ড. জাকিয়া বেগম
হরমোন একটি যৌগিক পদার্থ যা মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রতঙ্গের স্বাভাবিক বৃদ্ধি, কোষকলার স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা বজায় রাখা, হজমকৃত খাদ্যসমূহের সঠিক ব্যবহার, মানসিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণ, জরুরি অবস্থায় শরীরের প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ, হাড়ের ঘনত্ব বজায় রাখা, কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বলতে গেলে শরীরের প্রায় সব অঙ্গপ্রতঙ্গ এবং কোষকলার কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণেই হরমোনের কিছু ভূমিকা থাকে। বয়স ভেদে শরীরে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের হরমোনের নিঃসরণ ও সমন্বয় ঘটে থাকে। কিন্তু কোন কারণে যদি কোন একটি হরমোনের মধ্যে ত্র“টি দেখা দেয় তবে তা অন্য হরমোনগুলোর স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রেও ছন্দপতন ঘটায়। ফলে হরমোন অসমতাজনিত সমস্যা দেখা দেয়।
শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় যে কোন ধরনের হরমোনের অনিয়মিত ও অসমানুপাতিক নিঃসরণকে হরমোন অসমতা বলা হলেও সাধারণভাবে হরমোন অসমতা দ্বারা মহিলাদের প্রজনন চক্রের প্রক্রিয়াগত পরিবর্তনের কারণে ইস্ট্রোজেন ও প্রজেসটেরন নামক হরমোন মাত্রার ওঠা-নামাকেই বোঝানো হয়। ইস্ট্রোজেন মহিলাদের প্রধান যৌন হরমোন এবং প্রজেসটেরন ঋতুচক্র নিয়ন্ত্রণ এবং প্রজননে সহায়ক হওয়ায় এ দুটি হরমোনের গুরুত্ব অনেক বেশি।
ইস্ট্রোন, ইস্ট্রাডিওল এবং ইস্ট্রিয়োল নামক কতগুলো হরমোনের সমন্বয়ে রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ইস্ট্রোজেন শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রায় উৎপন্ন হয়। এই হরমোনটির প্রভাবেই একটি মেয়ে মহিলা হিসেবে পূর্ণতা লাভ করে। প্রধানত গর্ভফুল এবং ডিম্বাশয়ে বেড়ে ওঠা ‘ফলিকিউল’ থেকে ইস্ট্রোজেন উৎপন্ন হয়। তাই বেড়ে ওঠা ফলিকিউলের সঙ্গে ইস্ট্রোজেন তৈরি হওয়াটা সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। স্বাভাবিক অবস্থায় ঋতুবতী মহিলাদের ঋতুচক্রের প্রথম ১০-১২ দিন প্রয়োজনীয় মাত্রায় ইস্ট্রোজেনের নিঃসরণ ঘটে। আর প্রতিমাসে জরায়ু থেকে ডিম্বাণুর নির্গমনের সময়ে ইস্ট্রোজেন ছাড়াও প্রজেসটেরন নামক হরমোনটিও নির্গত হয়। এছাড়া শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের কোষকলা যেমন যকৃৎ, স্তন এবং অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি থেকেও অল্প কিছু পরিমাণে ইস্ট্রোজেন তৈরি হয়ে থাকে। কিন্তু বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সন্তান ধারণের ক্ষমতা কমে যায় এবং ডিম্বাণুর নির্গমন কমে আসতে থাকে। তাই এ সময় ইস্ট্রোজেন উৎপাদিত হলেও ডিম্বাণুর নির্গমন হয় না বলে প্রজেসটেরন নিঃসরণ বন্ধ হয়ে যায় এবং হরমোনের মাত্রায় তারতম্য ঘটতে থাকে। আর রজঃনিবৃত্তিতে পৌঁছে যাওয়া মহিলাদের ক্ষেত্রে ইস্ট্রোজেন উৎপাদনের প্রাথমিক অঙ্গ গর্ভফুল এবং ডিম্বাশয় থেকে উৎপাদন সম্ভব হয় না বলে দ্বিতীয় পর্যায়ের উৎসগুলোই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
রজঃনিবৃত্তির পর অথবা কোন ধরনের অসুস্থতার কারণে ডিম্বাশয় অপসারণ করা হলে দুই ধরনের হরমোন নিঃসরণই বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। তবে আধুনিক বিশ্বে অনেক মহিলার মধ্যেই মেনোপজ হওয়ার বেশ আগেই হরমোনের অসমতাজনিত বিভিন্ন সমস্যা প্রকট হয়ে উঠতে দেখা যায়। এর কারণ হিসেবে বলা যায়, গত ১০০ বছরে মানুষের গড় আয়ু প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেলেও সাধারণভাবে হরমোন তৈরির কাজে নিয়োজিত বিভিন্ন গ্রন্থির ওপর চাপ অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে। দৈনন্দিন জীবনের অতিরিক্ত মানসিক চাপ ছাড়াও শরীরে সঠিক মাত্রা ও অনুপাতে হরমোন উৎপাদিত না হওয়ার আরও কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে যেমন; জš§ নিয়ন্ত্রণ বড়ির ব্যবহার, পরিবেশ দূষণ, বাইরে থেকে ইস্ট্রোজেন হরমোন প্রদানের মাধ্যমে কৃত্রিম উপায়ে উৎপাদিত গবাদি পশু-প্রাণীর মাংস গ্রহণ, রাসায়নিকযুক্ত প্রসাধনী সামগ্রীর ব্যবহার ইত্যাদি।
হরমোন অসমতাজনিত লক্ষণগুলো বিভিন্নভাবে প্রকাশ পেতে দেখা যায়। এগুলোর মধ্যে হঠাৎ করেই প্রচণ্ড গরম লাগা এবং ঘেমে ওঠার লক্ষণটি অনেকের ক্ষেত্রেই প্রকট হয়ে ওঠে যাকে ‘হটফ্ল্যাশ’ বলা হয়। এছাড়া রাতে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটা, মেজাজ খিটখিটে হয়ে ওঠা, হতাশা, অস্থিরতা ও উদ্বিগ্নতা বৃদ্ধি পাওয়া, হাঁড়ের ঘনত্ব কমে আসাসহ হাঁড়ের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা, স্মরণশক্তি হ্রাস পাওয়া, অ্যালার্জিজনিত সমস্যা দেখা দেয়, থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যা, কারণ ছাড়াই ওজন বৃদ্ধি, পেট ফাঁপা, কাজের স্পৃহা কমে যাওয়া, চুল পড়া, বুক ধড়ফড় করা, বুড়িয়ে যাওয়ার লক্ষণগুলো প্রকট হয়ে ওঠা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে। ডিম্বাশয়ে সিস্ট জš§ানো, স্তন ও জরায়ু ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনাও এ সময় বৃদ্ধি পায়। লক্ষণ দেখা দেয়ার প্রথম দিক থেকেই চিকিৎসা প্রদান করা না হলে কোন কোন ক্ষেত্রে তা মারাÍক হয়ে উঠতে পারে।
হরমোন অসমতাজনিত সমস্যার প্রধান সমাধান হচ্ছে শরীরে প্রয়োজনীয় মাত্রায় ইস্ট্রোজেন ও প্রজেসটেরন সরবরাহের ব্যবস্থা করা। এক্ষেত্রে ‘হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি’ লক্ষণগুলোর প্রকোপ অনেকটা কমিয়ে আনতে সাহায্য করে। হরমোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু কিছু পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়ার সম্ভাবনা থাকলেও এর উপকারী প্রভাবগুলোর কারণে এটির গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার তীব্রতা কমিয়ে একই সঙ্গে অধিক কার্যকর করে তোলার লক্ষ্যে এর মাত্রা যতটা সম্ভব কম রাখার ব্যাপারে যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।
জীবনযাপন পদ্ধতির পরিবর্তনের মাধ্যমেও হরমোনের অসমতাজনিত লক্ষণগুলো কমিয়ে আনা যায় এবং এক্ষেত্রে পার্শ্বপ্রক্রিয়াজনিত সমস্যার সম্ভাবনাও থাকে না। নিয়মতান্ত্রিক এবং নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, নিয়মিত শরীরচর্চা, মানসিক চাপমুক্ত রাখতে ও শ্বাস-প্রশ্বাস সহজতর করে তুলতে পারে। এমন ধরনের ব্যায়াম করা, যোগাভ্যাস, ধ্যান, স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা, ক্যাফিনযুক্ত পানীয় ও মদ সম্পূর্ণরূপে পরিহার করা, রাতের বেলা যথেষ্ট পরিমাণে বিশ্রাম গ্রহণ করা, নিয়মিতভাবে ভিটামিন বি, সি, ডি এবং ই গ্রহণ, পানিশূন্যতা এড়িয়ে চলার জন্য প্রচুর পরিমাণে তরল পদার্থ পান করা, ওমেগা-৩ এবং ওমেগা-৬ যুক্ত খাদ্য যেমন, তিসি, মিষ্টি কুমড়ার বিচি, সূর্যমুখী তেল এগুলোর মধ্যে প্রচুর ওমেগা-৩ থাকায় এবং ডিম, মুরগির মাংস এবং বিভিন্ন ধরনের বাদামে প্রচুর ওমেগা-৬ ফ্যাটি এসিড থাকায় এ জাতীয় খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়ার ব্যাপারে সচেষ্ট হওয়া যেতে পারে।
———————————————————-
ড. জাকিয়া বেগম
পরমাণু বিজ্ঞানী, মেডিকেল ফিজিসিস্ট ও অধ্যাপক, ইউআইটিএস