ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ
ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নানা রূপে সাজে প্রকৃতি। আবার ঋতু পরিবর্তনের এই খেলায় তাপমাত্রা, আর্র্দ্রতা, ধুলাবালি আর বৃষ্টিপাতের তারতম্যে দেখা যায় নানা রকম অসুখ-বিসুখের উৎপাত। ঋতুভেদে এসব অসুখের বেশিরভাগই ভাইরাসজনিত এবং সাময়িক, কিন্তু অস্বস্তিকর। তবে সুবিধা হলো, একটু সতর্ক হলে প্রায় ক্ষেত্রেই এগুলো প্রতিরোধ করা যায়। এমনকি রোগব্যাধি হয়ে গেলেও তা উদ্বেগের নয়, সহজ চিকিৎসায় নিরাময়যোগ্য।
ঋতু পরিবর্তনের সময় সবচেয়ে বেশি দেখা দেয় সর্দি-কাশি বা কমন কোল্ড। বিশেষ করে শীত আর গরমের শুরুতে তাপমাত্রা পরিবর্তনের সময় এর প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। প্রায়ই দেখা যায় দুই-তিনদিন নাক বন্ধ থাকে বা নাক দিয়ে পানি ঝরে। গলা ব্যথা করে, শুকনো কাশি থাকে, জ্বরও থাকতে পারে। এগুলো বেশিরভাগই ভাইরাসজনিত এবং এ্যান্টিবায়োটিক ছাড়াই ভাল হয়ে যায়, তবে শুকনো কাশিটা কয়েক সপ্তাহ ভোগাতে পারে। ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ, এ্যান্টিহিস্টামিন খেতে হবে। আর গরম পানিতে গড়গড়া করতে হবে। গরম গরম চা, বা গরম পানিতে আদা, মধু, লেবুর রস, তুলসীপাতার রস ইত্যাদি পান করলে উপকার পাওয়া যায়। অনেক ক্ষেত্রে ভাইরাসের পরপরই ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করে। এক্ষেত্রে কাশির সঙ্গে সঙ্গে হলুদ বা সবুজ রঙের কফ বের হয়, বুকে ব্যথা করে এবং জ্বর থাকে। এ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন হয়। আরেকটি ভাইরাস রোগ যাকে বলে সিজনাল ফ্লু; যার লক্ষ্যণ কমন কোল্ডের মতোই। আলাদা কোন চিকিৎসারও প্রয়োজন হয় না, উপরের কমন কোল্ডের মতোই।
কমন কোল্ড ছাড়াও শীতের সময় সাইনাস আর টনসিলের প্রদাহ দেখা দিতে পারে। টনসিলের সমস্যা সাধারণত ছোটদেরই বেশি হয়। হঠাৎ শীত পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠাণ্ডা পানীয় বা আইসক্রিম খাওয়ার অভ্যাস এর কারণ। এছাড়া যারা হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস বা শ্বাসজনিত অন্যান্য রোগে ভোগেন, তাদের রোগের প্রকোপ শীতের সময় বা শীতের পর বসন্তে বাড়তে পারে। আর যেসব অসুখ হতে পারে তা হলো চোখ ওঠা (কনজাংটিভাইটিস), কানের সমস্যা ইত্যাদি। শীত শেষে গরম আসলে পাতলা পায়খানাজনিত সমস্যাসহ অন্যান্য পেটের পীড়া দেখা দিতে পারে। প্রচ- গরমের সঙ্গে সঙ্গে পিপাসার কারণে রাস্তাঘাটে পানি বা সরবত খাওয়া আর খাবার দ্রুত নষ্ট হয়ে যাওয়া খাদ্য গ্রহণ করার ফলে প্রায়ই ডায়রিয়া দেখা দেয়। এমনকি এসব গগ্রণ করার কারণে টাইফয়েড, প্যারাটাইফয়েড, জন্ডিস, সাধারণ আমাশয়, রক্ত আমাশয় ইত্যাদিও হতে পারে। ডায়রিয়ার পাশাপাশি গরমের কারণে পানিস্বল্পতাও এ সময় মারাত্মক হতে পারে। আবার তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অতিরিক্ত তাপমাত্রায় হিট স্ট্রোকের মতো জটিল সমস্যারও প্রকোপ দেখা দিতে পারে। এই সময় আরেকটি ভাইরাস রোগ হতে পারে, তা হলো জলবসন্ত। প্রথমে একটু জ্বর-সর্দি, তারপর গায়ে ফোস্কার মতো ছোট ছোট দানা। সঙ্গে থাকে অস্বস্তিকর চুলকানি, ঢোক গিলতে অসুবিধা। গায়ে ব্যথা থাকতে পারে। এটাও কোন মারাত্মক অসুখ নয়। জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল, শরীর চুলকালে এ্যান্টিহিস্টামিন জাতীয় ওষুধ, ক্যালামিন লোশন ইত্যাদি ব্যবহার করলেই রোগের প্রকোপ কমে আসবে। আর সংক্রমণ হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে এ্যান্টিবায়োটিক লাগতে পারে। শিশু-কিশোরদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করতে হবে। সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই রোগটি ভাল হয়ে যায়।
কী কী সতর্কতা নেয়া জরুরী
ঠাণ্ডাজনিত রোগ শীতেও লাগে, গরমেও লাগে। অতিরিক্ত কাপড়ে ঘেমে ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে, বয়স্ক ও বাচ্চাদের আরও বেশি হয়। ঠাণ্ডা বাতাস এড়িয়ে চলুন। আবার অতিরিক্ত গরমে যাওয়াও এড়িয়ে চলুন। ঘাম হলে মুছে ফেলুন।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শীত অতিক্রান্ত হওয়ার পরপরই ঠাণ্ডা পানি বা খাবার খাওয়া, ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করা, ধুলাবালিতে যাওয়া ইত্যাদি পরিহার করলে এসব রোগ থেকে নিরাপদ থাকা সম্ভব। ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া জনিত অসুখে আক্রান্ত রোগীর থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে হাঁপানি রোগীসহ যাঁরা শ্বাসযন্ত্রের সমস্যায় ভোগেন তাঁরা গরম বাতাস, বাতাসের সঙ্গে ধুলাবালি, শুষ্ক আবহাওয়া ইত্যাদি এড়িয়ে চললে উপকার পাবেন। বাইরে বেরোবেন, নাক ঢেকে ধুলা পরিহার করুন। খেয়াল রাখুন আবহাওয়ার। সে অনুযায়ী কাপড় নিন। খেলাধুলার সময় বিশেষ করে বাচ্চারা যারা স্কুল মাঠে বেশি খেলাধুলায় মত্ত হয় তাদের আরও সতর্ক হতে হবে যাতে ধূলি-বাতাসের স্পর্শ কম হয়।
সব সময় পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে, যেখানে-সেখানে দূষিত পানি বা অন্যান্য পানীয় খাওয়া বর্জন করতে হবে। পানি ও অন্যান্য তরল পান করুন, অন্য সময়ের চেয়ে একটু বেশি, শুধু যেন হয় বিশুদ্ধ। বিশেষ করে যাঁরা অতিরিক্ত গরম পরিবেশে কাজকর্ম করেন তাঁদের বেলায় তরল পানীয়ের সঙ্গে লবণ মিশিয়ে নেবেন। এমনকি ওরস্যালাইনও খেতে পারেন। তরল-গরম-টাটকা খাবার সব সময়ই ভাল। গরম পানিতে মধু আর গরম লেবু-চা পান করতে পারেন।
মনে রাখতে হবে জ্বর যদি বেশি দিন থাকে, কাশি যদি দুই সপ্তাহের বেশি হয়, সর্দি যদি না-ই সারে, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। অযথা অবহেলা করলে অসুখ জটিল হয়ে যেতে পারে, অথবা খারাপ রোগেও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
ঋতু পরিবর্তন চিরন্তন। শীত যাবে, বসন্ত আসবে। গাছে গাছে নতুন পাতা গজাবে, ফুলে ফুলে ভরে উঠবে শাখা প্রশাখা। সময়ের সঙ্গে আসবে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরত, হেমন্ত। প্রকৃতি সেজে উঠবে অপরূপ সাজে। আর এর সঙ্গে একেক সময় একেক রোগব্যাধির প্রকোপ হতে থাকবে। সেই অনুযায়ী প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়েই চলতে হবে। মনে রাখতে হবে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম।
ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ
ডিন, মেডিসিন অনুষদ, মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়