মোহাম্মদ লুৎফর রহমানের কাঁধে চেপেছিল নিজের বাবাকে হত্যা করার ভার। তখন তিনি নকশাল আন্দোলন ছেড়ে চলে আসেন। খালি পকেটে ঢাকায় এসে একটি ফার্মেসিতে কাজ শুরু করেন। এরপর ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেন লাজ ফার্মা। ১৯৯২ সালে চলে যান কানাডায়। বর্তমানে তিনি লাজ ফার্মার চারটি শাখার মালিক। সারা দেশে ৬৫টি ‘ফ্র্যাঞ্চাইজি’ দোকানে ‘ব্র্যান্ড নাম’ বিক্রি করেছেন।
১৯৭২ সালের এক সন্ধ্যায় রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকার রাস্তায় প্রতিদিনের মতোই ছিল যানজট ও বাসের চাপ। সেই বাসগুলোর একটি থেকে মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ও তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রী নামলেন। লুৎফর রহমানের হাতে ছিল শুধু একটি স্যুটকেস; পকেটে মাত্র ২৫০ টাকা।
২০২১ সালের আগস্টে পান্থপথের লাজ সেন্টারের অফিসে বসে লুৎফর বলেন, ‘আমরা তখন ঢাকায় আসার পথে কিছু অর্থ খরচ করে ফেলেছিলাম। আমি চাকরি পাব কি না, তা নিয়েও চিন্তায় ছিলাম।’
এই দম্পতি যশোর থেকে এসে রাতে থাকার জন্য মালিবাগে তাদের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে যাচ্ছিলেন।
লুৎফর রহমানের বয়স এখন ৭২ বছর। সারা দেশে ৬৯টি লাজ ফার্মার দোকানে তার অংশীদারিত্ব রয়েছে। যদিও গত ৪০ বছরের এই যাত্রা মসৃণ ছিল না; কখনো কখনো তাকে কঠিন সময়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে। আবার কখনো বিস্ময়করভাবে সুযোগও এসেছিল। যাহোক, গ্রাহকরা সব সময়ই লাজ ফার্মার সেবায় সন্তুষ্ট।
লুৎফর বলেন, ‘আমি কখনোই ঔষধ বিক্রেতা হওয়ার কথা ভাবিনি। চাকরি পাওয়ার আশায় ঢাকায় এসেছিলাম, যেন নববধূর সঙ্গে সংসার পাততে পারি।’
বছরের পর বছর ধরে বহু পরীক্ষা ও কষ্টের পর লুৎফর নিজেকে দেশের বৃহত্তম ওষুধের দোকানের (চেইন শপ) মালিক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। লাজ ফার্মার জেনারেল ম্যানেজার আনোয়ার হোসেনের মতে, লাজ ফার্মার দৈনন্দিন লেনদেন প্রায় ১ কোটি টাকা। এছাড়া, তারা প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৮০ হাজার মানুষকে সেবা সরবরাহ করেন।
বর্তমানে ঢাকায় লাজ ফার্মার চারটি শাখা রয়েছে। এরমধ্যে তিনটি কলাবাগান এলাকায় ও একটি উত্তরায়। তবে লাজ ফার্মার নামে শহরজুড়ে রয়েছে আরও ৬৫টি ফার্মেসি। এগুলো ২০টি ভিন্ন ভিন্ন মালিক বা ফ্র্যাঞ্চাইজির। তার মানে, অন্য ফার্মেসিগুলো ব্যবসা পরিচালনার স্বার্থে লাজ ফার্মার ব্র্যান্ড নাম ও লোগো ব্যবহার করে। ওই মালিকদের প্রত্যেকেই ব্যবসায়িক এই সুবিধা পাওয়ার জন্য লাজ ফার্মাকে এককালীন ৫ লক্ষ টাকার কিস্তি প্রদান করেছেন।
লাজ ফার্মার সাফল্যের আগে
শৈশবে লুৎফর ছিলেন মেধাবী ছাত্র। তাই তার পাট ব্যবসায়ী বাবা তাকে যশোরের দ্বিতীয় বিখ্যাত বিদ্যালয়, সম্মিলনী ইনস্টিটিউশনে ভর্তি করান। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি বামপন্থী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং চরমপন্থী বাম গোষ্ঠী নকশালদের সশস্ত্র সদস্য হয়ে ওঠেন।
তরুণ লুৎফরের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততাই তাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া থেকে বিরত রেখেছিল। কারণ, তার দল যুদ্ধে অংশ নিতে তাকে নিষিদ্ধ করেছিল। তিনি বেশ কয়েক বছর ওই রাজনৈতিক সংগঠনে কাটানোর পর একাত্তরের এক পর্যায়ে দলের নেতারা তার বাবাকে বুর্জোয়া বলে অভিহিত করে এবং লুৎফরকেই দায়িত্ব দেয় নিজের বাবাকে হত্যা করার জন্য।
লুৎফর বলেন, ‘আমি আমার বাবাকে হত্যা করতে পারিনি। তাই স্কুল থেকে পালিয়ে একজনের বাড়িতে আশ্রয় নিই। সেখানে গৃহকর্তার মেয়েকে শিক্ষক হিসেবে পড়ানো শুরু করি।’
এরপর সেই মেয়ের সঙ্গেই প্রেম ও বিয়ে হয় তার। একজন বেকার হিসেবে বিয়ের পর তাদের কষ্ট দ্বিগুণ হয়ে যায়। তাই এই দম্পতি একসঙ্গে জীবন কাটাতে ও ভাগ্য গড়ার চেষ্টায় রাজধানী ঢাকায় পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্ত নেন।
ঢাকায় আসার দ্বিতীয় দিন, লুৎফর তার কলাবাগানবাসী এক বন্ধুর খোঁজে বেরিয়ে পড়েন। তাকে খুঁজেও পান। সেই বন্ধুই তাকে কলাবাগানে থাকার জন্য মাসিক ৩০ টাকা ভাড়ায় এক রুমের একটি বাসার ব্যবস্থা করে দেন।
অপ্রত্যাশিতভাবে, কয়েক মাস পর তার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়লে লুৎফর তাকে ডাক্তার রাশেদুল বারীর কাছে নিয়ে যান।
লুৎফরের ভাষ্যে, ‘আমার স্ত্রীকে দেখে ডাক্তার হাসতে হাসতে বললেন, আমার স্ত্রী গর্ভবতী।’ কিন্তু তার অবস্থা অবনতির দিকে যাওয়ায় হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয়। লুৎফর তার স্ত্রীকে মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি করান। তখন ডাক্তার বিনামূল্যে কিছু ঔষধ দিয়েও তাকে সহায়তা করেছিলেন।
ডাক্তার বারী কলাবাগানের বসিরউদ্দিন রোড সংলগ্ন নিজ চেম্বারের ফার্মেসিতে লুৎফরকে চাকরি দেন। তার দায়িত্ব ছিল পুরান ঢাকা থেকে ওষুধ কেনা এবং চেম্বারের ফার্মেসিতে মুনাফায় তা বিক্রি করা। এটিই ছিল ওষুধ বিক্রেতা হিসেবে লুৎফরের প্রত্যাবর্তন।
লুৎফর বলেন, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ওষুধের সংকট ছিল। ওষুধের দামও রাতারাতি বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল।’
তিনি ফার্মেসির দোকানে কাজ করে ছয় মাসে ৬ হাজার ৬০০ টাকা সঞ্চয় করেন। এরপর সেই টাকা দিয়ে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠার কথা ভাবতে শুরু করেন।
১৯৭২ সালের শেষের দিকে লুৎফর ও তার একজন ব্যবসায়িক অংশীদার কলাবাগানে ‘শতদল’ নামে একটি ফার্মেসি দেন।
লুৎফর বলেন, ‘আমি দোকানে বসতে শুরু করলাম। তবে বসে থেকে একদম সময় নষ্ট করিনি। চিকিৎসা সংক্রান্ত বই পড়া শুরু করলাম।’
যাহোক, প্রায় আট মাস পরে, তার ব্যবসায়িক অংশীদার তাকে বলেছিলেন, তিনি আর ব্যবসা চালাতে আগ্রহী নন।
লুৎফর জানান, তার অংশীদার নিজ বিনিয়োগের প্রায় ৩ হাজার টাকা ফেরত চেয়েছিলেন। ‘আমি সেই টাকা পরিশোধ করে দিলাম,’ বলেন লুৎফর।
দুই বছর পর, ১৯৭৪ সালে তিনি ফার্মাসিকে কলাবাগানের প্রথম গলিতে স্থানান্তরিত করেন। ফার্মেসি শপের নামও পরিবর্তন করেন। আর এভাবেই জন্ম ‘লাজ ফার্মা’র। তিনি তার সন্তানদের নাম থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে দোকানের নাম রেখেছেন। তার মেয়ে লাইজুর নাম থেকে ‘লা’ এবং ছেলে জয়ের নামের প্রথম অক্ষর ‘জ’ নিয়ে দোকানের এই নামকরণ।
ব্যবসা বৃদ্ধির বিস্ময়কর গল্প
চার বছর পর, ১৯৭৮ সালে, তিনি দোকানটি মিরপুর রোডে স্থানান্তরিত করেন। এরমধ্যে একদিন এক ভদ্রলোক তার ফার্মেসিতে ওষুধ কেনার জন্য আসেন। তাদের কথোপকথনের এক পর্যায়ে লোকটি নিজেকে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক লুৎফর রহমান সরকার বলে পরিচয় দেন।
লাজ ফার্মার লুৎফর বলেন, ‘তার নাম শুনে আমার রক্ত হিমশীতল হয়ে গেল। আমি তার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু কখনোই সুযোগ পাইনি। আর তখন তিনি নিজের ইচ্ছায় আমার কাছে এসেছিলেন।’
‘তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আমি সোনালী ব্যাংকে ওষুধ সরবরাহ করতে পারব কি না। আমি পারব বলার পর তিনি আমাকে তার অফিসে দেখা করতে বললেন,’ লুৎফর স্মরণ করেন।
প্রথম বৈঠকের পর সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাগজপত্রে স্বাক্ষরের মাধ্যমে লুৎফরকে ব্যাংকের চিকিৎসা সামগ্রী সরবরাহকারী হিসেবে অনুমোদন দেন। তিনি জরুরি ভিত্তিতে, কোনো ধরনের বিলম্ব না করেই এই অনুমোদন দিয়েছিলেন।
অনুমোদন দেওয়ার সেই একই দিন সন্ধ্যায় লুৎফরের ফার্মেসিতে এসে ব্যাংক পরিচালক ওষুধের প্রথম চালান চেয়েছিলেন।
লুৎফর বলেন, ‘আমি যে কাজ সারা বছর ধরে করার চেষ্টা করছিলাম, তা চোখের পলকে ঘটে গিয়েছিল।’
কিছু সময়ের পরে, পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে তিনি ব্যবসাকে আরও সম্প্রসারণ করতে চাইলেন। ফলে দ্রুতই তার বিনিয়োগ দরকার ছিল। সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তার সহায়তায় তিনি ব্যাংক থেকে আড়াই লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন।
সাফল্যের রহস্য
ওষুধ ব্যবসায়ে জড়ানোর পর লুৎফর আবিষ্কার করলেন, মানুষ যেসব ওষুধ সেবন করে, তার অধিকাংশই মূলত নকল বা নিম্নমানের।
তিনি বলেন, ‘আমি বুঝতে পেরেছিলাম, আমার বাবা বহু বছর ধরে যা খাচ্ছিলেন, তা মূলত ওষুধ ছিল না। সেগুলো ছিল নকল পণ্য। এরপর আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, কখনোই কোনো নকল ওষুধ বিক্রি করব না।’
লুৎফর তার প্রতিশ্রুতি পালন করেছেন।
‘এভাবে লাজ ফার্মা ভালো অভ্যাসের প্রতীক হয়ে উঠেছে,’ বলেন তিনি।
১৯৯০-এর দশকে ওষুধ ব্যবসায় ব্যাপক অনৈতিক চর্চার কারণে লুৎফর দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি।
১৯৯২ সালে তিনি সপরিবারে কানাডায় চলে যান। সেখানে একটি বাড়িও কিনেছিলেন। তিনি সেখানে ওষুধের দোকানে ঘুরে বেড়াতেন। কানাডার সবচেয়ে বড় ওষুধের খুচরা চেইন শপ ‘ড্রাগ মার্ট’-এর সন্ধান পান এভাবেই।
লুৎফর বলেন, ‘আমি দোকানটি দেখে প্রতি মুগ্ধ হয়েছিলাম। দোকানটি ছিল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এবং ওষুধগুলো চমৎকারভাবে সাজানো। সিদ্ধান্ত নিলাম, আমার ফার্মেসিকেও একইভাবে সাজাব।’
১০ বছর কানাডায় থাকার পর, ২০০২ সালে লুৎফর বাংলাদেশে ফিরে আসেন একটি নতুন আইডিয়া নিয়ে, যা তিনি তার দোকানে বাস্তবায়ন করেছিলেন। সাজসজ্জা, গ্রাহক সেবা ও নতুন পরিবেশ বিক্রি বাড়াতে শুরু করল।
লুৎফর অন্যান্য ফার্মেসিকে লাজ ফার্মার নাম ও লোগো ব্যবহারের অনুমতি দিতে চেয়েছিলেন। ফলে অন্যরাও লাজ ফার্মার নামে ফার্মেসি দোকান দিয়ে ব্যবসা পরিচালনার সুযোগ পেয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘অবশ্য, সবাই অনুমতি পাননি। আমি মনে করি, যারা মানুষের সেবায় কাজ করবে, তারাই এই ফ্র্যাঞ্চাইজি পাবেন।’
লুৎফর জানান, বাংলাদেশের ফার্মেসি ব্যবসায় ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে। যারা এখন ব্যবসায় আসছেন, তারা সরকারি নীতিমালায় নির্ধারিত মডেল অনুযায়ী ফার্মেসি দোকান স্থাপন করছেন।
তিনি আরও বলেন, ‘যেকোনো ওষুধ ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার উপরে রাখলে কার্যকারিতা হারায়। যে দোকানগুলো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নয়, সেগুলো আপনাকে মানসম্মত ওষুধ দিতে পারে না।’
ফার্মেসি এবং ওষুধ রাখার তাপমাত্রা সম্পর্কিত কিছু ছোট বই বা পুস্তিকাও লিখেছেন লুৎফর। শুধু ওষুধপত্র নয়, তিনি তার ব্যবসার পাশাপাশি উপন্যাসও লিখেছেন।
তিনি বলেন, ‘আমি লিখতে ভালোবাসি। যখনই সুযোগ পাই, লেখালেখিতে সময় ব্যয় করি।’ এখন আত্মজীবনী লেখার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলেও জানান তিনি।
২০২০ সালে র্যাব পরিচালিত একটি অপারেশনে কলাবাগান শাখায় কিছু মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ রাখার জন্য জরিমানা করা হয় লাজ ফার্মাকে। ওই ঘটনায় লুৎফর হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘আমি মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ কোথায় রাখব? সেগুলো কার্টনে প্যাক করা ছিল। সেটা বিক্রির জন্য ছিল না।’
আরেকটি ঘটনায় আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার সদস্যরা কাকরাইলে লাজ ফার্মার একটি ফ্র্যাঞ্চাইজিতে অভিযান চালিয়ে কিছু অনিবন্ধিত ওষুধ খুঁজে পান। এ ঘটনার পর লাজ ফার্মা কর্তৃপক্ষ কিছু সময়ের জন্য তাদের ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো স্থগিত করে দেয়।
লুৎফর বলেন, ‘এই ঘটনা দুঃখজনক। কিন্তু আমি মনে করি না, এটি আমাদের ব্যবসার ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।’
লুৎফরের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলো, মডেল ফার্মেসি ধারণাটি সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া, যেন মানুষ মানসম্মত ওষুধ পেতে পারে।
মজার ব্যাপার হলো, লুৎফর কোনো বাংলাদেশি ওষুধ সেবন করেন না। তিনি বলেন, ‘যখন কানাডায় যাই, তখন কানাডার নাগরিক হিসেবে আমি সেখানে বিনামূল্যে ওষুধ পাই। সারা বছর বিনামূল্যে পাওয়া সেই ওষুধই সেবন করি আমি।’