) প্রকাশ করে সারা দুনিয়া জুড়ে হইচই ফেলে দিয়েছেন। ইতাই ইয়ানাই এ প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, ‘আমরা এটা দেখে অবাক হয়েছি যে কীভাবে এত বড় শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন (লেজ হারিয়ে যাওয়া) এত ছোট জেনেটিক পরিবর্তনের কারণে হতে পারে। ইতাই ইয়ানাই আরো বলেন, ‘আপনি গাছে বাস করলে একটি লেজ খুবই সুবিধাজনক। একবার যদি মাটিতে নেমে আসেন, তাহলে লেজটির আর বেশি কাজ থাকে না। গবেষক বো জিয়া মনে করেন, লেজ নেই বলেই মানুষ ভারসাম্য বজায় রেখে দু’পায়ে হাঁটতে পারছে। গবেষকদের মতে, প্রায় ২৫ মিলিয়ন বছর আগে টিবিএক্সটি (TBXT) জিন মিউটেশনটি লেজের ক্ষতি করেছিল। আর আমাদের প্রজাতি (হোমো সেপিয়েন্স – মানুষ) প্রায় ৩০০,০০০ বছর আগে আবির্ভূত হয়েছিল। টিবিএক্সটি (TBXT) জিনে মিউটেশনের জন্য আর কি কি হতে পারে তা জানার জন্য পরের ধাপের গবেষণার ফল প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষায় থাকতে হবে।
লেখক : ড. জাহিদ দেওয়ান শামীম
সিনিয়র সাইন্টিষ্ট, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি