টুকটাক অসুস্থতা নিয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধ্য হন অনেক চিকিৎসকই। তবে নিজেরই মাথা ফেটে গেছে, মাথায় ব্যান্ডেজ জড়ানো অবস্থায় তিনি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে রোগীদের সেবা দিচ্ছেন—এমন দৃশ্য বিরল। এই বিরল দৃশ্যই দেখা গেছে গত জুলাই মাসে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েও জরুরি বিভাগে সেবা দিয়ে গেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক হাবিবুল আওয়াল।
১১ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে যোগ দেন হাবিবুল আওয়াল, কাছের মানুষেরা যাঁকে শুভ নামে ডাকেন। ১৫ জুলাই রাজু ভাস্কর্যের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিলের অংশ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করছিলেন। বেলা তিনটা-সাড়ে তিনটা নাগাদ অতর্কিত আক্রমণের শিকার হন ভিসি চত্বর এলাকায়।
যা ঘটেছিল
কী হয়েছিল সেদিন? জানতে চাইলে হাবিবুল বলেন, ‘একটি দল অতর্কিতে আমাদের ওপর হামলা চালায়। তাদের মাথায় ছিল হেলমেট, হাতে দেশীয় অস্ত্র। লাঠির আঘাত লাগে আমার মাথায়। পিঠেও কয়েকটি আঘাত লেগেছিল। এই তাণ্ডবের মধ্যে চশমাটা কোথায় যে হারালাম, জানি না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে হাবিবুলের নিজ এলাকার একজন অগ্রজ থাকতেন, সেখানেই প্রথমে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন আহত অবস্থায়। কিন্তু হলে ঢুকতে দেওয়া হয়নি তাঁকে। রক্তাক্ত অবস্থায় বাধ্য হয়ে নিজেই রিকশা নেন। সঙ্গে নেন আহত আরও দুই অচেনা শিক্ষার্থীকে। নিজ মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগে পৌঁছানোর পর সিটি স্ক্যানে দেখা যায়, হাবিবুলের মাথার সামনের অংশের হাড় ভেঙেছে, মাথায় রক্তও জমা হয়েছে। অস্ত্রোপচার কক্ষে নিয়ে ছয়টি সেলাই দেওয়া হয় মাথায়। ভর্তি হন শিক্ষার্থী কেবিনে।
কেবিনে কয়েকটা দিন
পরের দুটি দিন বিশ্রামেই ছিলেন হাবিবুল। আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার আরও সংবাদ পাচ্ছিলেন। হাসপাতাল থেকে ছুটি নেওয়ার মতো সুস্থ হয়েও আবাসিক হলে ফিরতে পারেননি। সেখানেও যে আক্রমণের ভয়। ১৮ জুলাই উত্তরা থেকে এক ইন্টার্ন বন্ধুর কল আসে। সেই বন্ধু জানান, তাঁর পরিচিত এক ছেলে রামপুরা এলাকায় আন্দোলনে আহত হয়েছে। ছেলেটির খোঁজ নিতেই ফোন করেছিলেন তিনি; প্রতিকূল পরিস্থিতিতে উত্তরা থেকে আসতে পারছিলেন না বলে।
নতুন লড়াইয়ে
বন্ধুর অনুরোধে সেই ছেলের খোঁজ নিতে হাবিবুল যান জরুরি বিভাগে। গিয়েই দেখেন এক ভয়াবহ দৃশ্য। জরুরি বিভাগজুড়ে বহু আহত মানুষ। এ অবস্থায় হাবিবুল হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারেননি। ড্রেসিং, ব্যান্ডেজ, সেলাই—যাঁর যেমন প্রয়োজন, তাঁকে সেভাবেই সহায়তা করেছেন। কাগজে-কলমে তখনো তিনি হাসপাতালের ‘রোগী’। ডিউটিতে তাঁর থাকার কথা না। তবু মানবিকতা থেকেই ১৮-২২ জুলাই স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে সেবা দিয়েছেন এই চিকিৎসক। জানালেন, ১৯ জুলাই জুম্মার নামাজের পর পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে। সর্বস্তরের মানুষ আহত অবস্থায় চিকিৎসা নিতে আসছিলেন। লাঠি, রড, ধারালো অস্ত্র, এমনকি প্রাণঘাতী গুলিতে আহত ব্যক্তিদেরও নিয়ে আসা হচ্ছিল। পেশাগত দায়িত্বের ঊর্ধ্বে গিয়ে হাবিবুলের মতোই তাঁদেরকে নিঃস্বার্থ সেবা দিয়ে গেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আরও অনেক ইন্টার্ন চিকিৎসক।
২৪ জুলাই গ্রেপ্তার আতঙ্কে ঢাকা ছাড়তে বাধ্য হন হাবিবুল। রাজশাহীতে গ্রামের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
তবে যত দিন ঢাকায় ছিলেন, হার মানেননি। সেই সময় আহত ব্যক্তিদের জন্য কিছু আর্থিক সাহায্যও পৌঁছেছিল তাঁর কাছে। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঘুরে তা বণ্টনের ব্যবস্থা করেছিলেন। তখন নিশ্চয়ই সাদা অ্যাপ্রোনের চেয়েও বেশি চোখে পড়ছিল তাঁর মাথায় বাঁধা সাদা ব্যান্ডেজ।