স্কুলে যাওয়ার সময় মাকে না বলে আলমারিতে রাখা ৫০০ টাকা নিয়ে স্কুলে গিয়েছিল জুলিয়া (ছদ্মনাম) নামের আট বছরের এক শিক্ষার্থী। দোকান থেকে ছোট এক বোতল কোকা-কোলা ও এক প্যাকেট চিপস কিনে বাড়ি আসার পথে বাকি টাকা হারিয়ে ফেলে। জানতে পেরে বিষয়টি নিয়ে তার মা বকাবকি করে। এর জের ধরে জুলিয়া জেদ করে স্কুলড্রেস পরা অবস্থায় ঘরের আঁড়ার সঙ্গে গলায় ফাঁস দেয়। পরে তাকে উদ্ধার করে শহরের খানপুর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
জুলিয়ার বাবা জুলহাস (ছদ্মনাম) জানান, তার মেয়ে চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। সমিতির জন্য জমানো টাকা রাখা ছিল আলমিরায়। সেটা নিয়ে হারিয়ে ফেলার কারণে ওর মা একটু বকা দেয়। কিন্তু মেয়ে এমন কিছু করে বসবে তা কেউ কল্পনাও করেনি।
সাত বছর বয়সী রাব্বী হোসেন (ছদ্মনাম) যশোরের বাতেন ইসলামের (ছদ্মনাম) ছেলে। সে স্থানীয় একটি হাফিজিয়া মাদরাসার ছাত্র। অন্যদিনের মতোই ১৯ জুলাই সকালে রাব্বীকে নিয়ে ভাত খেতে বসেছিলেন বাতেন। খাওয়ার এক পর্যায়ে টেবিলে থাকা তিন টুকরো মাংসের দুইটা ছেলের প্লেটে তুলে দিয়ে নিজে এক টুকরো নেন। কিন্তু রাব্বী তা মানছিল না। তাই তার রাগ হয়েছিল। আর এই রাগ থেকেই আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নেয় শিশু রাব্বী।
কথা হচ্ছিল শিশু রাব্বীর বাবা বাতেন ইসলামের সঙ্গে। এই প্রতিবেদককে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘ওকে বললাম, ফ্রিজে মাংস আছে- তোমার মা রান্না করে দেবে দুপুরে। সে তাতে রাগ করছিল। আমি খাওয়া শেষে হাত ধুয়ে টয়লেটে যাই এবং বের হয়ে দেখি ছেলে খাওয়ার টেবিলে নেই। তখন ডেকে সাড়া পাইনি। পরে ঘরের জানালা দিয়ে দেখি মশারির দড়ি গলায় পেঁচিয়ে ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। এ অবস্থা দেখে আমি চিৎকার দিই। চিৎকার শুনে পাশের বাড়ির নূরনবী নামে এক কিশোর এসে ভেন্টিলেটর দিয়ে উঠে ঘরের দরজা খুলে দেয়। কিন্তু ততক্ষণে ছেলে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। আর কোনো সাড়া পাইনি।’
এ সময় তার সহধর্মিনী নার্গিস বেগম (ছদ্মনাম) জানান, ‘ছেলে আমার খুব রাগী ছিল। কিন্তু এভাবে কিছু একটা করে বসবে এমনটা কখনো ভাবিনি।’ এই বয়সে বাপ্পী কীভাবে আত্মহত্যার বিষয়ে জানে? বাসায় কি এমন কিছু নিয়ে আলোচনা করা হতো ওর সামনে? জবাবে বাতেন কিছু জানাতে না পারলেও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিশুদের মাঝে রাব্বীর আত্মহত্যার ঘটনাই প্রথম নয়। এই উপজেলায় একাধিক শিশুর আত্মহত্যার ঘটনা রয়েছে!
২০২০ সালের ২৭ নভেম্বর যশোরের একই উপজেলায় আত্মহত্যা করে ১২ বছর বয়সী জাকির হোসেন (ছদ্মনাম)। প্রায় কাছাকাছি আরেকটি এলাকায় গত ২ আগস্ট ১৪ বছর বয়সী রাজনীন (ছদ্মনাম) আত্মহত্যা করে। এসব ঘটনা নিয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নূরই আলম সিদ্দিকীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।
কেনো একটি উপজেলায় বারবার শিশুদের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে?- এমন প্রশ্নের জবাবে নূরই আলম সিদ্দিকী বলেন, ‘আমার আগে যিনি ছিলেন থানার দায়িত্বে তখনও এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কেন বার বার হচ্ছে তা বুঝতে পারছি না। এখন তো বাচ্চারা মোবাইলকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। সবাই সুপার ফার্স্ট। আর তাই খবরও জেনে যায় আগে।’
তবে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একই এলাকায় একাধিক ঘটনা ঘটলেও এ বিষয়ে সরকারি বা বেসরকারিভাবে কোনো সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড দেখা যায়নি। সবাই স্কুল শিক্ষার্থী হলেও কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা ক্যাম্পেইনও দেখা যায়নি।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ডা. সিফাত ই সাঈদ বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী, ১৮ বছর পর্যন্ত যাদের বয়স তাদের শিশু বলা হয়ে থাকে। এই শিশুদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়লে সেটা সমাজের জন্য অবশ্যই এলার্মিং বিষয়। এর জন্য অনেকগুলো কারণ কাজ করে। তবে অন্যতম কারণ হচ্ছে- এইসব শিশুদের স্ট্রেস হ্যান্ডেলের ক্ষমতা খুবই কম।’
তিনি বলেন, ‘একই ঘটনা যদি কোনো নির্দিষ্ট এলাকা বা উপজেলা বা ইউনিয়ন বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঘটে থাকে তবে সেটাকে উপেক্ষা করার কোনো উপায় নেই। শিশুদের আত্মহত্যা প্রতিরোধে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটানো প্রয়োজন। এক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে অভিভাবকদেরও এগিয়ে আসতে হবে।’
গেল বছরের ১৪ মে খুলনা বিভাগে মায়ের সঙ্গে অভিমান করে ১০ বছরের সুলতানা (ছদ্মনাম) নামে এক শিশু। স্কুলের টিফিনে মাংস না দেওয়ার কারণে সে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। স্থানীয় একটি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী সুলতানা তার মায়ের কাছে স্কুলের টিফিনে গরুর মাংস দেওয়ার আবদার জানান।
মাংস না দেওয়ার কারণেই কি তবে আত্মহত্যা?- এমন প্রশ্নের উত্তরে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মনোরোগ চিকিৎসক ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘শিশুটির ঘাত সহনশীলতা বা রেজিলিয়েন্সি কম- এমনটা আমরা এক্ষেত্রে বলতে পারি। প্লেটে খাবারের টুকরা বা মাংসের টুকরা পায়নি এটা আসলে তেমন বেশি গুরুত্বপূর্ণ না। শিশুটির যেকোনো বিষয়ে সক্ষমতা ও তার আবেগীয় দক্ষতা অনেক কম ছিল। এটা গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। এটা কেন কম? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে তার প্যারেন্টাল ফরমেশন কেমন ছিল বা তার বাবা-মার ভূমিকা কতটুকু ছিল সেগুলো জানা প্রয়োজন। একইভাবে শিশুটির বেড়ে ওঠার জায়গাটা কতটুকু ছিল- এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
তিনি বলেন, ‘এই স্পেসিফিক শিশুটির ক্ষেত্রে আসলে খাবার বা মাংসের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অন্য একটি বিষয়। অন্য কোনো ক্ষেত্রেও শিশুটি যদি রিজেকশন বা কোনো কিছু না পাওয়ার জন্য অভিমান করে তার নেগেটিভ ইমোশনকে অ্যাবজর্ভ করার ক্ষমতা না থাকে তবে সেটা কিন্তু মার্ক করার মতোই একটা বিষয়। গাড়ির মতো মানুষেরও কিন্তু আবেগের জায়গায় শক অ্যাবজর্ভার থাকে। এই শক অ্যাবজর্ভারের জায়গাটি যখন আমরা যথেষ্ট পরিমাণে গঠন করতে পারি না, তখন মানুষ কিন্তু তার আবেগকে প্রকাশ করতে বা জায়গাগুলোকে সামাল দিতে পারে না। তখন নানা ধরণের জটিলতা হয়। শিশুটির ক্ষেত্রে কিন্তু তাই হয়েছে।’
ডা. হেলাল বলেন, ‘তার এলাকায় এমন ঘটনা ঘটার বিষয়টাও গুরুত্বপূর্ণ। এটাকে আমরা বলে থাকি অবজারভেশনাল লার্নিং, বা দেখে শেখা। এই ধরনের শেখা থেকেও শিশুদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়তে পারে।’ ডা. হেলালের এই বক্তব্যের সঙ্গে অবশ্য মিলে যায় শিশুদের আত্মহননের একাধিক ঘটনার বাস্তবতাও।
সরেজমিনে বিভিন্ন আত্মহননের ঘটনার খোঁজ নিয়ে পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুধুমাত্র মাংস না দেওয়া বা শাসনের কারণে নয়, বরং যখনই শিশুদের মানসিকতার বিরুদ্ধে কোনো সিদ্ধান্ত গেছে বলে মনে হয়েছে তাদের, সেখানেই আত্মহননের চেষ্টা করেছে তারা।
২০২১ সালের ২৪ নভেম্বর বরগুনায় আত্মহত্যা করে ১২ বছরের রাবেয়া (ছদ্মনাম)। তার মা ঝর্না বেগম (ছদ্মনাম) ২০ নভেম্বর ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার পর থেকেই শিশু রাবেয়া মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। এরপরের দুই/তিনদিন প্রায় পুরো সময় একা একা ঘরের মধ্যে বসে থাকত। ২৪ নভেম্বর ঘরে কেউ ছিল না। আর সেটার সুযোগ নিয়ে রাবেয়া ঘরের আঁড়ায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে।
২০২২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি মোবাইলে ভিডিও গেম খেলতে না দেওয়ায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার একটি উপজেলা এলাকায় মায়ের ওপর অভিমান করে আত্মহত্যা করে রাজীব (ছদ্মনাম) নামে আট বছরের এক শিশু। ২০২২ সালের ২৯ জুলাই লক্ষ্মীপুর জেলায় টিকটক মডেলের মতো আত্মহত্যার অভিনয় করতে না দেওয়ায় পৃথিবী ছেড়ে যায় ৮ বছরের শিশু তমাল হোসেন (ছদ্মনাম)।
তমালের মা সুমি আক্তার (ছদ্মনাম) বলেন, ‘আমার মোবাইলে টিকটকে একটি মেয়ের আত্মহত্যার অভিনয় দেখে তমাল। সেও ওই মেয়ের মতো টিকটকে আত্মহত্যার অভিনয় করলেও মারা যাবে না বলে জানায় আমাকে। সেজন্য আমার কাছে বারবার মোবাইল চাইছিল। কিন্তু তাকে সেটা আমি দিইনি।’
তিনি বলেন, ‘ছেলেকে মোবাইল না দিয়ে ঘরে তালা মেরে পুকুরে গোসল করতে যাই। গোসল থেকে ফিরে দরজার তালা খুলতেই দেখি সেটা ভেতর থেকে বন্ধ। এলাকার মানুষদের ডাক দিলে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে দেখি তমাল ঝুলতেছে। হাসপাতালে নিয়েও আর কোনো লাভ হয় নাই।’
গত ২২ আগস্ট যশোরে বান্ধবীর বিয়েতে যেতে না দেওয়ার কারণে মায়ের ওড়না গলায় পেচিঁয়ে আত্মহত্যা করে ১০ বছর বয়সী তসলিয়া আক্তার (ছদ্মনাম)। ১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর একটি এলাকায় আত্মহত্যা করে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী সুমি আক্তার ঝর্না (ছদ্মনাম)। ১২ বছর বয়সী এই শিক্ষার্থী কেনো আত্মহত্যা করে জানতে চাইলে তার মা সালমা বেগম (ছদ্মনাম) বলেন, ‘আমি চার দিন ধরে আমার মায়ের বাসায় ছিলাম। আমি জানতে পারি, গত রাতে ওর দাদি জাহানারা বেগম পড়াশোনা নিয়ে বকাঝকা করলে ঝর্না অভিমান করে দাদিকে কোনো উত্তর দেয়নি। পরে দাদি তাকে বলে, তুই মরিস না কেন। আল্লাহ তোর মৃত্যু দেয়নি।’
তিনি বলেন, ‘এরপরেই আমার মেয়ে রাগান্বিত হয়ে বাসায় থাকা কীটনাশক খেয়ে ফেলে। এতে সে অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রথমে স্থানীয় একটি হাসপাতাল নিয়ে যাই। পরে অবস্থার অবনতি হলে তাকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত বলে জানান।’
এ বিষয়ে ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘শিশুদের মানসিক বিকাশকে গুরুত্ব দিতে হবে। তাদের মন ও মননের বিকাশকে গুরুত্ব দিতে হবে। একজন শিশুর জন্মের পর থেকে তার বেড়ে ওঠা বা বিকাশ, তার প্যারেন্টিং, আবেগীয় বিকাশের ডেভেলপমেন্ট খুবই জরুরি। শিশু দেখে শিখে। ফলে তার চারপাশে ভার্চুয়াল ও একচুয়েল লাইফে সে যা দেখে তাই অনুকরণ করার চেষ্টা করে। ফলে শিশুর বিকাশের ক্ষেত্রে যদি তার ভার্চুয়াল ও একচুয়েল লাইফকে গুরুত্ব দেওয়া না হয় তবে তা ভুল হবে। এক্ষেত্রে কোনো শিশুর সামনে ক্রাইম পেট্রোল, বীভৎস কিছু সিনেমার দৃশ্য দেখানো হয় তবে তার আগে পরিবারকে বুঝতে হবে সন্তানের আবেগের বিকাশ কতটুকু হয়েছে। এক্ষেত্রে পারিবারিক রীতি বা শিক্ষা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এগুলো গুরুত্ব না দিলে শিশুদের আত্মহত্যা প্রবণতা বাড়তেই পারে।’
সমীক্ষা কী বলছে?
বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রকাশিত এক সমীক্ষার ফলাফলে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে সারা দেশে ৩৬১ জন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। তাদের মধ্যে স্কুলগামী মেয়েদের সংখ্যা বেশি। প্রতি মাসে গড়ে ৪৫ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। ২০২২ সালের একই সময়ে ৩৬৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছিল।
প্রতিষ্ঠানটির সমীক্ষায় আরও জানা যায়, আত্মহত্যাকারী ৩৬১ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৪৭ জন ছেলে এবং ২১৪ জন মেয়ে। এর মধ্যে ১৬৯ জন স্কুলশিক্ষার্থী, ৯৬ জন কলেজ, ৬৬ জন বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৩০ জন মাদ্রাসা শিক্ষার্থী।
দেশের ১০৫টি জাতীয়, স্থানীয় পত্রিকা এবং অনলাইন পোর্টাল থেকে আত্মহত্যার তথ্য সংগ্রহ করে সংস্থাটি।
সংস্থাটির সমীক্ষা অনুযায়ী, এ বছর ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এ বিভাগে আত্মহত্যার হার ৩১ দশমিক ৩০ শতাংশ। এছাড়া খুলনা বিভাগে ১৩ শতাংশ, চট্টগ্রামে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ, রংপুরে ৮ দশমিক ৯০ শতাংশ, ময়মনসিংহে ১০ শতাংশ, রাজশাহীতে ১১ দশমিক ৯০ শতাংশ, বরিশালে ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং সিলেটে ২ দশমিক ৫ শতাংশ আত্মহত্যা করেছে। আত্মহত্যার ক্ষেত্রে মেয়েরা সংখ্যায় বেশি। আত্মহত্যায় মেয়ে ও ছেলের অনুপাত ৫৯ দশমিক ৩০ শতাংশ ও ৪০ দশমিক ৭০ শতাংশ।
সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়, অভিমানে ২৬ দশমিক ৬০ শতাংশ, প্রেমঘটিত কারণে ১৮ দশমিক ৭০ শতাংশ, পড়াশোনার চাপ ও ব্যর্থতায় ১২ দশমিক ৬০ শতাংশ, পারিবারিক বিবাদে ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ, মানসিক ভারসাম্যহীনতায় ৮ দশমিক ৪০ শতাংশ এবং যৌন হয়রানিতে ৫ দশমিক ১০ শতাংশ মেয়ে আত্মহত্যা করে।
সমীক্ষা জানায়, সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছে স্কুল শিক্ষার্থী। আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে ৪৬ দশমিক ৮ শতাংশ স্কুলশিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে ১১২ জন মেয়ে এবং ৫৭ জন ছেলে। এছাড়া ২৬ দশমিক ৬০ শতাংশ কলেজ, ১৮ দশমিক ৩০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৮ দশমিক ৩১ শতাংশ মাদরাসার শিক্ষার্থী। ৩০ জন মাদরাসা শিক্ষার্থীর মধ্যে ৫৩ দশমিক ৩০ শতাংশ মেয়ে এবং ৪৬ দশমিক ৭০ শতাংশ ছেলে। মাদরাসার শিক্ষার্থীদের ৪০ শতাংশের আত্মহত্যার পেছনে কারণ অভিমান। আর ১৩ দশমিক ৩০ শতাংশ প্রেমঘটিত সম্পর্কে এবং ১০ শতাংশ যৌন নির্যাতনে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের মনোরোগ চিকিৎসক ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘২০২২ ও ২০২৩ সালে আত্মহত্যার সংখ্যাটি কাছাকাছি। অভিমান কিন্তু অনেকেই করে- সবাই আত্মহত্যা করে না। আবার অনেকে প্রেমে ব্যর্থ হয়- সবাই আত্মহত্যা করে না। একজন মানুষের ঘাত সহনশীলতার দিক আমাদের বিবেচনায় নেওয়া উচিত। পাশপাশি আমাদের উচিত শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে মনোযোগী হওয়া। এছাড়া শিক্ষকদেরও মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি দায়িত্বশীল হতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আত্মহত্যা প্রায় সব বয়সসীমাতেই বাড়ছে। তবে শিশুদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ার জন্য দু’টি বিষয় কাজ করছে। প্রথমত, তাদের যে আবেগের বিকাশ সেটি ঠিকমতো না হতে পারা। আঁচল ফাউন্ডেশনের রিপোর্টেও আত্মহত্যার মূল কারণ হিসেবে আবেগীয় সম্পর্কের বিষয়টি উল্লেখ করা আছে। এজন্য শিশুদের আবেগের বিকাশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে শৈশবে, পরিবারে ও স্কুলে এ বিষয়টাতে নজর দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।’
তিনি বলেন, ‘এক দিকে শিশুদের অন্তর্গত চাপ; যেখানে তাদের আবেগের বিকাশের ব্যাঘাত ঘটেছে, অন্যদিকে করোনাকালে সৃষ্টি হওয়া নানাধরণের চাপ শিশুদের মাঝে বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহননের প্রবণতা বাড়িয়েছে। আত্মহত্যা কখনো একটা কারণে হয় না। অনেকগুলো কারণ যখন একসঙ্গে হয় তখন আত্মহত্যার প্রবণতা সৃষ্টি হয়।’
এম আর খান শিশু হাসপাতালের ল্যাবরেটরি মেডিসিন বিভাগের প্রধান ও শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. ফরহাদ মনজুর বলেন, ‘শিশু-কিশোরদের মানসিক সমস্যা সমাধানে মূল ভূমিকা রাখতে পারে সাইকোলজিস্ট বা সাইকিয়াট্রিকরা। তারা স্কুল বেইজড কাউন্সেলিং করতে পারে। কিন্তু আলাদা আলাদাভাবে চেষ্টা করে খুব একটা বেশি ভালো ফল আসার সম্ভাবনা দেখি না। দেখা গেল, আমি আমার বাচ্চাকে কাউন্সেলিং করলাম। কিন্তু সে যখন আবার স্কুলে যাবে তখন সঙ্গীদের সঙ্গে মিশে আবার পুরনো অবস্থায় ফিরে যাবে। এজন্যেই স্কুলে যদি পরিকল্পনা নিয়ে কাউন্সেলিং করা যায় সেটাতে ভালো ফলাফল পাওয়া যেতে পারে।’
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘আত্মহত্যা ও আত্মহত্যার প্রচেষ্টা প্রতিরোধ বিষয়টিকে বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য অধিদফতরের ‘নিয়ন্ত্রিত অসংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কম্পোনেন্ট হিসেবে বিবেচনা করে।’
তিনি বলেন, ‘আগামী অর্থবছর থেকে বাস্তবায়নযোগ্য ৫ম এইচপিএনএসপি সেক্টর প্রোগ্রামের আওতায় সরকার এই প্রথমবারের মত একটি ডেডিকেটেড অপারেশনাল প্ল্যান ‘মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড ডিসএ্যাবিলিটি (এমএইচডি)’ অনুমোদন করতে যাচ্ছে। যেখানে আগামী ৫ বছরের মানসিক স্বাস্থ্যের অন্তর্ভুক্ত আত্মহত্যা ও এর প্রচেষ্টা প্রতিরোধে অত্যাধুনিক এবং বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থাপনা হাতে নেওয়া হচ্ছে। যার সুফল দেশবাসী অচিরেই উপভোগ করবেন।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র ও অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, ‘একজন চিকিৎসক হিসেবে আমার মনে হয়, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাকে এখনো গতানুগতিক স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে ধরা হচ্ছে না। আর তাই স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের বিষয়ে মানুষ বেশি আগ্রহী হয় না। তবে আমরা গবেষণা করছি। সেইসঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে জাতীয় কর্মকৌশল চূড়ান্ত হওয়ার পর সেগুলো আমরা উপজেলা পর্যায়েও পৌঁছে দিতে পারব বলে আশবাদী।’