আজ বিশ্ব শারীরিক সক্রিয়তা দিবস। শারীরিক সক্রিয়তার জন্য একটি বিশেষ দিন, যদিও স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য প্রতিদিনই আমাদের শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকা প্রয়োজন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০০২ সালে এ দিবসকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সেই থেকে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য হলো ‘Have a good time! be active!’-‘ভালো সময় কাটান! সক্রিয় থাকুন!’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, যারা শারীরিকভাবে বেশি সক্রিয়, তাদের মধ্যে মৃত্যুহার কম। নিয়মিত শারীরিক সক্রিয়তা হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, মেটাবলিক সিনড্রোম, কোলন ক্যানসার, স্তন ক্যানসার এবং বিষণ্নতার হার ও ঝুঁকি কমায়। শারীরিক সক্রিয়তা বা পরিশ্রমের আরও অনেক সুবিধা রয়েছে। অত্যধিক ওজন বৃদ্ধি ও স্থূলতা রোধ করার পাশাপাশি উদ্বেগ, চাপ বা বিষণ্নতার অনুভূতি হ্রাস করে এবং মানসিক অবস্থা ও সুস্থতার উন্নতিতে সহায়তা করে। শারীরিক সক্রিয়তার অন্যান্য সুবিধা হলো-এটি শক্তি বাড়ায়, ভালো ঘুম নিশ্চিত করে, হাড় ও হার্টের স্বাস্থ্য ভালো রাখে; চিন্তা ও স্মরণশক্তি এবং বিচারবোধ বাড়ায়, তরুণদের সুস্বাস্থ্য ও মানসিক বিকাশ নিশ্চিত করে।
এতসব উপকারিতা সত্ত্বেও বিশ্বের বহু মানুষই শারীরিকভাবে যথেষ্ট সক্রিয় নয়। প্রতি চারজনের মধ্যে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ শারীরিক সক্রিয়তার প্রস্তাবিত নির্দেশনাগুলো মেনে চলে না। বিশ্বে ১০ জনের মধ্যে আটজন কিশোর-কিশোরী শারীরিকভাবে পর্যাপ্ত পরিমাণে সক্রিয় নয়। সর্বশেষ জনসংখ্যাভিত্তিক জাতীয় সমীক্ষা (২০১৮) অনুসারে, বাংলাদেশে প্রতি আটজনের মধ্যে একজন (১২.৩ শতাংশ) প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ যথেষ্ট সক্রিয় নয় এবং পুরুষদের তুলনায় নারীরা কম সক্রিয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাংলাদেশ ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটি প্রোফাইল ২০২২ অনুসারে, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের মধ্যে ১৬ শতাংশ এবং প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের মধ্যে ৪০ শতাংশ, আর নিষ্ক্রিয়তার হার বয়স্কদের (৭০ বছর বা তার অধিক) মধ্যে সামান্য বেশি (পুরুষদের মধ্যে ১৯ শতাংশ এবং নারীদের মধ্যে ৪৬ শতাংশ)। অপর এক জনসংখ্যাভিত্তিক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন (৩৮.৪ শতাংশ) ৬২ বা তার বেশি বয়সি মানুষ যথেষ্ট সক্রিয় নয়। বাংলাদেশ স্কুলভিত্তিক স্টুডেন্ট হেলথ সার্ভে (২০১৪) অনুসারে, প্রতি পাঁচজনের মধ্যে তিনজন কিশোর-কিশোরী (৫৮.৬ শতাংশ) শারীরিকভাবে পর্যাপ্ত পরিমাণে সক্রিয় নয়। অপর একটি জনসংখ্যাভিত্তিক গবেষণায় দেখা যায়, প্রতি দুজনের মধ্যে একজন (৫০.৩ শতাংশ) কিশোরী শারীরিকভাবে পর্যাপ্ত পরিমাণে সক্রিয় নয়, আর কিশোরদের মধ্যে এর হার হচ্ছে ২৯ শতাংশ অর্থাৎ প্রতি ১০ জনের মধ্যে তিনজন শারীরিকভাবে সক্রিয় নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাংলাদেশ ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটি প্রোফাইল ২০২২ অনুসারে, প্রতি তিনজন কিশোর-কিশোরীর মধ্যে দুজন শারীরিকভাবে নিষ্ক্রিয় (ছেলেদের মধ্যে ৬৩ শতাংশ এবং মেয়েদের মধ্যে ৬৯ শতাংশ)।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, শারীরিক যে কোনো নড়াচড়া, যার জন্য শক্তিব্যয় প্রয়োজন হয়, তাকেই শারীরিক সক্রিয়তা হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে। প্রকৃতপক্ষে যে কোনো নড়াচড়াকে শারীরিক সক্রিয়তা বলা যায়, যদি তা আমাদের শরীরের পেশিগুলোকে আন্দোলিত করে এবং এর জন্য শরীরকে ক্যালোরি পোড়াতে হয়। এমনকি ঘরের কাজ করা, বাগান করা, বাচ্চাদের সঙ্গে খেলা করা এবং লিফটের পরিবর্তে সিঁড়ি ব্যবহারের মতো কাজগুলোও এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। শারীরিক সক্রিয়তার মাত্রা যত বাড়বে, স্বাস্থ্য ভালো রাখার সম্ভাবনাও তত বাড়বে। হাঁটা, খেলাধুলা, নাচ, দৌড়, যোগব্যায়াম, হাইকিং, সাইকেল চালানো, সাঁতার বা বাগান করা-এগুলো মানুষকে সুস্থ ও ভালো থাকতে সাহায্য করবে। ব্যায়াম ও খেলাধুলা হচ্ছে শারীরিক সক্রিয়তার দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
শারীরিক সক্রিয়তা মাঝারি ও জোরালো মাত্রার হতে পারে, যা বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সুবিধার সঙ্গে সম্পর্কিত। সক্রিয়তা মাঝারি নাকি জোরালো মাত্রার, তা হৃদস্পন্দনই নির্ধারণ করবে। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের মতে, মাঝারি মাত্রার সক্রিয়তা একজনের হৃদস্পন্দনের হার ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিতে পারে। আপনার শারীরিক সক্রিয়তা মাঝারি মাত্রার হচ্ছে কি না, তা আপনি নিজেই অনুধাবন করতে পারেন-আপনি দ্রুত শ্বাস নেবেন, কিন্তু শ্বাস ছাড়বেন না; প্রায় ১০ মিনিটের সক্রিয়তার পর আপনার একটু হালকা ঘাম বের হবে; আপনি একটি কথোপকথন চালিয়ে যেতে পারবেন, কিন্তু কোনো গান করতে পারবেন না। মাঝারি শারীরিক সক্রিয়তার উদাহরণ হতে পারে দ্রুত হাঁটা, মাঝারি গতিতে সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা, দ্বৈত টেনিস খেলা, দড়ি লাফানো ইত্যাদি। আর জোরালো মাত্রার সক্রিয়তা আপনার হৃৎস্পন্দনের হার ৭০ থেকে ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিতে পারে। জোরালো মাত্রার শারীরিক সক্রিয়তায় আপনার শ্বাস গভীর ও দ্রুত হবে; মাত্র কয়েক মিনিটের সক্রিয়তার পর আপনার ঘাম বের হবে; আপনি শ্বাসের জন্য বিরতি ছাড়া কয়েকটি শব্দের বেশি বলতে পারবেন না। জোরালো মাত্রার শারীরিক সক্রিয়তার উদাহরণ হতে পারে হাইকিং, দ্রুত জগিং, দ্রুত সাইকেল চালানো, বাস্কেটবল খেলা, ফুটবল খেলা, একক টেনিস খেলা। এছাড়া কম মাত্রার শারীরিক সক্রিয়তাও (যেমন ধীরে ধীরে হাঁটা, বাড়িতে টুকিটাকি কাজ করা, ঘর মোছা, রান্না করা, থালাবাসন ধোয়া) কিছু স্বাস্থ্য সুবিধা নিয়ে আসতে পারে। যে কোনো ধরনের শারীরিক সক্রিয়তাই সুফল বয়ে আনবে, যদি সেগুলো নিয়মিত ও পর্যাপ্ত মাত্রায় এবং সময় নিয়ে করা হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার শারীরিক সক্রিয়তা নির্দেশিকা অনুসারে, প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫০ মিনিটের মাঝারি মাত্রার অথবা কমপক্ষে ৭৫ মিনিটের জোরালো মাত্রার শারীরিক সক্রিয়তা করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ হিসাবে দিনে ৩০ মিনিটের মাঝারি থেকে জোরালো মাত্রার শারীরিক সক্রিয়তা করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আর ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সি শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রে দিনে এক ঘণ্টা মাঝারি থেকে জোরালো মাত্রার শারীরিক সক্রিয়তার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ৫ বছরের কম বয়সি শিশু, গর্ভবতী ও প্রসবোত্তর মহিলা, প্রতিবন্ধী শিশু, কিশোর, প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত মানুষের জন্য রয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভিন্ন নির্দেশনা।
আপনার শারীরিক দক্ষতা বা ফিটনেস বিবেচনা করে আপনি উপযুক্ত যে কোনো শারীরিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করতে পারেন, যা আপনাকে ভালো বোধ করতে এবং আরও ভালোভাবে জীবনযাপন করতে সাহায্য করবে। আপনার জন্য সঠিক শারীরিক সক্রিয়তা খুঁজে পেতে আপনি যা উপভোগ করেন তা-ই করুন, বিভিন্ন ধরনের সক্রিয়তায় অংশগ্রহণ করুন এবং সেগুলো নিয়মিতভাবে করার অভ্যাস গড়ে তুলুন। পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে শারীরিক সক্রিয়তা, খেলাধুলা বা ব্যায়াম করলে তা আরও উপভোগ্য হতে পারে এবং এটি আমাদের সবাইকে সুস্থ থাকার এবং ভালো সময় কাটানোর সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে পারে।
যেহেতু নিয়মিত শারীরিক সক্রিয়তা উন্নত শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের সহায়ক, তাই শারীরিক সক্রিয়তাকে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন এবং শারীরিকভাবে সক্রিয় হওয়ার প্রতিটি সুযোগ আমাদের সদ্ব্যবহার করা উচিত। আজই যদি আমরা শারীরিক সক্রিয়তা শুরু না করি, তাহলে কবে শুরু করব? আসুন আজই আমাদের সক্রিয় হওয়ার যাত্রা শুরু হোক। আর এটাই হোক আমাদের বিশ্ব শারীরিক সক্রিয়তা দিবসের অঙ্গীকার। সবাই শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকুন, সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন।
ড. আসাদুজ্জামান খান : সহযোগী অধ্যাপক, স্কুল অব হেলথ অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন সায়েন্সেস, কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ব্রিসবেন, অস্ট্রেলিয়া