সিলেট অঞ্চলে এইচআইভি বহনকারীর সংখ্যা দেশের অন্য সব অঞ্চলের চেয়ে বেশি। বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও চিকিৎসাকেন্দ্রে বেশকিছু রোগীদের রক্তে এইচআইভি ধরা পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা এই পরিস্থিতিতে স্থানীয় বিমান ও স্থলবন্দরগুলোয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা চালুর পরামর্শ দিয়েছেন।
সিলেটের সিভিল সার্জন ফয়েজ আহমেদ গতকাল মঙ্গলবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সিলেটে বেসরকারি সংগঠনগুলোকে নিয়ে আমরা সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করছি। কিন্তু প্রবাসে থেকে আক্রান্ত হয়ে আসা অনেকেই থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এ জন্য আমি বিমানবন্দর ও স্থলবন্দর এলাকায় স্ক্রিনিং ব্যবস্থা চালু করার প্রস্তাব করছি।’
স্থানীয় চিকিৎসকদের হিসাবে, সিলেট জেলায় এইচআইভি বহনকারী ব্যক্তির সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। জাতীয় এইডস/এসটিডি কর্মসূচির দেওয়া তথ্য অনুসারে, ২০০৮ সালে দেশে জেলাওয়ারি হিসাবে ঢাকায় এইচআইভি-পজিটিভ ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ৪৮। আর সিলেটে ছিল ৪৪ জন।
সিলেটে এইডস নিয়ে কর্মরত বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে আশার আলো সোসাইটির হিসাবেই গত নভেম্বর মাস পর্যন্ত সিলেটের চার জেলায় ৩৫৯ এইচআইভি বহনকারী ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছেন ১৪২ জন। জীবিত আছেন ২১৭ জন। গত মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে মারা যান তিনজন। এর মধ্যে দুজন ছিলেন পুরুষ। একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপে চার জেলার মধ্যে শুধু সিলেটে বর্তমানে দুই শতাধিক ব্যক্তি এইচআইভি বহন করছেন।
সিলেটের একাধিক চিকিৎসক জানান, আশার আলো সোসাইটি সংগঠনটি মূলত কাজ করছে সিলেট জেলা ঘিরে। কিন্তু বাকি তিনটি জেলায় তাদের কর্মকাণ্ড আরো বাড়ালে আক্রান্তের সংখ্যা আরো বেশি হতো। এইচআইভি/এইডস নিয়ে কর্মরত এই চিকিৎসকেরা জানান, ১৯৯৮ সালে সংগঠনটি সিলেট বিভাগে প্রাথমিকভাবে মাত্র একজন ‘পজিটিভ’ পেয়েছিল। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৩৫৯ জন।
সিলেটে আশার আলো সোসাইটির কাজ ব্যাপকভাবে শুরু হয় ২০০৩ সালের এপ্রিল মাস থেকে। সংগঠনটি ২০০৫ সালে সিলেটে এইচআইভি বহনকারী ৪৮ ব্যক্তিকে নিয়মিত চিকিৎসা ও অন্যান্য বিষয়ে সহায়তা দিত। পাঁচ বছরের ব্যবধানে সংখ্যাটি বেড়েছে বহুগুণ।
সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তারা জানান, সিলেট অঞ্চলে যাদের রক্তে এইচআইভি ধরা পড়ছে তাঁদের অনেকেই একসময় মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে ছিলেন। এইচআইভি ধরা পড়ায় দেশে ফেরত পাঠানো হলেও তাঁদের অনেকেই তথ্যটি গোপন করেন। ফলে যৌন সংস্পর্শের মাধ্যমে নিজের অজান্তে স্ত্রীরাও এতে আক্রান্ত হচ্ছেন।
এই চিকিৎসক ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তারা জানান, এইচআইভিবাহী ব্যক্তিরা সবাই যে চিকিৎসকের কাছে আসছেন এমন নয়। ফলে অনেকেই থেকে যাচ্ছেন হিসাবের বাইরে। এ ছাড়া নতুন করে যারা এর শিকার হচ্ছেন, তাঁরা তো জানতেই পারছেন না এবং এ সংখ্যাটি কারোরই জানা নেই।
সিলেটের সিভিল সার্জন ফয়েজ আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আক্রান্তদের মাধ্যমে আরো আক্রান্ত হচ্ছে। এ জন্য প্রবাসীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে কর্মসূচি নিতে হবে।’
ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের প্রধান শিবি্বর আহমদ শিবলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সিলেট অঞ্চলে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তবে সমাজব্যবস্থা এবং কুসংস্কারের কারণে এঁরা সেবা ও পরামর্শ পাচ্ছেন না। এ বিষয়টি আমাদের পীড়া দেয়। এখন তাই এইচআইভি পজিটিভের অধিকার বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। সিলেটের বর্তমান পরিস্থিতিতে এটি খুব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ আক্রান্তরা এ সমাজেরই একজন।’ তিনি বলেন, এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসাসেবা পাওয়ার অধিকার রয়েছে।
শিবি্বর আহমদ জানান, সিলেটের ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রক্তের সিডিফোর (পফ৪) সেল গণনা করার জন্য যন্ত্র আনা হলেও সেটি তিন-চার মাস ধরে অব্যবহৃত রয়েছে। আক্রান্তদের অ্যান্ট্রি রেক্টোভাইরাল থেরাপি দিতে হলে এই সেল গণনা করতেই হয়। তাঁর মতে, প্রবাসীদের জন্য বিশেষ সচেতনতামূলক কর্মসূচি নিতে হবে। তিনি জানান, স্থানীয়ভাবেও আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা বাড়ছে। এর বড় কারণ বেসরকারি সংস্থাগুলোর কর্মকাণ্ড কমে যাওয়া। কারণ অনেকেরই তহবিল কমে গেছে।
আশার আলো সোসাইটির বিভাগীয় সমন্বয়কারী তাহমিনা বেগম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সিলেটের বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার, হাসপাতাল ও বেসরকারি সংস্থায় ধরা পড়ার পর আমাদের এখানে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়। দেখা গেছে, আক্রান্ত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই প্রবাসী এবং তাঁদের অনেকেই মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কর্মরত ছিলেন। তিনি আরো বলেন, ‘আমরা সচেতনতা সৃষ্টির জন্য প্রতি মাসে সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে উঠোন বৈঠক করছি। কোনো কোনো বৈঠকে আক্রান্ত ব্যক্তিও উপস্থিত থাকেন। তবে সেটা ওই ব্যক্তি ও আমাদের সংস্থার কর্মকর্তারাই শুধু জানেন।’