দেশে প্রায় ৫০ লাখ শিশু কিডনি রোগে আক্রান্ত। কিডনি রোগ এখন মারাত্মক জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। পেডিয়াট্রিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এছাড়া বাংলাদেশ লিভার ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা গেছে, দেশে এক কোটির মতো মানুষ হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের সংক্রমণের শিকার। এক্ষেত্রেও শিশুরোগীর সংখ্যা বেশি।
বিশ্বব্যাপী বায়ুর মান পরীক্ষার জন্য পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, বিশ্বে দ্বিতীয় বায়ুদূষিত নগরী হচ্ছে ঢাকা। এ জন্যই ঢাকার শিশুদের শ্বাসতন্ত্রীয় রোগ দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশের মানুষের জন্য এখনও নিরাপদ সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তাই পানিবাহিত রোগবালাইও অধিকাংশ শিশুসহ নগরবাসীর নিত্যসঙ্গী।
শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) মিলনায়তনে ‘শিশু স্বাস্থ্যের ওপর পরিবেশের প্রভাব’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা জানান।
বক্তারা জানান, নদীমাতৃক বদ্বীপ বাংলাদেশের মানুষকে প্লাস্টিকের বোতলে পানি খেতে হয়। প্লাস্টিক হচ্ছে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী প্রথম আটটি উপাদানের একটি। তাছাড়া খাদ্যবস্তুর উৎপাদন, সংরক্ষণ, বিপননসহ প্রতিটি পর্যায়ে রাসায়নিক পদার্থের ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। রয়েছে ব্যাপক মাত্রায় ভেজালও।
এছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জেনেটিক্যালি মডিফাইড খাদ্যশস্য, টেস্টিং সল্ট ইত্যাদি নিষিদ্ধ। কিন্তু আমাদের দেশে এগুলো আরো উৎসাহিত করা হচ্ছে। এসব বিষয়ে আমরা এখনও চিন্তাহীনভাবে থাকলেও উন্নত বিশ্ব নিদ্রাহীন রয়েছে।
দূষণগুলো এবং এর ফলে সৃষ্ট জটিলতা সম্পর্কে বক্তারা বলেন, শিশুর বিকাশের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা পরিবেশ বলতে ভৌত পরিবেশ ও সামাজিক পরিবেশের নানা দিকের সমন্বয়ে গঠিত অবস্থাকেই বুঝিয়ে থাকেন। ভৌত পরিবেশের প্রধান দূষণগুলো হলো- বায়ুদূষণ, জলদূষণ, ভূমিদূষণ, শব্দদূষণ, আলোদূষণ, বিকীরণ, বৃক্ষনিধন, জলাধারদূষণ, খাদ্যদূষণ ইত্যাদি। এগুলোর প্রভাবে শিশুর স্বাস্থ্যে নানা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং নানা রকম রোগ সৃষ্টি হয়। যেমন: ডায়রিয়া ডেঙ্গু টাইপ থেকে শুরু করে লিভার, কিডনি, ফুসফুসসহ শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের যাবতীয় রোগ এবং ক্যান্সার জাতীয় রোগ মূলত ভৌত পরিবেশ দূষণের জন্য হয়ে থাকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আধুনিক মানুষের রোগের প্রায় ৫০ শতাংশকে মনোদৈহিক বলে আখ্যায়িত করেছে। একটি শিশুর পারিবারিক পরিবেশ শিশুটির পুষ্টি, সংক্রামক রোগ ইত্যাদির সঙ্গে যেমনি জড়িত, তেমনি শিশুটির নীতিবোধ, দায়িত্বশীলতা, নিজেকে সংযত রাখা, সময়ানুবর্তিতা, আবেগের ভারসাম্য ইত্যাদির সঙ্গেও প্রবলভাবে যুক্ত।
বিদ্যালয়ের পরিবেশে শিশুর সামাজিকীকরণ ঘটে। খেলাধুলার মাধ্যমে সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব গড়ে ওঠে। তাই আমাদের জনপদে পর্যাপ্ত গাছ, জলাধার, খেলারমাঠ, বিনোদন কেন্দ্র রাখতে হবে। ব্যবস্থা করতে হবে সামাজিক উৎসবের। যেগুলো শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য অপরিহার্য।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার বেশিরভাগ স্থানে শব্দ যে মাত্রায় হওয়া উচিত, তার চেয়ে দুই-তিন গুণ বেশি হচ্ছে। অন্যদিকে আলোদূষণ সম্পর্কে অধিকাংশ নাগরিকেরই সামান্য ধারণাও নেই বললেই চলে। নগর ও জনপদে বসবাসকারী বেশিরভাগ মানুষ তার চারপাশকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার বিষয়টিকে ভাবনালোকেও ধারণ করে না। যার প্রমাণ আমরা পেয়েছি সম্প্রতি ডেঙ্গুজ্বরের প্রাদুর্ভাব দেখে।
এছাড়া শিশুর বিকাশের জন্য খেলাধুলা কিংবা মানসিক বিকাশের জন্য প্রকৃতির সাহচর্যে থাকার অভাবে শিশুরা গ্যাং কালচার কিংবা নেশার জগতে ডুবে যাচ্ছে। এসব থেকে দ্রুত পরিত্রাণ পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
এসময় শিশুস্বাস্থ্য রক্ষার্থে বিভিন্ন সুপারিশ তুলে ধরেন বক্তারা। সেগুলো হলো- সামগ্রিকভাবে পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে অতি জরুরি ভিত্তিতে একটি ক্রাশ প্রোগ্রাম গ্রহণ করা, একই সঙ্গে একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন করে সেটিকে কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর করা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে খেলার মাঠ থাকা বাধ্যতামূলক করা এবং প্রতিদিন কমপক্ষে এক ঘণ্টা খেলার ক্লাস করতে হবে। একই সঙ্গে দখল হওয়া মাঠ, পার্ক, নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর উদ্ধারে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া, ‘সবার আগে শিশু’ এই নীতিকে মূলমন্ত্র করে শিশু বিকাশের কাজ শুরু করা, শিশুর বিকাশবিরোধী কিছু যাতে সংগঠিত না হয়, সেজন্য একটি শিশু কমিশন গঠন করা।
পবার সভাপতি আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন- পবার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. লেলিন চৌধুরী, ডক্টরস ফর হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের সভাপতি অধ্যাপক ডা. আবু সাঈদ, কেন্দ্রীয় খেলাঘরের সাধারণ সম্পাদক রুনু আলী, পবার সাধারণ সম্পাদক আবদুস সোবহান, খেলাঘরের লাভলী চৌধুরী প্রমুখ।