চলতি বছরের জুনের শেষ থেকে করোনা মহামারির পাশাপাশি ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে শুরু করে রাজধানীতে। জুলাই-আগস্ট মাসে এই রোগ আরো ব্যাপক আকার ধারণ করে। অন্য বছরের তুলনায় এবছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুহার বেশি। তবে যেসব রোগী দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছেন, তারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
সোমবার (৬ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ড ঘুরে ও সেখানে থাকা চিকিৎসকদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দুটি করোনা ওয়ার্ড বর্তমানে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় ব্যবহার করা হচ্ছে। ১৮ থেকে ৮০ সব প্রাপ্তবয়স্ক ডেঙ্গু রোগীর সাপোর্টিভ চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে হাসপাতালটিতে। ভাইরাসবাহিত এই রোগের নিরাময়েও আগের চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগছে। তবে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করছেন চিকিৎসকরা। এসব রোগীদের ক্ষেত্রে দ্রুত অভ্যন্তরীণ অঙ্গহানি বা শকে চলে যাবার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান দায়িত্বরত চিকিৎসক।
ভাসানটেক থেকে আসা রুবিনা আক্তার বলছেন, ২-৩ আগে তার স্বামীর জ্বর শুরু হয়। একশো চার থেকে একশো পাঁচ ডিগ্রি জ্বর। পরে জ্বর ভালো হলেও শরীরে র্যাশ দেখা যায়। এরপর তারা নিজেরাই ডেঙ্গু পরীক্ষা করে ডেঙ্গু হয়েছে দেখতে পান। তারপর এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
মিরপুরের বাসিন্দা সাবরিনা ২ সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ডেঙ্গু আক্রান্ত। এই বছরেই দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন তিনি। প্লাটিলেট কমে নেমে গেছে ৫০ হাজারের নিচে। তবুও তিনি এবং তার স্বামী নজরুল ইসলাম আশা করছেন ডেঙ্গু মোকাবেলা করে সুস্থ হয়ে দেড় মাস বয়সী শিশু সন্তানের কাছে ফিরে যেতে পারবেন মা সাবরিনা।
সাবরিনার স্বামী নজরুল ইসলাম বলেন, গতকাল বিকেলে পরীক্ষার পর দেখলাম প্লাটিলেট ৬০ হাজারের বেশি। ডাক্তারও বললেন যে এই অবস্থা থাকলে আর ৩-৪ দিনের মধ্যেই রোগী সুস্থ হয়ে যাবেন। কিন্তু আজ সকালে আবার পরীক্ষায় দেখা যায় এক ধাক্কায় প্লাটিলেট ৪৪ হাজারে নেমে গেছে। এখন জরুরি ভিত্তিতে ৩ ব্যাগ রক্ত লাগবে।
সাবরিনার মত ডেঙ্গু ওয়ার্ডে থাকা শতাধিক রোগীর সবার গল্পই অনেকটা একই রকম। একটানা কয়েকদিন জ্বর, গায়ে ব্যথা, র্যাশ ওঠা, ক্ষুধামন্দা, মাথাব্যাথা, গলায় রক্ত চলে আসা ইত্যাদি নানা রকম ভয়াবহ উপসর্গ নিয়ে এবার হাসপাতালে আসছেন রোগীরা। ফলে রোগীদের সঠিক ও কার্যকর চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার ডা. সানজিদা আইরীন বলেন, প্রথমবার আক্রান্ত ডেঙ্গু রোগীর চেয়ে দ্বিতীয়বার আক্রান্তদের নিয়ে আমাদের বেশি সমস্যার সম্মুখিন হতে হচ্ছে। এদের ক্ষেত্রে প্লাজমা লিকেজ অর্থাৎ বুকে পেটে পানি জমে যাচ্ছে। সাধারণ রোগীদের ক্ষেত্রেও জ্বর কমতে সময় লাগছে অনেক বেশি। জ্বর কমে গেলেও ঝুঁকি কমছে না অনেকের। জ্বর সেরে যাবার পরে শকে চলে যাবার মত সমস্যাও পাচ্ছি আমরা।
ডেঙ্গুর এই ভয়াবহতার জন্য ডেঙ্গুর বহুরূপী ধরনকে দায়ী করছেন এই চিকিৎসক। সাবধান করে দিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, অনেকে মনে করতে পারেন ডেঙ্গু-৩ বা সেরোটাইপ-৩ নিয়ে আমরা বেশি কথা বলি বলে শুধুমাত্র এই ভ্যারিয়েন্টটিই হয়ত বিপজ্জনক। কিন্তু না। আগে যারা ডেঙ্গুর যে কোনো একটি ভ্যারিয়েন্টেও আক্রান্ত হয়েছিলেন, দ্বিতীয়বারের ক্ষেত্রে তাদের অবস্থা আরও মারাত্মক হতে পারে। এ বছর যারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের অনেকের দুর্লভ প্রকৃতির ডেঙ্গু হেমারেজিক ফিভার উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। এ ধরনের রোগীদের খুব দ্রুত চিকিৎসা দিতে না পারলে বাঁচানো সম্ভব হয় না।
ডেঙ্গুর এই ভয়াবহতার শেষ কোথায় জানতে চাইলে কীটতত্ত্ববিদ মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পেতে এডিসের লার্ভা ধ্বংস করত হবে। সে লক্ষ্যে ‘সমন্বিত মশক নিবারণ পদ্ধতি’ অনুসরন করতে হবে, যা আমরা ঠিকমত করছি না। এর বিকল্প পদ্ধতি আপাতত আমাদের হাতে নেই।
উল্লেখ্য, গত ২৪ ঘণ্টায় রাজধানীসহ সারাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে আরও ৩১৫ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে রাজধানীর হাসপাতালে ২৬২ জন ও ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ৫৩ জন রোগী ভর্তি হন।