॥ ই-হেলথ২৪ রিপোর্ট ॥ পুরুষ কিংবা নারী সবার ক্ষেত্রেই ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর_ একথা প্রচারের ফলে অনেকের জানা হয়ে গেলেও ধোঁয়া না ছেড়েও যে তামাক সেবনের পরিণতি একই রকম মারাত্মক তা অনেকটা অজানা। আর ধূমপানের মতো অধূম্র সেব্য গুল, জর্দা, সাদাপাতা প্রভৃতি আইনের আওতায় আসেনি। অথচ এগুলোর প্রধান শিকার নারী ও গর্ভের অনাগত শিশু।
গ্রাম বাংলার অসংখ্য নারী-পুরুষের পাশাপাশি বিড়ি, সিগারেট, জর্দা, গুলসহ ধোঁয়াবিহীন ও ধোঁয়াযুক্ত তামাক ব্যবহার করেন। পরবর্তীতে তারা নানান জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
বিষেশজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, তামাক সেবন নারীর স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তথ্য মতে, ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবন মুখ, খাদ্যনালি ও অগ্নাশয়ের ক্যান্সার, রক্তচাপ ও হৃদকম্পন বৃদ্ধির মতো মারাত্মক রোগের কারণ। এছাড়া নারীদের ক্ষেত্রে সন্তান জন্মদান সংক্রান্ত জটিলতা (যেমন_ কম ওজনের সন্তান জন্মদান) হতে পারে।
ঢাকার বারডেম হাসপাতালের ডেন্টাল বিভাগের অধ্যাপক ও মানসের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ডা. অরূপ রতন চৌধুরী বলেন, ধোঁয়াহীন ও ধোঁয়াযুক্ত তামাক ব্যবহারের ক্ষতি একই। তবে ধোঁয়াহীন তামাকের ক্ষতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি এবং খুব দ্রুত হয়। যেমন_ পানের সঙ্গে মহিলারা যখন জর্দা খান, সেই জর্দা সরাসরি মুখের ভেতর যে মেমব্রাইন নামক এক ধরনের কোষ আছে সেই কোষের সঙ্গে মিশে রক্তনালিতে প্রবেশ করে। ফলে হৃদরোগ, মস্তিষ্ক, লিভারের কার্যকরী ক্ষমতা বিনষ্ট করে দেয়।
নানারকম রোগ সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, তামাক ব্যবহার ৪ হাজার রোগের সৃষ্টি করে। এর মধ্যে ২৭ রকমের ক্যান্সার রয়েছে, যা এই তামাকের ব্যবহারের জন্য মানবদেহে সৃষ্টি হয়। তিনি বলেন, বারডেমে প্রতিদিন ধোঁয়াহীন তামাক (গুল, জর্দা) সেবনের ফলে সৃষ্ট শতকরা ২০ ভাগ রোগী আসেন এবং শতকরা ৫ ভাগ রোগী আসেন মুখের ক্যান্সারজনিত রোগ নিয়ে। এ অবস্থায় অতি দ্রুত ধোঁয়াহীন তামাকের ওপর সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে।
তামাক নিয়ন্ত্রন সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে ধোঁয়াহীন তামাক ব্যবহার নিয়ে কোনো বিধিনিষেধ নেই। এবার অবশ্যই ধোঁয়াহীন তামাকের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে এবং গুল ও জর্দার প্যাকেটের গায়ে সচিত্রক স্বাস্থ্যের ক্ষতিবিষয়ক বাণী থাকার ব্যবস্থা করতে হবে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, জর্দা, সাদাপাতা, গুল ইত্যাদি সেবনে গর্ভস্থ শিশুর মৃত্যু ডেকে আনতে পারে। ধোঁয়াহীন এসব নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবনকারী নারীদের গর্ভপাত ও মৃত সন্তান জন্ম দেওয়ার হার সাধারণ নারীদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে কোনো মা ধোঁয়াহীন তামাক গ্রহণ করলে গর্ভস্থ শিশু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শিশু মারা যেতে পারে অথবা সে কম ওজন নিয়ে বা সময়ের আগে ভূমিষ্ঠ হতে পারে।
বিশ্বব্যাপী প্রাপ্তবয়স্কদের ধূমপানবিষয়ক জরিপে (গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে-২০০৯) দেখা গেছে, বাংলাদেশে ৪৫ শতাংশ পুরুষ ও ১ দশমিক ৫ শতাংশ নারী ধূমপান করেন; কিন্তু জর্দা, সাদাপাতা ও গুল ব্যবহারে নারীরা এগিয়ে আছেন। মোট ২৬ শতাংশ পুরুষ ও ২৮ শতাংশ নারী ধোঁয়াহীন তামাক গ্রহণ করে থাকেন।
বাংলাদেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অসংক্রামক ব্যাধি বিভাগের প্রধান মোস্তফা জামান বলেন, কয়েক বছর আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডবিস্নউএইচও) একটি অপ্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে_ মেয়েরা প্রথম ধোঁয়াহীন তামাক গ্রহণ করতে শুরু করে গর্ভধারণের সময় থেকে।
এ গবেষণায় বলা হয়েছে, দীর্ঘ মেয়াদে ধোঁয়াহীন তামাক গ্রহণের সঙ্গে গর্ভস্থ ও নবজাত শিশুর সম্পর্কবিষয়ক গবেষণাটি চালানো হয় ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সী ৩৪০ জোড়া মা ও শিশুর (২৪ ঘণ্টার কম বয়সী) ওপর। এদের মধ্যে ১৭০ জন মা গড়ে প্রায় সাড়ে সাত বছর ধোঁয়াহীন তামাক গ্রহণ করেছেন, অন্যরা কোনো রকম তামাক কখনো গ্রহণ করেননি। এই মায়েরা ঢাকা মেডিকেল কলেজের স্ত্রী ও প্রসূতি বিভাগে ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সন্তান জন্ম দিয়েছেন।
এ ছাড়া জর্দা, সাদাপাতা বা গুল ব্যবহার করেন এমন ১৭০ জন নারীর মধ্যে ৫৮ জনের গর্ভপাত ও ৬০ জনের মৃত শিশু ভূমিষ্ঠ হয়। অপর দলের ১৭০ জনের মধ্যে ১৮ জনের গর্ভপাত ও ৩৫ জনের মৃত শিশু জন্মায়। এ ছাড়া ধোঁয়াহীন তামাকসেবী মায়েদের সময়ের আগে সন্তান জন্ম দেওয়ার হার ২ দশমিক ৯ গুণ এবং স্বল্প ওজনের সন্তান জন্ম দেওয়ার হার ৩ দশমিক ৩ গুণ বেশি।
গবেষণায় আরো দেখা যায়, জর্দা, সাদাপাতা ও গুল সেবনকারী মায়ের ৭৫ জনের সময়ের আগেই এবং ১০৫ জনের কম ওজনের শিশু জন্মেছে। নিকোটিন খেলে রক্তনালি সংকুচিত হয়ে জরায়ুতে রক্ত সরবরাহ কমে যায়। এতে গর্ভস্থ শিশু ধারাবাহিকভাবে কম অক্সিজেন পায়। ফলে শিশুর মৃত্যুও হতে পারে। আর ধোঁয়াহীন তামাকে সিগারেটের তুলনায় নিকোটিন ও ক্যানসার সৃষ্টিতে দায়ী উপাদান বেশি থাকে। এক মাত্রার সিগারেটে নিকোটিনের মাত্রা এক মিলিগ্রাম; কিন্তু এক মাত্রার ধোঁয়াহীন তামাকে নিকোটিনের মাত্রা ৪ দশমিক ৫ মিলিগ্রাম।
তামাকবিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞার তথ্য মতে, তামাক সেবনের ফলে সারা পৃথিবীতে প্রতি ১০ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে একজনের মৃত্যু ঘটে। অর্থাৎ তামাক সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর ৫৪ লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। এর মধ্যে পৃথিবীর প্রায় ১০০ কোটি তামাক ব্যবহারকারীর মধ্যে ২০ শতাংশ নারী। এর মধ্যে তামাক সেবনে বাংলাদেশের নারীদের মধ্যে রয়েছে উচ্চ প্রবণতা। বাংলাদেশে ৪৩ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক সেবন করেন। অর্থাৎ দেশে বর্তমানে তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৪ কোটির বেশি। নারীদের মধ্যে এ হার ২৯ শতাংশ এবং পুরুষদের মধ্যে ৫৮ শতাংশ। তবে ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারের হার নারীদের মধ্যে অনেক বেশি। এ হার পুরুষদের মধ্যে ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারের হারের চেয়েও বেশি। নারীদের মধ্যে ২৮ শতাংশ এবং পুরুষদের মধ্যে ২৬ শতাংশ ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করেন।
উবিনীগের নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আকতার বলেন, দেশের ২৮ ভাগ নারী তামাক সেবন করে। তামাক সেবনের কারণে নারীদের মধ্যে ফুসফুস ক্যান্সার, জরায়ু ক্যান্সার বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়া তামাক সেবন ও পরোক্ষ ধূমপানের কারণে গর্ভজাত সন্তান মারা যায়, কিংবা বিকলাঙ্গ হয় কিংবা কম ওজনের শিশু জন্মদানের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এ অবস্থায় ধোঁয়াবিহীন তামাককেও তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে বিধিনিষেধসহ কঠোর শাস্তির বিধান করা দরকার।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের রেডিওলোজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. গোলাম মহিউদ্দীন ফারুক বলেন, ‘ধোঁয়াহীন তামাকের ক্ষতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। এর ফলে জিহ্বা, মুখের ভেতরের অংশ, মাড়ি, স্বরযন্ত্র, টনসিল, ফুসফুস, খাদ্যনালি ও পাকস্থলি আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। আর এ ধরনের রোগ নিয়ে ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবনকারী নারীদের প্রায় ২০ শতাংশ রোগী প্রতিদিন ঢাকা মেডিকেলে আসছে। পুরুষের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ আরো বেশি। তিনি আরো বলেন, সেবনের পাশাপাশি যারা প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে জড়িত। তারাও একই ধরনের সমস্যায় ভোগেন।
তামাকবিরোধী সংগঠন ‘ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ’-এর আমিনুল ইসলাম সুজন বলেন, ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনে ধোঁয়াহীন তামাক উৎপাদন ও বিপণনের ক্ষেত্রে কোনো শাস্তির বিধান রাখা হয়নি। ফলে কখনোই জর্দা, সাদাপাতা ও গুলের প্রসার বন্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়নি। সংশ্লিষ্টদের মতে, নারীদের স্বাস্থ্যরক্ষায় সাদাপাতা, জর্দা ও গুলকে আইনে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। নারী ও শিশুদের ধূমপানের ক্ষতি থেকে রক্ষা এবং চর্বনযোগ্য তামাক ব্যবহার হ্রাসে আইন সংশোধন এবং চর্বনযোগ্য তামাকসহ সব রকম তামাকের ওপর ব্যাপকহারে কর বৃদ্ধি করা দরকার।
‘ক্যাম্পেইন ফর তোবাক্কো ফ্রি কিডস্’-এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি তাইফুর রহমান বলেন, ধোঁয়াযুক্ত তামাক সেবনের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সবাই জানে। তবে ধোঁয়াহীন তামাক সেবনের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে এখনো অবগত নন এমন মানুষের সংখ্যা বেশি। এ ছাড়া এই ধোঁয়বিহীন তামাক সেবনে নারীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে ধোঁয়াবিহীন তামাক নিয়ে কোনো বিধিনিষেধ নেই। এ অবস্থায় ধোঁয়াবিহীন তামাক বন্ধে এবং নারী ও অনাগত শিশুর স্বাস্থ্যের রক্ষায় জর্দা, গুল ও সাদাপাতাসহ অন্যান্য ধোঁয়বিহীন তামাক পণ্য বন্ধে প্রয়জনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে এবং সরকারকে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে এ বিষয়ে ক্ষতিকর প্রভাব, তামাকপণ্যের প্যাকেটে সচিত্র সতর্কবাণী এবং তামাকপণ্যের ওপর বেশি করে করারোপ করা প্রয়োজন।